বাজারের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার প্যাঁচপ্যাচে কাদায় মাখামাখি হয়ে গাছপালায় ছাওয়া মেঠো পথে এসে উঠলে তার হঠাৎ আশংকা হল আজ রাতের বৃষ্টির পর বান ডাকতে পারে। দু’ধারের নাম জানা, না-জানা গাছের পাতার ফাক-ফোকড় আর মোটামুটি জনশূণ্য পথে আকাশটা যেন কেমন অবারিত হয়ে আছে। তাই দুধের মত সাদা একটা আবরণে মোড়ানো গোলগাল আকাশটা একটু বেশিই মনে করিয়ে দেয় যে গত কয়েক দিনের থেমে থেমে বর্ষণ এখনো শেষ হয়নি। শেষ কবে রোদের ঝিকিমিকি দেখেছিল মনে করতে পারে না। গাছের পাতা থেকে এখনো রসের টুপ টুপ করে জল পরছে।
মাঠের ফসলগুলো একটুও রোদ পায় নি, বরং জলের টানে ধুয়ে যায় যায় অবস্থা! কেমন ফুলে ফুলে উঠছে নদী, যখন-তখন ভেঙ্গে পরতে পারে অতলে। এই ভেঙ্গে পরা পাড়ের সাথে কার বাসা-বাড়ি নিয়ে বিলীন হয়ে যায় কে বলতে পারে? কে মেটাবে নদীর অপরিসীম ক্ষুধা? ভাবতেই আতংকের এক হীম স্রোত অনুভব হয় তার।
কে যেন হাক দেয়, - নজিব, বুড়ায় আজ সবাইরে থাকতে কইছে।
শুনতেই ভিতরে ধক করে উঠে অজানা আশংকায়। বুড়ো এক নিম্নভূমির সবচেয়ে প্রবীণ এবং জ্ঞানী বলে সকলের মান্য ব্যক্তি। তার যে কোন কথাকেই লোকে দৈব-বানী বলে জ্ঞান করে। তাই যে কোন বিষয়ে কেউ একমত হতে না পারলে সেই বুড়োর কাছেই লোকে ছুটে যায়। আবার কোন কোন সময় বুড়োই লোকেদের ডেকে নিয়ে যায় যখন গুরুত্বপূর্ণ বা আশংকাজনক কিছু সবাইকে জানানো দরকার বলে মনে হয় তার। যেমন আজকে বলল।
নজিব যা ভয় ছিল, তাই হল। বটগাছ-তলায় সমবেত মানুষের সামনে বসে বুড়ো যা বলল, তা সংক্ষেপে এরকম, - গত কয়েক দিন যাবৎ বিরামহীন অতিবৃষ্টি যেমন এখানে হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে বাঁধের ওপাড়ে শুকনোর দেশে। এতে করে শুকনোর দেশের লোকেরা যে কোন দিন পানি ছেড়ে দিতে পারে, এবং সেটা কাল-পরশুর মধ্যে ছেড়ে দিবেই।
সবাই তখন চিন্তায় পরে যায়। এখন কি হবে? বান এখন প্রত্যাসন্ন! বুড়ো সবাইকে যথাসম্ভব ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়, ছেলে-বুড়রা থাকবে চৌকির উপর বা কোন উচু স্থানে। যারা নদীর কাছাকাছি তাদের সরে আসতে বলে দূরে।
শুনে চাষী শ্রেণীর লোকেরা মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়, বুড়োর উপর নয়, নিজেদের অদৃষ্টের উপরে। ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে থেকে হয়তো নিজে ভেসে যাওয়া থেকে রেহাই পাওয়া গেল, ফসলগুলার কি হবে? মাত্র দুই সপ্তা গেল, ধান-সরিষা-ভুট্টা কিছুই তো পাকে নাই! গতবারের আলুও তো নাই, এখন কি না খাইয়া মরতে হইবে? তারচে’ বানের জলে ভাইসা যাওয়াই ভালা! মৎসজীবিরাও যে খুব সুখে থাকবে তা না, পুকুরের মাছ তো সব হাওয়া হয়ে যাবেই, নদীর মাছ ধরেও জুত পাওয়া যাবে না। এত এত মাছ না হয় ধরা পরলোই, কিনবে কে? কিনবার পয়সা কার কাছে আছে শুনি? পুকুর থেকে মাছ হাপিস হয়ে গেলে খরচও তো তুলতে পারবে না ওরা।
বুড়ো চোখে কম দেখলেও সকলের মনোভাব বুঝতে পারে। কিন্তু কি করবে সে? কি বলে শান্তণা দিবে?
ফেরার পথে নজিবের ছোট ভাই শুধায়, - ভাইজান, শুকনার দেশের মাইনষে বাধ দেয় কেন?
নজিব জ্ঞান দেয়ার সুযোগ পেয়ে যেন খুশিই হয়, - বুঝছ না, শুকনার দেশে তো পানি নাই, ওরা ফসল বুনবো কেমনে?
ওগো পানির অনেক দরকার তো, তাই বাধ দিয়া পানি আটকাইয়া রাখে। আমাগো তো পানির অভাব নাই, নদী আছে, বিল আছে, আওর আছে, আমাগো তাই বাধ লাগে না।
-কিন্তু তাইলে গাধলার সোময় পানি ছাড়ে কেন?
-আরে বোকা, পানি না ছাড়লে তো ওগর অইখানেও বান লাগবো নে।
নজিবের ভাই একটু চিন্তা করে মাথা চুলকে বলে, - তাইলে আমরাও বাধ দিলে পারি, পানি ছাইড়া দিলেই আর বান হইবো না!
নজিব ওর কথায় হেসে ফেলে, - ধূর বেটা, এই নামা’র দেশে কি বাধ দেয়া যায়? নাকি দিয়া কোন লাভ হবে?
-কেন্ হবে না? নজিবের ভাইয়ের গলায় বিরক্তি।
কিন্তু নজিব আর জবাব দেয়ার সময় পায় না, চোখে কিছু একটা আটকে গেছে। ভাইকে বলে, - তুই বাড়িত যা। আমি পরে আইতাছি। এই বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে সে বাঁশঝাড়ের পিছনে পা বাড়ায়। পুরোনো ভাঙ্গা দেয়ালের উপর চুল ছড়িয়ে বসে আছে একটা মেয়ে। দেখে নজিব বলে, - কি রে ময়না, এমনে চুল ছড়াইয়া বইসা আছোস, তোর তো অলক্ষী লাগবে।
-আরে ধূর, অলক্ষি’র আর বাকি আছে কি? কাইল যদি বান উঠে তহন তো আমি-ই থাকমু না, আর অলক্ষি!
নজিব কন্ঠে মধু ডেলে বলে, -ছি, এমনে কইস না।
-তয় কেমনে কমু? এমনে কি মানুষ বাঁচে? আমার আর ভালো লাগে না।
-সবুর কর ময়না, তরে আমি বাধের ওইপাড়ে শুকনার দেশে লইয়া যামু!
-ইহ্, চাইলেই বুঝি যাওয়া যায়! ওরা কি তুমার বাপ লাগে যে নিয়া যাইব?
-ধূর তুই মাইয়া মানুষ কি বুঝবি? টেহা জমাইতাছি। গঞ্জে দোকান দিছি। এরপর পাসপোর্টটা করতে পারলেই তরে নিয়া যামু গা, আর আইমু না....
-কেন আমারে নিবি কেন? আমি এইহানে থাকমু।
-এইখানে কি মানুষ থাকেরে? শুকনার দেশে তরে আমি রাজরানীর হালে রাখমু। তর দশটা চাকর থাকব। তুই খালি বইসা বইসা আদেশ দিবি, কিছু করা লাগব না। আর আমাগো গাড়ি থাকব। ওইযে গেল বার মেলার সময় যে মটর গাড়ি দেখছিলাম, ওইটার মত।
ময়না যেন হেসে উড়িয়ে দেবার ভান করে বলে, -আরে যা যা! তোর চোপা এইহানে পিটাইতে আসিস না...
মুখে বললেও ময়না মনে মনে যেন স্বপ্ন বুনে। কতবার নির্ঘুম রাতে কিংবা শেষ বিকেলের আলস্যে ভেবেছে বাঁধের ও-পাড়ে শুকনার দেশের কথা। শুধু ময়না কেন, শুকনার দেশ সবার কাছে একটা স্বপ্নই। ওখানে বান নাই, কষ্ট নাই, অভাব নাই, রোদে পোড়া নাই, ওখানে মানুষ চলে গাড়িতে-বাসে-ট্রেনে-ট্রামে! অসুখ হইলে বড় ডাক্তার আছে, সোমেন ডাক্তারের মত “চোর” না ওরা। মন থেকে খুব করে চাইলেও কেউ যেতে পারে না সেখানে আজীবন চেষ্টার পরও। আবার যে একবার যাবার সুযোগ পায়, সে আর ফিরে আসে না। কেনই বা আসবে এ-পাড়ে নিম্নভূমিতে? পঁচে মরতে? হয়তো কোনদিন এ-পাড়ের কথা মনেও রাখে না তারা।
***
জ্ঞানী বুড়োর শংকা ভুল হবার নয়। সেইদিন রাতেই বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়া হল। সাথে সাথে ফুলে ফেপে উপচে পরল নদীর জল। কোথাও কোথাও পাড় ভেঙ্গে পরল হুট করে, কিছু বুঝে উঠার আগেই। ফসল, গবাধি পশু প্রায় সবই ভেসে গেল মুহুর্তে। মানুষ মারা যেতে পারত অনেক, শুধু বুড়োর কারণেই বেচে গেল সবাই। কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতি এড়ানো গেল না। সাপ, বেজি, কুকুর সব গাছের ডালে পাখির বাসার কাছেই আশ্রয় নিল। অনেকের পুরোনো বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বানানো বাসা বন্যায় ভেঙ্গে পরলে কোন রকমে সাতড়ে কিংবা নৌকায় করে উচু শক্ত মাঁচার উপর আশ্রয় নিল। এই মাচা বন্যার কথা ভেবেই বানানো হয়েছিল অনেক আগে। নজিবের মত জোয়ান ছেলেরা সব নৌকা নিয়ে নেমে পরেছে ঘর-হারাদের খুজে খুজে বের করে নিয়ে আসতে।
মাচার উপর তখন ক্রন্দন-রোল। সয়-সম্পত্তি সব গেছে ওদের। এখন বানের সময় কোন রকম কাটিয়ে দিল মাচায় এই ক’টা দিন, তারপর? থাকবে কই? খাবেই বা কি? রহিম মাস্টারের স্কুলটাও বুঝি গেল। কত আর এর ওর দান করা চাটাই দিয়ে এভাবে দাড় করিয়ে রাখা যায়? এবার নতুন করেই বানাতে হবে দেকাহ যাচ্ছে। এতে অবশ্য পিচ্চিগুলা খুব খুশি। ওদের কাছে পানি মানেই আনন্দ, পানিতেই তো জন্ম ওদের! জীবনের রূঢ় বাস্তবতা থেকে ওরা বহু দূরে।
ভোর হতে হতে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে সবাই। রাতের আগেই ফসল যতটা সম্ভব উঠিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এইগুলাতে কি হবে? কিছুই তো পাকে নাই। এখন ডাল-পাতা সিদ্ধ করে খাওয়া ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মাছ আর গবাদি পশু ভেসে যাওয়ায় কেউ কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। বর্শি ফেলে ফেলে মাছ শিকার করে। পিচ্চিদের কাছে এটা এখন খেলায় পরিণত হয়ে গেছে। পশু-পাখির মৃতদেহ ভেসে উঠলে তো আর দেখতে হয় না, এখনো পচন ধরেনি যেগুলো, সেগুলোর মাংস কেটে-কুটে নিয়ে রান্না চড়িয়ে দেয়। হালাল-হারামের ভয় নেই, এই দূর্যোগের মধ্যে আবার হারাম কি?
***
তিনদিন পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে। নজিব ফিরছে নৌকা নিয়ে। বাঁধের ও-পাড় থেকে এ-পাড়ে আসছে নানা দ্রব্য, পাচার হয়ে। কোনটাই মাগনা না, চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। এ-পাড়ে এখন সাপ্লাই বলতে এটাই বাকি আছে আপাতত। নজিব এইসব সদাই নিয়েই ফিরছে নৌকায়। জায়গামত বিলি করতে হবে। যেতে যেতে চলে গেল ময়নাদের বাড়ি। বানের জলে হাবুডুবু খেয়ে বিপন্ন ওদের দেখে হঠাৎ যেন ক্ষোভে ফেটে পরতে ইচ্ছে করে।
ময়নাকে কাছে পেয়ে বলে, - মনডা চায়, ডিঙ্গিটা লইয়া একটানে বাধের ওইপাড়ে চইলা যাইতে পারতাম!
ময়না তাকে থামায়, - কও কি? তোমারে তাইলে কি আস্ত রাখবে? ওইপাড়ের পুলিশ কেমন, বুঝো? দিনে-দুপুরে মানুষ মাইরা ফালায়!
নজিব আর কোন কথা খুজে পায় না। ময়না, ওকে শান্তণা দেয়, - চিন্তা কইরো না, দুই দিন পর পানি এমনেই নাইমা যাইব, তারপর তো সব আগের মতই!
নজিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
***
মাঝ রাতে বিকট শব্দে ঘুম ভাঙ্গে অনেকের। সবাই ততদিনে যার যার বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। পানি কমেই না, মরার উপর খাড়ার ঘা’এর মত বৃষ্টি থামারও নাম নেই। আশংকায় অনেকে চিৎকার করে উঠে, - কি হইল?
একটু খেয়াল করতেই অন্ধকার চোখে সয়ে আসলে দেকাহ যায় ময়না’দের বাড়িটা যেখানে ছিল, সে স্থানটা এখন ফাকা, কেবল বুরবুরি উঠছে। সাথে সাথে নজিব-সহ আরো বেশ কয়েকটি জোয়ান নেমে পরল কাজে। মুখে মুখে চাউর হয়ে গেল পানির ধাক্কায় ময়না’দের বাড়ি চুরমার হয়ে গেছে। বোধহয় কাঠে পচন ধরেছিল, ভার সহ্য করতে পারেনি। ইতিউতি খোজা হল কেউ পানির উপর ভেসে উঠে বা সাতড়ে আসছে কি না। এমনকি সেই নোংরা, গোলা, পঁচা পানিতে ডুব দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে দেখল কিছু মিলে কি না। নাই!
শুধু ওদের বাড়ির পিচ্চি মেয়েটাকে খুজে পাওয়া যায় পানির তলে। হঠাৎ হাতে ছোয়া লাগতেই উঠিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু লাভ কিছুই হল না, পিচ্চি মেয়েটা মৃত!
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায় নজিব। কাদতেও যেন ভুলে যায়। এভাবে মুহুর্তেই মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে পারে!
***
নৌকায় করে হঠাৎ বুড়োর আগমণ। সে জানায় বানের পানি প্রায় তিনফুট কমে গেছে। বেশ কয়েক জায়গায় নদীর পানির লেভেলের সাথে মিল রেখে বসানো ছিল বিশাল বড় বড় স্কেল। সেটা দেখে এসেছে বুড়ো।
-আমি নিজের চোখ্খে দেইখা আসছি। এই পানি নামতে আর দুই দিনও লাগবে না! বুড়োর কন্ঠে ফুর্তির আভাস।
সেদিনের ট্রাজেডীর পর এই প্রথম কারো খেয়াল ছিল না যে পানি অনেক কমে গেছে। তারমানে শীঘ্রই সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন এই ক’টা দিন মনে হবে যেন কোন দুঃস্বপ্ন। আবার নতুন উদ্যোমে নেমে পরবে সবাই সব কিছু আগের মত আগের মত করে গুছিয়ে নিতে। কিন্তু চাইলেই কি আর আগের মত হয় সবকিছু? সবাই টের পাবে, কি যেন নেই। কিংবা কে যেন নেই। তবে এতটুকু মেনে নিতেই হবে ওদের। কারণ, ওরা সংগ্রাম করেই বাঁচতে শিখেছে। কারো কারো কাছে জীবন মানেই তো সংগ্রাম।