গত ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে
দেশের স্থানীয় সব নির্বাচন ব্যবস্থা দলীয়
ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বর্তমান
সরকার। সরকারের যুক্তি হলো এতদিনে
নির্দলীয় ব্যানারে রাজনৈতিক ছোঁয়ায় পরিচালিত
হয়ে আসছে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও
পরোক্ষভাবে সিটি কর্পোরেশন জেলা পরিষদ,
উপজেলা, পৌরসভা এমন কি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রার্থীর দলীয়
পরিচয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাই সরকারের
এখন থেকে নির্দলীয় নয়, দলীয় ভিত্তিতে
হতে হবে এ নির্বাচন হবে।
দেশের সব মানুষই জানে যে, বাংলাদেশের
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক
দলই দলীয় পরিচয়ে অংশ নিয়ে আসছে। দীর্ঘ
দিন থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শুরু
থেকে শেষ পর্যন্ত দলীয় প্রার্থীর দলীয়
পরিচয়ই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। শুধু তাই নয় ঘটা
করে দলের বৈঠক করে প্রার্থী মনোনয়ন,
কেউ নিজের ইচ্ছায় নির্বাচন করলে বসিয়ে
দেয়া, না বসতে চাইলে বহিষ্কার, কেন্দ্র
থেকে বিভিন্ন সারির নেতারা ছুটে গিয়ে
প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারনায় নেমে
নিজ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠ মাতানো- এসব
কিছুই কিন্তু হয়ে আসছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের পর এর পক্ষে-বিপক্ষে
নানা বিতর্ক থাকলেও দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয়
নির্বাচন দেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে
বলে মনে করছেন সিংহভাগ স্থানীয় সরকার
বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন
কমিশনার (সিইসি) এটিএম শামসুল হুদা, স্থানীয় সরকার
বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ , সাবেক
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত
হোসেন, জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল
আহসান কলিমুল্লাহসহ বিশেষজ্ঞদের অভিমত
হলো: দেশে অনেক দিন ধরেই নির্দলীয়
ব্যানারে দলীয় ছোঁয়ায় পরিচালিত হয়ে আসছে
স্থানীয় নির্বাচন। সরাসরি দলীয় ভিত্তিতে
স্থানীয় নির্বাচনের সরকারী সিদ্ধান্তের
মাধ্যমে এখন আইনগত ভিত্তি লাভ করেছে মাত্র।
বাকি সবকিছুই দলীয়ভাবে পরিচালিত হয়ে এসেছে
এতদিনে। নির্দলীয় বিধানে দেশে স্থানীয়
সরকারী নির্বাচন পরিচালনা হয়ে আসলেও
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন থেকেই
দলীয় ভিত্তিতেই এসব নির্বাচনের আয়োজন
হয়। উপমহাদেশে ভারত পাকিস্তানসহ প্রায় সব
দেশেই এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
তবে দীর্ঘদিন পরে হলেও দেশের দলীয়
ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন যুগান্তকারী
মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে
সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই
নয় ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ
বিশ্বের সিংহভাগ দেশেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন
দলীয়ভাবেই হয়ে থাকে। আমাদের
প্রতিবেশী ও বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ
ভারতে প্রায় সব রাজ্যেই দলীয় ভিত্তিতেই
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। পঞ্চায়েত
ব্যবস্থাকে ভারতের গ্রামীণ তৃণমূল পর্যায়ের
স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
সেই নির্বাচনও হয় দলীয় মনোনয়নেই। বিভিন্ন
তথ্য থেকে ভারতের স্থানীয় সরকার নির্বাচন
ব্যবস্থা সম্পকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭
সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে এ নির্বাচনী
ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হয়। সেই থেকেই
গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষেত্রে সূচিত হয় বিপ্লব।
১৯৭৩ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন সংশোধন করা হয়।
এই আইন অনুসারে ১৯৭৮ সালের জুন মাসে
পশ্চিমবঙ্গের নবগঠিত ত্রিস্তরের পঞ্চায়েত
ব্যবস্থায় প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতে এই প্রথমবার দলীয় প্রতীকের
ভিত্তিতে একই দিনে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে
নির্বাচন হয়। এর পর থেকেই এ ব্যবস্থা বিদ্যমান
রয়েছে। এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে
ইংল্যান্ড আমেরিকায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন
পরিচালিত হয়ে আসছে দলীয় ভিত্তিতে।
এখানের স্মরণ করা যেতে পারে যে, চলিত
বছর মহাধুমদামের সাথে হয়ে গেল, ঢাকা উত্তর,
দক্ষিণ ও চিটাগাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। উক্ত
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয়পাটি,
সিপিবিসহ বাংলাদেশের প্রায় সব দলই নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করে। জামায়াত প্রার্থী না দিয়ে বিএনপি
প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচারনা চালায়। সেই
নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রথম সারির
নেতারা এমনকি বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও দলীয়
প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে প্রচারনায় নেমে
নিজ হাতে লিফলেট বিতরণ করেন। এর আগে
২০১৩ সালে ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয় হয় খুলনা
রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন
নির্বাচন। বিধান অনুযায়ী এ নির্বাচন নির্দলীয়
হলেও ভোটারদের কাছে রাজনৈতিক দলীয়
পরিচয় মুখ্য ভূমিক পালন করেছে। প্রার্থী
মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত
সবই হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। এ নির্বাচনে
বিএনপি নেতৃত্বাধীন তখনকার ১৮ দলীয় জোট
ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে
আলাদাভাবে একক প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়।
দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে কোন
বিদ্রোহী প্রার্থীকে অংশ নিতে দেখা যায়নি।
এর বাইরে যারা এ চার সিটিতে মেয়র নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করেছিল রাজনৈতিক পরিচয় না থাকায়
ভোটের প্রাপ্তি ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়।
সে নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বিপুল ভোটে
নির্বাচিত হলেও সব সিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল
আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
এরপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হয় সারাদেশে উপজেলা
নির্বাচন। আইন অনুযায়ী এ নির্বাচনও ছিল নির্দলীয়
নির্বাচন। কিন্তু দুই জোটের পক্ষ থেকে প্রায়
সব উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান
পদে দলীয় সিদ্ধান্তেই প্রার্থী মনোনয়ন
দেয়া হয়। যদি এ নির্বাচনে দলে দলের বাইরে
অনেক প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। কিন্তু দলের
সমর্থন না থাকায় তারা জয়লাভ করতে পেরেছে
খুব কমই। এছাড়া ২০১১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ
নির্বাচনেও দলীয় ভিত্তিতেই চেয়ারম্যান ও
মেম্বার প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া
হয়েছে। ভোট হয়েছে নির্দলীয় বিধানে
দলীয় অংশগ্রহণেই। প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার
ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ই ওইসব নির্বাচনে মুখ্য
ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু মন্ত্রিসভায় এ প্রস্তাব অনুমোদনের পর
দেশের বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র
প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতার
বাইরে থাকা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে
অনড় থাকা বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির পক্ষ
থেকে ইতোমধ্যে দাবি করা হয়েছে সরকার এ
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নীলনক্সা
বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। আর বিএনপির তৃণমূল
থেকে শীর্ষ নেতারা যে কোন সভা-
সমাবেশেই বলে চলছেন দলীয়ভাবে
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থার
পেছনে সরকারের কু-মতলব আছে প্রচারনা
চালাচ্ছেন। আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
হান্নান শাহ তো জোর দিয়ে বলছেন,“ দলীয়
পরিচয়ে স্থানী সরকারের নির্বাচন আয়োজনে
শতভাগ বাকশাল কায়েমের চেষ্টা চলছে। বিএনপির
স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহএমন মন্তব্য
করেছেন এক দোয়া মাহফিলে অনুষ্ঠানে। তিনি
বলেন,“দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইউনিয়ন
পরিষদগুলো যদি দখল করে নিতে পারেন,
তাহলে তারা একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল একশত
ভাগ কায়েম করতে পারবেন। ” বিএনপি নেতাদের
এ ধরনের বল্লাহীন বক্তব্য তৃণমূলের বিএনপি
নেতারা মেনে নিতে পারছেন, তাদের
অনেকেরই আশঙ্কা, বিএনপি আবার ২০১৪ সালের
জাতীয় নির্বাচনের অংশগ্রহণ না করা ভুলের
পুনরাবৃত্তি করতে চলেছেন কি না।
দেশের সিংহভাগ মানুষই যখন দলীয় পরিচয়ে
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থাকে সাদরে
গ্রহণ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরেও জানা গেছে,
ইতমধ্যে বিএনপি তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইয়ে
নেমে পড়েছে, তা হলে বিএনপির এ ধরনের
নেতিবাচক প্রচারনার উদ্দেশ্য কী? এ বিষয়ে
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলীয় পরিচয়ে
স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে বিএনপি তথা
২০দলীয় জোটের অন্যতম মিত্র জামায়াত
নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না। কেননা,
দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক জামায়াতের
নিবন্ধন বাতিল ঘোষিত হয়েছে, যে কারণে ১৪
সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ করণ করতে
পারেনি। এবার ও নিবন্ধই ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা বলেই,
জামায়াতের পরামর্শে বিএনপি নেতারা এসব কথা
বলে আসছেন। এ কৌশলে জামায়াত ২০১৪ সালের
৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও বিএনপিকে নির্বাচনের
বাইরে রেখেছিল। যেহেতু আসন্ন স্থানীয়
সরকার পরিষদের নির্বাচনগুলোতেও জামায়াতের
অংশগ্রহণ সম্ভব নয়, তাই জামায়াতের পরামর্শেই
দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন
ব্যবস্থাকে বিতর্কীত করে রাখার জন্য বিএনপি
নেতারা এ নির্বাচন ববস্থায়, কু-মতলব, ষড়যন্ত্র ও
বাকশাল এর গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছেন। অথচ
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তলে তলে
প্রার্থী বাছাই কার্যক্রম ও শুরু করে দিয়েছেন
তারা। তবে সারা দেশে যেভাবে নির্বাচনী
জোয়ার শুরু হয়েছে, বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় না
হলে সেই জোয়ারে আবারো বিএনপি ভেসে
যাবে এ কথা বলতে কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার
প্রয়োজন নেই।
যাক, সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার
নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের সরকারী
প্রস্তাব অনুমোদন হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের
পক্ষ থেকেও এখন দলীয়ভাবে নির্বাচনের
প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তাই রাজনীতিবিদ,
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞসহ দেশের সচেতন
মানুষের ধারণা, দলীয় ভিত্তিতে সব স্থানীয়
সরকারের নির্বাচন হলে দেশের গণতন্ত্রের
ভিত মজবুত হবে। তৃণমূলের সাধারণ জনগণ
রাজনৈতিক ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন
হয়ে উঠবে। একই সাথে প্রায় সব মানুষই রাজনৈতিক
প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে আসবে। এতে তৃণমূল
থেকেই গড়ে ওঠবে দেশের নেতৃত্ব। কিন্তু
বিএনপি যদি সব কিছুতেই “না” এ নীতিতে অটল
থাকে তবে এবারও নির্বাচনী ট্রেন মিস করলে
এ দলটির শেষ পরিনতি কি হবে তা যারা বিএনপি
করেন তাদেরই ভেবে দেখতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩০