অনেক মুসলিমের মাঝে একটি আচরণ আমি খেয়াল করেছি, সেই মনোভাবটি সর্বপ্রথম আমি নিজের মাঝেই খুজে পেয়েছিলাম। তাই আমি জানি এমনটা হয়। কারণ এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা—যে কুরআন বর্তমান সময়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কুরআন আমার জীবনের ব্যপারে কিছু বলছে না। এটা এমন কিছু নিয়ে বলছে যা অনেক আগেই ঘটে গেছে। আমি যাদেরকে চিনি যারা কুরআন নিয়ে কথা বলে, তাদেরকে দেখলে মনে হয় তারা ৫০০ বছর আগেই পড়ে আছে। তারা আধুনিক মানুষের মত নয়। তারা যখন কথা বলে, এমনভাবে কথা বলে যেভাবে আর কেউই কথা বলে না। আমার বন্ধুরা, সহকর্মীরা, শিক্ষকরা কেউই এইভাবে কথা বলেনা।
আপনি একজন খাতিবের বন্ধু হতে পারেন। তারা এমনভাবে কথা বলে যেন তারা ভিন্ন কোন যুগের মানুষ যাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মীয় আলোচনার পর আমার প্রথম মনোভাব ছিল যে এটি এই সময়ের জন্য নয়। এটি একটি পুরাতন কিছু, প্রাচীন কিছু মানুষের জন্য। এই ধর্ম পালন করে এই যুগে বেচে থাকা সম্ভব নয়। অসম্ভব।
আর আমি যত লেকচার শুনেছি সব সময়ই তারা এই কথাই বলত যে এখনকার সময়টা কতটা খারাপ। এখন বেশ খারাপ সময়, আগে কতই না ভালো সময় ছিল। তো আমি নিজেকে বলতাম যে কিন্তু ঐ সময় তো চলে গেছে। আর এখন খারাপ সময় চলছে। তো কি আর করার? এটি প্রথম সমস্যা।
দ্বিতীয় যে সমস্যা আমি দেখেছি। আবারও, আগে নিজের মাঝেই দেখেছি এরপর আরও লাখ লাখ মানুষের মাঝে যে এই ধর্ম, এই বইটি খুবই কঠোর। আর কঠিন। যেই নিয়ম কানুন আছে তা পালন করা সহজ নয়। এই নিয়ম নীতি গুল কিছু জিনিস থেকে দূরে থাকতে বলে, কিছু করতে বলে। কিন্তু এগুলোর সংখ্যা অতি মাত্রায় বেশি, বেশ কঠিন এবং প্রাসঙ্গিক নয়। পালন করা সম্ভব নয়। আর যদি পালন করতেই হয়, তবে আমাকে চরমপন্থি হতে হবে। সাধারন-সুখী কেউ থাকতে পারবেনা এগুলো পালন করে। আর যতই বেশি ধার্মিক আপনি হবেন, তত বেশি বিষণ্ণ হবেন। তত বেশি রাগী, দেখতেও প্রচন্ড রাগী। আমি যত ধার্মিক লোকজন চিনি, তারা খুবই রাগী মানুষ। আমি ঐ রকম হতে চাইনা। তারা এমন হয়েছে তার কারণ নিশ্চয়ই এই ধর্ম। এই ধর্ম বেশ কঠোর, তাই মানুষকেও কঠোর, রাগী বানিয়ে ফেলে।
শুধু তাই না, আমি আল্লাহ পাকের এই পথে আসার আগে যদি দাড়িওয়ালা কাউকে দেখতাম, উল্টা দিকে দৌড় দিতাম। কারণ তারা আমাকে শুধু বলত, কেন আমি জাহান্নামে যাচ্ছি। অথবা তারা আমাকে কিছু করতে বলবে, যাও নামাজ পড়। নাহলে কোন প্রশ্ন করবে, তুমি এই পোশাকে কেন? কি শুনছো? কি দেখছ? থামুন। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইনা। আমাকে একা থাকতে দিন। আপনি আরাম করছেন, পিজা খাচ্ছেন। একজন দাড়িওয়ালা কেউ ঢুকল রেস্তোরাঁয়। এই হয়েছে! আমি ভালোই খাচ্ছিলাম, তার কি এখানেই আসতে হল? তো দ্বিতীয় মনোভাব হল, এই ধর্ম বেশ কঠোর, যারা মেনে চলে তারাও কঠোর।
তৃতীয় হল, কেউ যখন আল্লাহ পাকের ধর্ম নিয়ে কথা বলতো, কেউ আমাকে বলতোনা কেন আমাকে মুসলিম হতে হবে? শুধু হতে হবে। এগুলো তোমাকে করতে হবে। যদি জিজ্ঞাসা করি, কেন? কারণ না করলে তোমাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। আমি কেন বিশ্বাস করবো? প্রশ্ন করা মানে তুমি কাফির হয়ে যাবে। তোমার মনে সন্দেহ আছে?! তোমার ঈমান নেই?
একই মানুষের কাছে গিয়ে যদি আপনি প্রশ্ন করেন যে, পৃথিবীতে তো আনেক গুলো ধর্ম আছে, আমরা কিভাবে জানলাম যে এই ধর্মই ঠিক? তিনি আপনাকে বলবে, আর আমাকে বলেছিল যে ছেলে তুমি এখনই ওযু করো, আর দুই রাকাত নামাজ পড়। শয়তান তোমাকে এগুলো বলছে। ওযু আর দুই রাকাত নামাজ পড়ার পরেও আমার একই প্রশ্ন। আমরা এই ধর্ম কেন অনুসরণ করছি? যখনই আমি কাউকে জিজ্ঞাসা করেছি সবাই বলেছে, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ কিভাবে তুমি এমন প্রশ্ন করতে পারলে? ইন্না লিল্লাহ! তোমার বাবা মা জানে এই ব্যাপারে? ভাই, তুমি বস। তোমার উপর কোন রুকিয়াহ করে দেই।
কিন্তু রুকিয়াহ করার পরও আমার মনে একই প্রশ্ন। এরপর আমি কি ভাবতে শুরু করেছিলাম? আর আরও লাখ লাখ যুবক যুবতী ভাবতে শুরু করে? তাদের কাছে এর উত্তর নেই। প্রথমত, তারা চায় তুমি প্রাচীন মানুষের মত থাকো। ২০১৫ তে না, ১২৭৫ এ বাস করো। তারা তোমাকে উমর বিন খাত্তাব (রা) এর সময়ে থাকতে বলে। তো প্রথমত, এটা প্রাসঙ্গিক নয়। দ্বিতীয়ত, এটা বেশ কঠোর। তৃতীয়ত, তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়না। তারা মনে করে আমার প্রশ্ন হল শয়তানী কিছু।
এই তিন কারণ যথেষ্ট, কারও বলার জন্য যে আমি ইসলামের ধারে কাছেও যেতে চাইনা। আপনার যদি এই তিনটি কারণ থাকে, আর আপনি ইসলামের ধারে কাছেও যেতে চান না, আমি মেনে নিলাম। এটা যুক্তিযুক্ত। তো আমি আপনাদের বেশ আত্ম বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি, যে এমন কোন দেশে আমি যাই নি, মুসলিম হোক আর নন-মুসলিম যে ঠিক এই রকমি ভাবছে, এমন কেউ নেই। একটি লেকচারে যতজন মানুষই আসে, তাদের মাঝে শত শত, হাজারে হাজারে মানুষ, মুসলিম হোক আর নন-মুসলিম, এই সমস্যায় ভুগছে। বহুদিন ধরে আমি এমনটা দেখেছি। আমার জীবনের অনেকটা সময়ই আমি কুরআন থেকে দূরে ছিলাম এই জন্য নয় যে আমার সময় নেই। বরং এটা কঠোর, এই জন্য। এটি আমার প্রশ্নের উত্তর দিবে না।
আমি নিউ ইয়র্কে কলেজে যখন গেলাম, আমি ফিলসফি, সাইকোলজি, অ্যানথ্রপলজি যখন নিলাম, ফ্রয়েড যখন পরা শুরু করলাম, বিবর্তন যখন পড়া শুরু করলাম, ১৪০০ বছর আগের এক বই কিভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর দিবে? নিশ্চয়ই এটি আমার প্রশ্নের উত্তর দিবে না। তো এটির কাছে যাওয়ার আমার কোন প্রয়োজন নেই।
কিন্তু আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতের কারনে, আর কোন কারণ নেই, শুধু এই কারনে যখন আমি আল্লাহ পাকের বইয়ের সাথে পরিচিত হলাম, আর ভাগ্যবশত দারুন কিছু শিক্ষকের সন্ধান যখন পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম, ঐ তিনটি প্রশ্নই সত্য নয়।
অবিশ্বাস্যভাবে এটি প্রাসঙ্গিক। এতে উত্তর আছে আমার প্রশ্নের, আমার ব্যক্তিগত সমস্যার, এই যুগেরই। সমাজের বা দুনিয়ার সমস্যার কথা পরে, ওটা ২য় ধাপ আর ৩য় ধাপ, আমি নিজের ব্যক্তিগত সমস্যাবলির কথা বলছি। এটায় উত্তর আছে।
দ্বিতীয় সমস্যা ছিল, এটা কঠোর। যত আমি গবেষণা করেছি, আমি বুঝেছি মানুষ হল কঠোর। এই বইটি মোটেও না। আল্লাহ পাক বইটিকে রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মাঝে তা নেই, তাই আমরা যখন কথা বলি, আমরা রাহমাটা উহ্য রাখি। আল্লাহ পাকের বই তা করে না, আমরা করি। আমাদের সহ্য, ধৈর্য নেই। এই ব্যাপারে পরে আবার আমি কথা বলব।
তৃতীয় সমস্যা ছিল, আমার প্রশ্নের কেউ জবাব দিচ্ছে না। আমার প্রশ্ন আছে, আর তারা বলে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ শয়তান! অথচ কুরআন বলছে, তোমাদের প্রশ্ন আর সমালোচনাগুলো নিয়ে আসো। দুনিয়ার কোন ধর্ম বলে, আসো, সমালোচনা করো। শুধুই ইসলাম, আর একটিও নেই। তোমাদের প্রশ্ন আর সমালোচনাগুলো নিয়ে আসো। আমি যখন পড়ছিলাম, আমি ভাবছিলাম, এগুলো কি বলছে? আমি তো ভেবেছিলাম, এখানে লিখা থাকবে বিশ্বাস করো, নাহলে তোমাকে পুড়তে হবে! অথচ এখানে বলছে, ‘আফালা তাকিলুন’। তুমি ভাবো না কেন? অন্য কোন ধর্ম তোমাকে নিজের মত ভাবতে বলে? অন্য সব ধর্ম বলে, ভাবনা থামাও, বিশ্বাস করো। আর এটি বলছে, কোনোভাবেই তুমি চিন্তা করা থামাবে না। তোমাকে চিন্তা করতেই হবে, আর শুধু মাত্র তখনি তুমি সত্যিকারের অর্থে বিশ্বাস করতে পারবে। আর কোনও ধর্ম নেই এমন। আমরা বলতে থাকি নন-মুসলিমদের দাওয়াত দেবার ব্যাপারে, আমি বলছি আমাদের নিজেদের উম্মাহ কুরাআন থেকে দূরে সরে গেছে। যখনি তারা কুরআন সম্পর্কে কিছু শুনছে, তারা শুনছে এমন কিছু যা কঠোর, যা প্রাসঙ্গিক নয় আর যা তাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। অথচ কুরআন মোটেও এমন নয়, এখানে সব প্রশ্নের উত্তরই আছে। কিন্তু যে এটা উপস্থাপন করছে, সে ঐভাবে উপস্থাপন করছে না। ভুলভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। অতি নিচু ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই সমস্যাটি আমি দেখছি আমার সামনে। এই সময়ের চ্যালেঞ্জ এটাই। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কতকিছুই না বলা হয় কুরানের আয়াত নিয়ে। খুবই সহজ একটি আয়াত তুলে ধরা। মোটেও কঠিন নয়। আর এর অপব্যবহারও খুবই সহজ। খুবই সহজ। আর মানুষ এটা করেও। মাঝে মাঝে মানুষ এমন অপব্যবহার করা কুরানের আয়াতের আর নিষ্পাপ মানুষ মারা যায়। এই কুরআনের এই অপব্যবহার এই দুনিয়াতে শুধু ফাসাদ তৈরি করে তা নয়, রক্তপাত ও ঘটানো হয় এর নামে। এমনটা হচ্ছে। এমন অপব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ আরও দূরে সরে যাচ্ছে কুরআন থেকে। এমনটা হচ্ছে। এমনভাবে কুরআন নিয়ে মানুষ কথা বলছে, যে এমনকি মুসলিমও বলছে, ইসলাম আমার আর দরকার নেই। আমি সরে যেতে চাই। এটা হল এই সময়ের ট্র্যাজেডি।
আমি এখন ট্র্যাজেডির ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করবো। আপনারা অনেক শুনেছেন এই ব্যাপারে।
- উস্তাদ নুমান আলী খান - (পোস্টটি সংগৃহিত)