দেখতে দেখতেই কবিতার সাথে সংসার দুই বছর হয়ে গেল! ২০১২ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটা গল্পের সাথে ভাব জমানোর মাঝপথে কী মনে হল, কবিতার মত কিছু একটা লিখে ফেললাম! না আগে আমি কবিতা খুব একটা পড়তাম, না কখনও ভেবেছি লিখবো, তাই কয়েকলাইন লেখার পরে আমি নিজেই খুব বিভ্রান্ত! আমার তো কবিতা লেখার কথা না, সামনে কবিতা পড়লে পাশ কাটিয়ে আমি কোনো রহস্যোপন্যাসের গলিতেই সারাজীবন ঢুকে পড়েছি! আর যারা কবিতা লেখে তাদের মনে হত অন্য কিছু একটা, যা তাদের কবিতার মতই সহজে বোঝা যায় না! যাই হোক, একটা তো লিখেই ফেললাম, প্রথম কবিতাটা নিম্নরূপ-
ওহে নির্বোধ মানুষ!
তোমাকে কে বলল পৃথিবীটা তোমার একলার?
এই পৃথিবী সকলের, সমান ভাবে।
শালিক, উটপাখি আর ঘাসফুলের,
হাতি, কাকাতুয়া আর শাপলার,
কেঁচো, টিয়াপাখি আর কবিতার।
ছোট বেলায় যে মার্বেল পাথরটা
হারিয়ে, খুব কেঁদেছিলাম,
পৃথিবীটা সমানভাবে তারও।
বলতে পার,- ‘এটা কিন্তু খুব বেশি হয়ে গেল!
পাথরটা তো নিষ্প্রান,
ঈশ্বর তো ওতে কোন প্রান ফুঁকে দেন নি।’’
আমি তোমাকে আবারও বলব,-‘নির্বোধ’!
ঈশ্বর, শয়তান অথবা ঘুণপোকা,
বনিক, বনিতা অথবা সন্ন্যাসী,
মুক্তি, মৃত্যু অথবা দ্রোহ,
পৃথিবীটা সকলের, সমানভাবে।
আমি নিজে তখন কাউকে আশাপাশে চিনি না যে খুব কবিতা লেখে, ফলে এইটা কবিতা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করার উপায় রইলো না। দুই এক দিন পরে আবার! মানে কবিতা লিখে ফেললাম, প্রথমবারের থেকে বেশী অবাক হলাম, ভুল করে একটা কিছু অনেক কিছুই হয়, কিন্তু পরে হয় না, আমার কাছে প্রথম কবিতা লেখাটাও ওরকম কিছু ছিল। পরেরটা লেখার পরে বিভ্রান্তি বাড়ল। তারপর একটা দুইটা করে তারা আসতেই থাকলেন, একক্টা বিষয় ছিল যে ঐ সময়টাতে আমি এতটাই জীবনের উপর হতাশ আর ক্লান্ত ছিলাম, নিজের কথাগুলো কবিতার মত করে বলা ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল না। যাই হোক, বেশ কয়েকটা কবিতা লিখে ফেলার পরে আমি কাব্যভারাক্রান্ত হৃদয়ে সামুতে একটা হিসেব খুলে কবিতা জমা ও প্রকাশ শুরু করলাম। শুরু সময়ে আমার পোস্ট শুধু আমিই পড়তাম, সেই সময়টা বেশ লম্বা ছিল। নিজের কবিতার মান নিয়ে আমি যারপরনাই হতাশ, পোস্ট নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক, কেউ তো এসে পড়ুক, ভালো খারাপ পরে। কবিতায়ও নতুন, ব্লগেও নতুন, নতুন সংসারে নতুন খাট- আমিও লিখে চললাম। ততদিনে আমি কবিতা লেখার সময়টার যে জাদুময় ঘোর, ওইটার স্বাদ পেয়ে গিয়েছি, এ এক তুমুল নেশা, একবার ধরেছ তো মরেছ। আমিও মরে গেলাম।
আস্তে আস্তে কিন্তু পরিচয় শুরু হল, একজন একজন করে ব্লগার আসতে শুরু করলেন একদিন, জানালেন ভালো লাগার কথা, বেলুন হয়ে আকাশে উড়ে গেলাম, কী আনন্দ, আমার কবিতার কেউ প্রশংসাও করে! ব্লগ না থাকলে আমার এইভাবে কবিতা লেখা হত বলে আমার মনে হয় না। কয়েকটা লিখে ভুলে যেতাম। শুধু একটা পোস্ট দিতে ইচ্ছে করছে বলে কবিতা লিখতে বসেছি, ব্লগ না থাকলে এই ইন্সপিরেশন কই পেতাম?
মাত্র দুই বছরে কবিতা আমাকে যা দিয়েছে, সেইটা বলার মত ভাষা দেয় নাই! ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের সংসার আলো করে আসলো প্রথম বই, 'নস্টালজিক মেঘদল'! এই বইটাও আসতোনা, যদি সহব্লগাররা ওরকম অমানুষিক সহযোগিতা না করতেন। তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর সামর্থ আমার কখনো হবে বলে আমি মনে করি না। আমার অনেক শূন্য সময় কবিতার ঘোরে আমি বেঁচে উঠেছি, পাশে কিছু হাত পেয়েছি ভালোবাসার ও স্বপ্ন দেখার- এক কবিতার কাছে এতকিছু!
আমি আগে ভেবেছিলাম এই পোস্টে কবিতা নিয়ে বেশ কিছু গুরুগম্ভীর কথা বলার চেষ্টা করবো, কিন্তু সেইগুলো কিছুই মাথায় আসছে না, কারণ অনেক চিন্তা করে দেখলাম যে আমি আসলে কিছুই জানি না কাব্যতত্ত্বের, আমার কবিতা বিশুদ্ধ আধুনিক কবিতার মানদণ্ডে সমালোচকরা আদৌ কবিতা বলবেন কিনা, সেইটা আমি মনে করি খুব যৌক্তিক বিতর্ক। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমার কবিতার সাথে প্রণয়ের আনন্দ তাতে এক বিন্দু কমবে না! টেন্ডুলকার লর্ডসে সেঞ্চুরী হাঁকিয়ে যে আনন্দ পায়, আমি মনে করি পাড়ার মাঠে কিশোর এক সেঞ্চুরী করতে পারলে কম আনন্দ পাই না, আর ঐ আনন্দটুকুই তো কথা তাই না?
পোস্টের আকৃতি সাইবেরিয়ার দীর্ঘতম রেল লাইন ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই থেমে যাওয়া ভাল, যাত্রীরা সব নেমে পড়বেন তাহলে। গত কিছুদিনের দুই চার লাইন থেকে যা ছিল লেখা, সব তুলে দিলাম! আমার নানা সময়ে দুইই চার লাইন করে লেখা হয়, ঐগুলা কিছুদিন খাতায় পড়ে থাকলে কিছুদিন পর কলেবরে বিস্তৃত হয়ে পূর্নাংগ কবিতার আকার ধারণ করে, এখানে সমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত, অনিশ্চিত সব ধরণের লেখাই আছে!
***
আমায় মারতে কামান দাগো?
হাসছি বলে ভুল বুঝো না,
বকুল ফুলের ছেলে আমি
সোনালু বেচে ঘর বাঁধি না!
তোমায় আকুল অশ্রু বলে-
বৃষ্টি হলেই- ঝরে পড়ি না!
***
সমুদ্র যা নেয়, নাকি ফিরিয়ে দেয়!
সমুদ্র যা দেয়, তা কি ফিরিয়েও নেয়?
ওহে সমুদ্র, তবে কি নিঁখুত হিসেবেই তুমি এত বিশাল?
জেনে রেখ, তুমি আকাশ ছুঁতে পারবে না কোনোদিন!
***
জগতে মরুভূমি অপেক্ষা স্বাধীন আর কে আছে? না সে কোনো নদীর বাগদত্তা, না সে বাউন্ডুলে মেঘের প্রতীক্ষায় বসে থাকে। এমনকি সবুজাভ হিংস্র স্বভাবের অরণ্যের আগ্রাসন থেকেও সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। আহা, এ জগতে মরুভূমি অপেক্ষা সুখি আর কে আছে?!
***
উজান পালে
ঘর পালানো
সুতো কাটা সব ঘুড়ি
হয় যদি মেঘ- পরজনমে,
ঝর্ণা ঝিরি মাতাল জল
তোর চুল
রাধাচূড়া খোঁপায় ভুল
সে যদি অন্য কেউ
সাঁঝ নামানো চিলের ডানায়
নীল নির্বাণ
খুঁজছে কোথাও
আমায় তবু রাখিস ধরে
নাটাই বন্দী-
মেঘের নাও!
***
ছারপোকার ঠ্যাং গুনে
তুমি রাজা হতে পারলে,
প্রজাপতির রঙ মেখে-
আমিও কবি সাজতে জানি!
***
আমি যার,
সে আমার নয়!
যে আমার,
আমি তার নই!
কী এক আজব খেলা
তুমি খেললে সাঁই!
আমি ইফতি কাঁদছি পাড়ে
একলা একা- আকুল ঠাঁই!
***
তোর ঠোঁটের পেয়ালায়
হীরামন হেমলকের একটা চিরকূট পুড়ছিল
তোর চোখে ছিল শুকপাখি সরোবর,
অবরুদ্ধ জোছনার জল,
অনেকদিন কেউ কাঁদেনি বলে-
একটা বাঁশি খুব ঝরেছিল ঝরঝর!
***
কিছু দিন ছিল,- আচমকা উন্মাতাল,
ঝড়? নাকি ধ্বস! নাকি বান? নাকি নিয়তি!
কাকাতুয়া চোখে সাম্পান, চুরমার ঢেউ, ঝিলমিল গান!
কিছু দিন ছিল,- নদী হয়ে সমুদ্রে গড়িয়ে পড়ার তুমুল অভিযান!
নীল আকাশের নিচে হেঁটেছিলাম যারা- দিগন্তে আকাশ বিছিয়ে- জলের ধূ ধূ বিস্তার,
দূর্ধর্ষ চাঁদের বালিয়াড়িতে- বাসনা বিদ্ধ কবিয়াল শঙ্খ জোড়, বুকের মধ্যে বেহুলা সমুদ্র নীলাচল!
***
তোর চুলে নাক ডুবালেই মেঘ মেঘ,
তোর হাতে হাত ছোঁয়ালেই পাখি পাখি,
তোর চোখে চোখ রাখলেই শঙ্খচূড় অতল,
তোর ঠোঁটে ঠোঁটে ঘষলেই, আহা!- অমৃত মরণ!
***
ধুর ছাই! তোর জন্য শেষের কবিতাটা লিখতে গেলেই,
আমার আকাশ জুড়ে বেহুদা লোডশেডিঙ্গের অবরোধ,
তোর ছুঁয়ে দেওয়া বিদ্যুত স্মৃতি,
কালিমা থামিয়ে অন্ধ কলম ভাবে,
আর একবার ছুঁয়ে দিয়ে যা-
দেখ আলো হয়ে কেমন এক নক্ষত্র লিখি
***
আমি এক অলস দুপুর,
মুষলধারে রোদের তীর
আমি এক তপ্ত ছায়া
পিচমাখা পথ, দাবানল
বৃষ্টি উধাও, ঘামের ফোঁটা!
জারুলের মন ভালো নেই-
সোনালু কেন ফুটলো একা?
***
বেহুলা বাতাস
উড়ে যায় উড়ে যায়,
ভুলে যায়
ছেড়ে যায় সবকিছু,
শেষমেষ-
এমনকি কবিতাও!
***
তুমি জল ভালবাসবে বলে,
আমি হতে চেয়েছিলাম অনন্ত মরুভূমি,
তাহলেই যদি সেইদিন বুঝতে আমায়!
তাহলেই যদি একদিন খুঁজতে আমায়!
***
প্রেম এক ট্রেন
খোঁজ থাকে না
চাপা দিয়ে যায়
কখন কোথায়!
হয় চূর ছিন্ন
দেহ মন মুন্ডু
পাজরের হাঁপরে
দিনরাত ফাঁপরে!
প্রেম হয় রাস্তায়
সিনেমাতে সস্তায়
প্রেম ওড়ে বাতাসে
ঝামেলার রাজা সে!
প্রেম করা ভালো না
একা থাকা সয় না
ছ্যাঁকা খেলে পুড়ে যাই
তবু সব ভুলে যাই
তুমি এসে দাঁড়ালেই
ওপাশের দরজায়!
***
ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা
বিষন্ন ল্যাম্প পোস্টগুলো যদি জানতো
জলসাঘরের ঝারবাতিরও আছে
ঝলমলে কিছু দঃসহ দীর্ঘশ্বাস!
পাখোয়াজ নুপুর, কামনার মদিরায় চুমুক
পেয়ালায় হিমালয় অভিযান
তীক্ষ্ণ ভোজালী, চোখের তাপ।
মাতাল বুকে পুড়ছে গতজনমের বিষ
নাচছে, ঘুরছে নটরাজ নীল নিশি নক্ষত্র!
দেওয়ালে ভাসছে শীৎকার,
ভ্রান্তি হাহাকার!
এই রাতই যদি হত শেষ রাত
ফূর্তির বান
উল্লাস গান
জলসাঘরের ঝারবাতিদের জানা আছে
সূর্য ফুটলে-
ভঙ্গুর, কাঁচ বিদ্ধ
পবিত্র কাম!
***
ইট-কাঠ-কঙ্ক্রিট-বালু-ছাই
ঘাম-পাপ-তাপ-লোভ আশ্রয়
প্রেম-কাম-মায়া-ছায়া-ছাদ
জমানো-ফোপানো শ্বাস, কাচের প্রাসাদ!
বিস্তার তাই বিনাশ
মৃত্যু, ছিল জন্ম
মৃত্তিকা ছোয় না আকাশ!
কাশঘুম, কখনও আনমনা বিষাদ
হয়তোবা মরিচীকা সরোবর
সময়ের করিকাঠ ক্ষয়ে
ইমারতে বাসা বাঁধে শেষমেশ
শতাব্দীর অবোধ্য কিছু
অদ্ভূত বিস্ময়!
***
একটি দেয়াশলাই কাঠির কাছ থেকে
অশ্রু প্রত্যাশা করলে ঠকবে তুমি
আমার মেঘেরা বিকিয়ে গেছে-
বারুদের বিনিময়ে!
সভ্যতায় সফল, সে ছিল অন্য কেউ
বাসনায় বিনীত, সে ছিল গত জনমের ভুল!
সব রাখালের বাশি না থাকলেও
বাকানো চোখা কিছু শিং থাকে ঠিক!
সব নদীকেই তার সমুদ্রকে পেতে,
পেছনে ফেলে আসতে হয় পর্বত, স্মৃতির!
কিন্তু আমার বেলাতে জানতে হল-
সব তারা খসলেই ইচ্ছে পূরণ হয় না!
অথচ সব জনমেরই- মৃত্যু হয় ঠিক!
***
এখনই তো সময় কবিতা লিখবার
দাবানল লাগলে
সবুজ পাতাগুলো যেমন
পুড়তে থাকে আততায়ী উল্লাসে
এখনই সময় জ্বলে উঠবার
অদৃশ্য আগুন, যখন পোড়ায় দিক্বিদিক
পথগুলো সব চেনা হয়ে গেল-
এই সব অকাল দুঃখে
যে কিশোরী পথটা
থেমে গিয়েছিল অভিমানে
দীঘির জলে জোনাকীরা
ঝাড়বাতি হয়ে ঘুম ভাঙ্গাবে-
সেইসব জলজ মাছরাঙাদের!
***
একাকার অলীক আলোয়
মাখামাখি অলৌকিক তুমি
বিষাদের জমজ সহোদরা
ধুলো মাখা চৌকাঠে
মখমল রোদ, নাকফুল
চিবুকে স্ফটিক উদ্ভাস!
***
একদিন হাঁটতে হাঁটতে
চলে যাব অনেক দূর
আমাকে হেঁটেই যেতে হবে
কাউকে তো অপেক্ষায় রাখিনি
তাই ট্রেন বাস উড়োজাহাজ সবই বাহুল্য
আমার কোনো-
ভাড়া নেই
তাড়া নেই,
গন্তব্য নেই
আমাকে শুধু তাই যেতে হবে-
কোথাও না, শুধু আমি হতে অনেক দূরে
আমাকে হেঁটেই যেতে হবে, সেটাই ভাল
তাহলে আমি খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে
মুখ থুবড়ে মুক্তি পাব
জীবন মাড়িয়ে
জীবনের পথ
আর কত?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৪ রাত ১২:০৭