ফোঁড়া-কাটার স্বপ্ন নিয়ে অতিউৎসাহী বন্ধুদের সাথে আমার ইন্টার্নী জীবনের মহা-অভিষেক ঘটেছিল বারডেম নামক রাজ্যে। সারজারী ইউনিট ২, কি চাই? স্বপ্ন তো আমার নোনা পানিতে ভেজা গাং চিলের সাদা ডানা। কিন্তু দু দিনেই প্রিয় ম্যাডাম এর মধুর গালি-গালাজ এ আমার vital sign গুলো ক্রমাগত fluctuate করা শুরু করল। অসংখ্য ফাইল এর চাপে স্বপ্ন নামক গাং চিল যে আর ডানা ঝাঁপটায় না, সেতো তখন রানী-ক্ষেতে আক্রান্ত গৃহ-পালিত ব্রয়লার মুরগি। সেই যে কাক ডাকা ভোরে ফাইল নামক শাহনামা লিখতে বসতাম তা শেষ হতো পড়ন্ত বিকেলে, ততোক্ষণে gastric juice এর প্রবল প্লাবনে আমার গ্যাস বেলুন হয়ে উড়ে যাবার উপক্রম।
পরিচিত হলাম ৫১০ (কক্ষ) নামক আজমির শরিফ এর সাথে, যেখানে সব মুশকিলে আসান, ইটের পরতে পরতে মহা শক্তির আশীর্বাদ, মোবাইলে চার্জ দিতেও তাই ছুটে আসে রোগীরা। সবাই যেখানে ভাইয়া, তাই পঞ্চাশোর্ধ কারো কারো উপর ভর করে হারকিউলিসের প্রেতাত্মা, কিন্তু কাঁধে আমার Y ক্রোমোসোমের দুঃসহ বোঝা, ৫১০ এর দুনিয়ায় যে তাই আমার ব্যক্তিত্যের প্রবল সংকট। সৃষ্টি হয় বিবর্তনের, আমি তখন অন্তর্মুখী থেকে অসামাজিক।
তবু থেমে থাকে নি আমার অপ্রিয় মানুষদের সুখী করার নিরন্তর প্রয়াস। ৩২ পাটি দাঁত খুলে দেখিয়েছি ঝক ঝকে পেপসোডেন্ট হাসি, কখনও “ঠাকুমার ঝুলি”-র মতো বানিয়েছি “উদ্ভ্রান্তের ঝুলি”। শুনিয়েছি তাদের কখনও “ডালিমকুমার”, কখনও “আলীবাবা ও চল্লিশ চোর”- এর কাহিনী। কখনওবা অন্তরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কল্পনা করেছি, আমার ওটি ড্রেস এর সবুজ ক্যাপটা যেন হয়ে ওঠে জুয়েল আইচ এর কালো হ্যাট সেখান থেকে বের করে আনতে পারতাম একজোড়া ধব ধবে সাদা কবুতর, দেখাতে পারতাম ৫১০ এর এক শ্রেণীর বাসিন্দাদের।
সকাল সাড়ে দশটা, “আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান”- না, সারজারীর রাউন্ড। আসলে ঠিক সেরকম ই। পাঁচ থেকে পনেরো তলা, নিখুঁত মুদ্রায় আমার বাটা জুতার সুশৃঙ্খল নৃত্য, কালো রং ধূসর হবার উপক্রম, আমার sweat gland এর প্রতিটা duct যেন একেকটা খরস্রোতা নদী। বেলা ১ টা, কল্পনায় আমার Septic OT র নাসরিন দিদির ক্রোধে ক্লান্ত রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখ আর মধুর বানী(?)। না না, ভুলে যেতে চাই।
সোমবার, OT Day, অন্ধের মতো আমার OPD নামক আলেয়ার পিছে ছুটে চলা, নোংরা শব্দ দূষণে বিস্মিত লিউ এর নির্বাক মানব মূর্তি, জাকিয়া আপুর ছল ছল চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ১৪ টা রুগী নিয়ে উদ্ভ্রান্ত সোনিয়ার নাভিঃশ্বাস, “ইউনিট-২ এর জন্য হ্যাঁ বলুন” মন্ত্রে দীক্ষিত তাজিন এর সব কিছুতেই সহজ স্বীকারোক্তি আর সরল সম্মতি, এ যেন ইউনিট-২ এর রঙ্গমঞ্চের নিত্য দৃশ্য। এরই ফাঁকে আমাবস্যার চাঁদ হয়ে উদিত হতেন তথাকথিত মহাদায়িত্ববান মানব। দানবীরের মতো আমাদের মাঝে দান করতেন তার দায়িত্বগুলো।
সামনে IM-6 নতুন ব্যাচ, অনেক কাজের লোক, বুঝছি বহুমূত্র নামক রোগটা আর সীমাবদ্ধ থাকবে না রোগীদের মাঝে। অনেক কষ্টের মাঝেও স্মৃতি হয়ে থাকুক জাফর স্যারের পিঠ চাপড়ে দেয়া, ইন্টার্নী হয়ে Spinal এর Case করার বিরল সুযোগ, “লি-তা-সো-হু-জা” র নিষ্পাপ বন্ধুত্ব, সেহেলি আপুর ভ্রাতৃস্নেহ, রিপন মামার শিশুতোষ বিনোদন, ফারিয়ার নিত্য শুভকামনা আর s p e c I a l l y প্রিয় বদি স্যার।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১২ সকাল ৮:৩৯