সিনেমার নামটা এই মুহূর্তে মনে আসছে না- “পথে হল দেরী”(?)- নিশ্চিত না। চিকিৎসক অসুস্থ সুচিত্রা সেনকে ব্যামো সারাবার নিমিত্তে বায়ু পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন। সুচিত্রা সেনের গন্তব্য ছিল দার্জিলিং।
আগস্ট মাসের শুরুর কথা। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জ্বল জ্বল করছিল সাত মাসের কুৎসিত পেশাদারিত্ব। কি করি, চাই বায়ু পরিবর্তন। আমারতো পাহাড় সাগর দুটাই চাই। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, গন্তব্য- দক্ষিনের সুখী গ্রাম কক্সবাজার।
০৯- ০৮- ২০০১২ ফকিরেরপুলের শ্যামলী বাস কাউন্টারে- উৎসবের চাপা আমেজ। নিয়মিত বিরতিতে গর্জে উঠে ফারিয়ার হিংস্র ক্যামেরা, আর উচ্ছল স্মৃতি ছবি হয়ে আশ্রয় নেয় ফেইসবুকের ডিজিটাল দুনিয়ায়। অভিভাবকদের আগমন নিশ্চিত করে আমার নির্বাসন- পালালাম কাউন্টার থেকে, এক হাতে চা আর এক হাতে তা(!) নিয়ে অপেক্ষা করলাম গাড়ি আসার।
যাত্রা শুরু- মুহূর্তের মধ্যে উপভোগ করলাম গ্রামের মেঠো পথে গরুর গাড়ীতে চড়ার নির্মল সুখ। ঢাকার রাস্তার কথা বলছি- বিশ্বাস করুন আর নাইবা করুন। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম বান্দরবন ভ্রমণের ম্যালারিয়া prophylaxis এর মতো গাড়ির কিছু অংশে চলছিলো vomiting prophylaxis এর মহা উৎসব। গল্প- আড্ডা- চৈতির আনা বিরিয়ানি, লাল রঙের ঢাকা- ব ২০৩১ তখন এক ভ্রাম্যমাণ আনন্দ বাড়ি।
পথে নূরজাহান হোটেল, মাথায় মিতব্যায়ী হওয়ার অচেনা ভূত চেপে বসলো। ডায়েট কন্ট্রোল সাথে মানি কন্ট্রোল, পরটার সাথে ভাজি খেয়ে ফেললাম।
পরদিন বেলা এগারোটা- আমরা তখন কক্সবাজার। অটো গাড়ির কাচ গলিয়ে তাকাই- সৌম্যশান্ত সমুদ্রের স্নিগ্ধ রূপ, সৌন্দর্য বিলাতে বিলাতে ক্লান্ত, বিশ্রাম নিচ্ছে– তবু চেহারায় ব্যাক্তিত্বের ছাপ, ঠিক কেতাদুরুস্ত ভদ্রমহিলা। মনে হলো সেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো ষোল পরিব্রাজকের আগমনের।
বিলম্ব হয়নি, নেমে পড়লাম সমুদ্র বিলাসে। রুপ্পীর বাতাসভর্তি টায়ারে ভাসা, সাবার রঙিন চশমার সলিল সমাধি, তারপর বালি- যুদ্ধ। ততোক্ষণে খেয়ে ফেললাম নোনতা ফ্লেভারের কয়েক গ্লাস বালির সরবত।
হোটেলে ফিরবো- দূরে তাকালাম, দূরে কে যেন? মনে হলো সন্তানহারা শোকাচ্ছন্ন মা, না কোরবানির গরু হারানো উদ্ভ্রান্ত ব্যাবসায়ী? ও মা, এ তো আতিসা! ও স্যান্ডাল হারিয়েছে। সংকল্পবদ্ধ আতিসা তার স্যান্ডাল খুঁজে পেলো। ওর দিকে তাকালাম, এ যেন শরৎচন্দ্রের মহেশকে খুঁজে পাওয়া অস্রুসজল গফুর।
দুপুরে ইফতারি করতে রেস্তোরাঁ খুঁজতে কষ্ট হল। কোরাল মাছ খাবো, ও মা! এ তো রোহিঙ্গা ইলিশ। সকাল সকাল কক্সবাজারে ঠগ খেলাম। সে কষ্ট উবে গেল রাত্রে জামান হোটেলে। সাজিদের মিথ্যা পরিচয়ে আথিতেয়তা তখন তুঙ্গে। রোহিঙ্গা ইলিশের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যাওয়া জম্পেশ এক ডিনার। সাজিদ কে ছিল? কক্সবাজারের জামাই।
রাত একটা- অন্ধকার ভারি হয়, নেশাগ্রস্ত ক্লান্ত ধূসর রাত, দূরে সাগরের বুকে জাহাজের নিভু নিভু আলো, এ যেন জোস্নার আলোয় শত শত জোনাকি পোকা, এরপরের ঘটনা তো পার্মানেন্ট কালিতে লেখা জীবনকাহিনির এক উজ্জ্বল পৃষ্ঠা। Beach Concert এর কথা বলছি। সাজ্জাদের গীটার আর Artcell, শিরোনামহীন, ব্ল্যাকের গানে সৈকতের বুকে ষোলো উন্মাদ ছড়ায় প্রানের উচ্ছ্বাস।
রাত চারটা- সুখী মুহূর্তগুলো ক্লান্তি নিয়ে স্তব্ধতা খুঁজে, ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে বে-রোজদারদের জন্য Sea- Crown এর Complimentary Breakfast. প্লেট তিনটা, মানুষ সাতজন, শুরু হল Complimentary কারচুপি, বদলে যায় Sea- Crown এর ইতিহাস। পেট কেটে ভাগ করা হয় রুটি- ভাজি- সুজি, ম্যানেজারের চক্ষুতো চড়কগাছ, মনে মনে বলে- ফকিরের দল আইছে কারা?
ইনানী বিচ যাচ্ছি, আমার স্বপ্নযাত্রা, একদিকে সাগর আর একদিকে পাহাড় আর ঝরনা। দুপাশে সারি সারি বিনয়ী ঝাউ গাছ, চান্দের গাড়ি, সতেরো উন্মাদ, জানি প্রকৃতিরও হিংসে হচ্ছিলো, ওর নিঃশ্বাস বেড়ে যায়। মুখ হা করে বাতাস ছোড়ে- আমাদের উড়িয়ে নেয়ার বৃথা প্রচেষ্টা, আমরা উড়ি নি- বরং উড়ে গেছে আমাদের শহুরে জীবনের বদ্ধ সীমারেখাগুলো- ঐ নীল নীলিমায়।
শুনেছি নরকের আগুনের কথা- বুঝি না মানুষ কেন জাগতিক ভয় ভীতির জিনিসগুলো দিয়ে নরক সাজানোর চেষ্টা করে-ভিতু মানুষ বোধয় নরককে আরো বেশি ভয়ঙ্কর ভাবতে ভয় পায়। সবকিছু জানার মালিক তো আল্লাহই। তার কাছেই প্রার্থনা করি- কল্পনা নয়, ইনানি বিচের এই রাস্তা যেন স্বর্গের রাস্তা হয়।
আকাশে পাখি উড়ে গেল, শকুন না তো? ভয় লাগে। শরীরে আমার পচা- লাশের গন্ধ, যে শরীরে মৃত্যু হয়েছে সাংসারিক জীবনের সব চাহিদাগুলোর।
বিকেলে গেলাম বার্মিজ মার্কেটে, সবাই খোঁজে ফতুয়া আচার খেলনা, আমি খুজি সুজলা মং প্রুকে- চার বছর আগে আমার হারিয়ে যাওয়া আধ ঘণ্টার প্রেম, রাখাইন মেয়ে। রাখাইনদের নাকি অনেক জাত্যভিমান, জানে মারতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাই সে প্রেম অংকুরেই বিনষ্ট হয়েছিলো এক অজানা আতঙ্কে। দোকান থেকে দোকানে, আবিস্কার করলাম ছোট্ট এক পিচ্চিকে, পবিত্র মুখাবয়ব, হাত বুলালাম তার মাথায়, নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম এ কি সুজলার উত্তরাধিকার? তবু জানি, প্রিয় মানুষদের উত্তরাধিকারের মাথায় হাত বুলানোর এ যাত্রা শেষ নয়, শুরু।
বার্মিজ মার্কেট থেকে লাবনী পয়েন্ট, আবার কেনাকাটা, সাথে রুপ্পীর সাত রঙের চা! কি কিনবো?- আকাশছোঁয়া দাম। কোনকিছুর প্রতি অসম্ভব ভালোলাগা তৈরি হলে মানুষের বয়স বোধয় কমতে থাকে, সাজিদ বিদ্রোহ করে বসলো- বিক্রেতাদের কাছে আবির্ভূত হল ইস্পাত কঠিন ক্রেতা হিসেবে, নিউ মার্কেটের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছিল বোধয়, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হলো ক্রেতাসকল- কিছুই কেনা হলো না। প্রিয় জিনিসগুলোর দিকে মলিন নয়নে তাকাতে তাকাতে আমারা শিশু হয়ে গেলাম। আর অতি উৎসাহীরা মনে হয় মনে মনে সাজিদের মুন্ডুপাত করছিলো। সাত রঙের চা তাও পেলাম না, খেলাম চিরাচরিত এক রঙের চা, আফসোস থাকল না, থাকল একসাথে চা খাওয়ার রঙিন স্মৃতি। অনেক না পাওয়ার মাঝেও কোন কষ্ট নেই, কষ্ট মানুষের সৃষ্টি, মানুষ কষ্ট পেতে ভালোবাসে।
ঢাকা ফিরছি,সবার মুখে গাঢ় অন্ধকার, বাসে উঠলাম- কি যেন ফেলে এসেছি, অন্ধকারে বাসে শুধুই মনে পড়ছে সমুদ্র তোমাকে, তোমার অপার সৌন্দর্যের কথা, তোমার বুকে বালির বিছানায় আমার একাকী বসে থাকার কথা, তোমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছিলো, তবু প্রকাণ্ড ঢেউগুলোর অবিরাম প্রচেষ্টা ছিল এক ফোঁটা পানি হয়ে আমার পা ছোঁয়ার। তোমার বুকে গাং চিলের ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে স্বীকার করেছি তোমার ভালবাসা সার্বজনীন, মানুষের মতো তোমার ভালবাসায় কৃপণতা নেই, তাই বাসে বসে কষ্ট পেয়েছি, তোমার সাথে সুখস্মৃতিগুলো আমার কাছে এখন যন্ত্রণা, তাই মনে মনে ধিক্কার দিলাম- তোমার এই সৌন্দর্যতো বিষাক্ত, তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার অনুভূতি প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদের মতো।
মানুষের দিনের বেলায় কাটানো সুখী বর্তমানগুলো রাতের চোখ বন্ধ করলে দুঃসহ স্মৃতি হয়ে যায়। আমার মতো যাদের খালি চোখেই অতীত আর বর্তমান একসাথে ঘুরে বেড়ায় তাদের আবার কষ্ট কিসের..
জানি সামনে আবার শুরু হয়ে যাবে ডিউটি, শিরোনামহীনের মতো আবার বলতে ইচ্ছে করছে-
“ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি দাসত্বের সহস্র বছর
ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি মৃত্যু শিয়রে শিয়রে, গুনছে প্রহর”