এখনতো আর গ্রামে খুব একটা যাওয়া হয় না। গেলেও নিশ্চয়ই বৃষ্টির দিনে কাঁচা রাস্তার মাটিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানির বুদবুদ ওঠাকে 'ব্যাঙ গর্তের ভেতর থেকে নিঃশ্বাস নিচ্ছে'- ভাবব না। কাঁদা দিয়ে গর্তটা বুজে দিয়ে বুদুবুদ ওঠা থামাবো না। আর থামালেও একটা ব্যাঙ মারার আনন্দে অভিভূত হব না। কারন এখন আমি এখন ম্যাচিউরড। এখন জানি মাটির ছোট ছোট গর্ত পানি দিয়ে ভরাট হবার সময় ভেতরের বাতাস বের হয়ে আসে বুদবুদ হয়ে। ব্যাঙ-ট্যাঙ কিছু না। ওওহো। গ্রামের সেই রাস্তাটাও পিচ দিয়ে মোড়ানো হয়ে গেছে। সেখানেতো ব্যাঙরা বৃষ্টির দিনে নিঃশ্বাস নেয় না আর।
যদিও এখন আর আমার দাঁত পড়ে না। ওঠেও না। তবুও এখনো সুতা দিয়ে হেঁচকা টানে তুলে আসা দাঁতটা নিশ্চয়ই পুকুরে ফেলে কবিতার মত আবৃত্তি করব না- 'মাছ ভাই, মাছ ভাই, আমার দাঁত তুমি নাও। তোমার দাঁত আমায় দাও।" যতসব ছেলেমানুষী ইমম্যাচিউরিটি। চিকন চিকন দাঁতের প্রত্যাশায় এমন পাগলামী করা আমার মত বড়মানুষের পক্ষে কি সম্ভব?
মনে পড়ে মফস্বলের স্কুলটাতে কেজিতে পড়ার সময়কার এক দিনের কথা। সেদিন প্রচন্ড ঝড় হচ্ছিল বাইরে। আধাপাকা স্কুল ঘরটার বারান্দা থেকেই আটআনার চালতার আচার কিনে খাচ্ছিলাম। ক্লাসেরই এক ছেলে পাশে এসে বসল। বলল,'আচ্ছা তোদের বাসায় কে কে আছেরে?'
বললাম আম্মু, আমি, নানা, নানু আর রতন। রতন আমাদের বাসায় থাকত। রতনকে কাজের ছেলে বলতাম না।
'তোদের বাসা কি পাকা দালান নাকি?'
'না। পাকা দেয়াল। উপরে টিনের চাল।' তার চোখে হাসি খেলে গেল। যদিও তখন বুঝিনি।
তারপর সে যা যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে- প্রচন্ড ঝড়ে আমাদের বাড়ির চাল উড়ে যাবে। আরো কি সব হাবিজাবি। নানা, নানু, আম্মু আর রতন মারা যাবে। এইসব হেনতেন। আমি মাথা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করলাম। এমন কখনো হবে না। 'দেখিস তুই।' বলে উঠে চলে গেল। হাতের চালতা হাতেই থাকল। আমি ভাবতে বসলাম। ব্যাপারটা অসম্ভব না। বাইরে তখন খুব ঝড়। আমি চোখের সামনে দেখলাম আমার পরিবারের সদস্যরা একে একে মারা যাচ্ছে। চিৎকার করতে করতে। চিৎকারের তীক্ষ্ণতায় আমার চোখে জল এসে গেল। টিফিনের পরের পিরিয়ডে ম্যাডাম ক্লাসে এসে দেখেন চোখের পানিতে ক্লাসের মেঝে ডুবে আছে। দমকে দমকে কাঁদছি আমি। কান্না থামানোর জন্য ঐ ছেলেকে (ছেলে ছেলে করছি কারন তার নাম আজ আর মনে নেই) খুব করে বকলেন। আর সেও স্বীকার করল- সে মিথ্যা মিথ্যা ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু বাসায় গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরার আগপর্যন্ত আমি নিশ্চিন্ত হই নি।
এখন পারলে আসুক ছেলেটা। ভয় লাগাক দেখি আমাকে।
বিটিভিই ছিল আমার একমাত্র আর চরম বিনোদনক্ষেত্র। প্রতি রবিবার বসে থাকতাম টিপু সুলতান দেখার জন্য। আর পরের ছয়দিন একটা লাঠি কোমরে গুঁজে হাঁটটাম। শুক্রবারের আলিফ লায়লা। আহা আলিফ লায়লা। এখনো কান পাতলেই শুনি আলিইফ লায়লাআআআ.....। রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প হলে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম। আর সিন্দাবাদের কাহিনী হলে টিপুর লাঠির পাশে কোমরে আরেকটি লাঠির যোগ। এক কাঁধে ম্যাকগাইভার আরেক কাঁধে রোবকপ নিয়ে রাজ্যের হারামীপনা করে বেড়াতাম। তখন টিভিতে এক লোক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াত আর গান গাইত। বড় হয়ে তার নাম জেনেছিলাম। কুদ্দুস বয়াতী। তার গানের 'আন্ডাবাচ্চা' শব্দটা শুনে মজা পেতাম। এখন আমি ম্যাচিউরড। টেলিভিশন দেখি না। সারাদিন মজিলা ফায়ারফক্সে ঘাড় গুঁজে রাখি।
বড় বড় ট্রাকগুলা চোখের সামনে সাঁই সাঁই করে ছুটে যেত। দেখতাম আর পুলকিত হতাম। পুলকিত হতাম আর ভাবতাম। ভাবতাম- বড় হলেও আমিও এমন একটা ট্রাক চালাবো। ট্রাক নিয়ে ছুটব অচেনা পথ ধরে। তখন আমিই হব রাস্তার রাজা। সব গাড়িই আমাকে পথ ছেড়ে দেবে। আর আমি সামনে এগুব। এগুতেই থাকব। রাতে কোথাও গাড়ি থামিয়ে তাতেই ঘুম। সকালে জেগে আবার সাঁই সাঁই। এখন চিন্তা করে জিভ কামড়াই। ট্রাক ড্রাইভারকে কেউ মেয়ে দিবে না।
এখন আমি ম্যাচিউরড।
এখন আর ব্যাঙ মারিনা, ভয় পাইনা অকারন, ট্রাক ড্রাইভার হওয়ার কথা কল্পনাও করি না। বাস্তবতার রক্ত বইছে আমার শিরা-উপশিরা-অনুশিরায়। তবুও আমি একটি হলেও ব্যাঙ মারতে চাই। খুব খুব চাই। আমি আবার ইমম্যাচিউরড হতে চাই। সত্যি খুব চাই।