ছোট্ট জোনাকীর ঘুমিয়ে পড়ার কথা সাড়ে দশটার মধ্যে। কিন্তু আজকে ও ঘুমাবে না, জেগে থাকবে অনেক রাত- সেই রাত বারোটা পর্যন্ত। তোমরা জিজ্ঞেস করতে পারো কী কারনে ছোট্ট জোনাকী অত রাত জেগে বসে থাকবে, উত্তর হচ্ছে কাল ২৬ শে মার্চ- ওর জন্মদিন। ওর বাবা কেক নিয়ে আসবেন, মাঝরাতে মোমবাতি জ্বেলে কেক কাঁটা হবে, তারপরেই না ঘুম! উনি দুপুরে কথা দিয়ে গেছেন মেয়েকে যে আজ রাতে অবশ্যই তাড়াতাড়ি ফিরবেন, মোমবাতি কিনে দিয়ে গেছেন নয়টা। জোনাকী অপেক্ষা করছে ওর বাবার জন্য রাত জেগে, কিন্তু জোনাকী তখনও জানে না তার বাবা আর ফিরবেন না, এই জনপদে নেমে এসেছিল এক অদ্ভূত আঁধার, রাত্রির থেকেও নিকষ অন্ধকার, মৃত্যুর থেকেও হিমশীতল, নরকের থেকেও নারকীয়- রাতটা ছিল পঁচিশে মার্চ, সালটা ছিল ১৯৭১! জোনাকীর মত অনেক দেবশিশু আর কোনোদিন বাবাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে নি, অসংখ্য মা আর কখনো তাঁদের সূর্যতরুণ সন্তানদের মুখে তুলে দিতে পারেন নি আদরের লোকমা, ইতিহাসের জঘন্যতম এক অমানুষিক বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দিপড়া শুয়োরের দল, বিশ্বের অন্যতম সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর তকমাধারী নরপশুর দল আধুনিক মারণাস্ত্র হেনে নির্বিচার হত্যা করেছিল অজস্র অগুনতি মানুষ, নিরীহ সবুজ মানুষেরা রক্তের সমুদ্রে ভেসে জাগিয়েছিল লাল-সবুজ এক মায়াবী ভূখন্ডের স্বপ্ন!
আমাদের দোষ কী ছিল? আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিলাম-সেইটা আমাদের দোষ ছিল? আমরা আমাদের ভাইয়ের অকারণ রক্তপাতের বিচার চেয়েছিলাম, সেইটা আমাদের অন্যায় ছিল? আমরা সমতার কথা বলেছিলাম, ন্যায়সঙ্গত অধিকারের কথা বলেছিলাম, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলাম- সেইটাই বুঝি আমাদের খুব পাপ ছিল?- যে সারাদিন জোয়াল টেনে ক্লান্ত ঘুমন্ত রিকশাওয়ালাটাকে মেরে ফেলতে হয়েছিল তর্জনীর এক ট্রিগার টেনে? বারুদ আর পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিলে বস্তির পর বস্তি, এই ভূখন্ডের পবিত্র জ্ঞানপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়লে রিকয়েল্লেস রাইফেলে মৃত্যু সাজিয়ে, শোবার ঘরে ঢুকে অকরুণ হত্যা করলে স্বপ্নবান শিক্ষকদের, হলে হলে ঢুকে টেনে হিচড়ে লাইন দিয়ে দাঁড় করালে জাতির মেধাবী সন্তানদের, ওদেরকে দিয়েই কবর খুঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে খুন করে কবর দিলে কাতারে কাতারে, রোকেয়া হল থেকে তুলে নিয়ে মেয়েদের লালসায় পুড়িয়ে জীবন্ত কয়লা বানাবে বলে, ওহে পাকিস্তানি মরু শেয়ালের দল, খুব জানতে ইচ্ছে করে, কোন মা তোমাদের জন্ম দিয়েছিল?
অপারেশন সার্চ লাইটের নামে শুরু করলে যে রক্ত বন্যা, বাংলার কত শত নদী এতো যুগ ধরেও মুছতে পারলো না সেই রক্তের দাগ, এখনও এই জনপদের হৃদয়ে হৃদয়ে বয়ে চলেছে ভাই হারানো শোকের এক অশ্রুনদী, কেন ছিল এই অকারণ রক্তপাত? ইতিহাসের কাছে তোমাদের জবাব আছে কী?
এক অন্যায্য বর্বর যুদ্ধ আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার সাক্ষী ২৫ শে মার্চের কালোরাত। ১৯৭০ এর সমগ্র পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তোমাদের রচিত সংবিধান মতেই, সমগ্র পাকিস্তানের আপমর মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্যান্ডেটেই শেখ মুজিবুর রহমানের হওয়ার কথা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তুমি ইয়াহিয়া খান, এক অসভ্য মাতাল, তোমার পশ্চিমা শেয়াল বন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টর সাথে ফন্দি আঁটলে বাঙ্গালিকে মানুষের অধিকার দেবে না, ভেবেছিলে মেরেকেটেই সাফ করে ফেলবে সব অসহ্য জঞ্জাল! হা হা, এখন ভাবলে হাসি পায়, বাঘের লেজে কান চুলকানোর শখ হয়েছিল খুব পাঞ্জাবী কুকুরের! অগ্নিঝরা মার্চে যখন একটা জাতি স্বাধিকারের সতত স্বপ্নে টগবগ ফুটছে, আলোচনার নামে দিনের পর দিন নাটক করেছ শঠতার! আচ্ছা, ঐ মিটিং গুলোতে শেখ মুজিবের চোখে চোখ রেখে তোমরা একটা কোথাও বলতে পেরেছিলে? একটা যুক্তি, একটা ন্যায্য দাবিও কি তোমরা তুলতে পেরেছিলে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার?
আমরা কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত শান্তি চেয়েছিলাম, আলোচনার মাধ্যমে ফয়সালা চেয়েছিলাম, তাই তোমরা জাহাজে ভরে অস্ত্র নিয়ে আসলেও আমরা আমাদের অস্ত্র তাক করিনি, আমরা তোমাদেরকে শেষ পর্যন্ত মানুষের মর্যাদায়, ভাইয়ের আতিথেয়তায় বৈঠক চালিয়েছি। কিন্তু তোমরা যে মানুষের জাতের কলঙ্ক হবে, তা প্রমান করবার জন্য আমাদের এই বিশ্বাসের মূল্য দিয়েছিলে বন্দুকের নল দিয়ে, ইঁদুরের মত পালিয়ে গিয়েছিলে তুমি ইয়াহিয়া খান! যখন তোমার ছিটানো বারুদে দাউ দাউ পুড়ছিল আমার স্বদেশ।
অথচ পরিকল্পনা ছিল সেই ২২ শে ফেব্রুয়ারি থেকে, ১৭ই মার্চ এসে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি খান ৫ পৃষ্ঠার এক হত্যাযজ্ঞের নকশা প্রনয়ন করে- ‘অপারেশন সার্চলাইট’, সোজা বাংলায় ‘চল নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করি’! ইতিহাস সাক্ষী, তোমরা ছিলে ঠান্ডা মাথার খুনী, নরকের আগুনে যখন দাউ দাউ করে পুড়ছিল ঢাকা, যা ছিল তোমাদেরই নিজ দেশের শহর, পুড়ছিল তোমাদের স্বপ্নের পাকিস্তানের মানুষেরা, তুমি জুলিফিকার আলি ভুট্টো, অক্সফোর্ড ফেরত জ্ঞানপাপী শেয়াল, তুমি প্রমান করেছিলে পৃথিবীর কোনো বিদ্যাপিঠ তোমাকে মানুষ করতে পারত না! হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল এর ছাদে দাঁড়িয়ে তুমি দেখেছিলে তোমাদের লেলানো বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানের হত্যাযজ্ঞের উল্লাস, তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলেছিলে- ‘Thanks to God that Pakistan could have been saved’!
২৫ শে মার্চ রাত ১১ টা তিরিশ মিনিটে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসলো ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট, ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা। যাদের রক্ত ঘাম করা করের টাকায় কেনা অস্ত্র, যাদের রক্ষা করার জন্য এতসব পোষা সেনাদল, তাদেরই উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাইফেল, মর্টার, ট্যাঙ্কসহ হালকা ভারী সমস্ত অস্ত্রপাতি নিয়ে। বীর পুঙ্গবের দল অতর্কিতে হত্যা করবে নগরের ঘুমন্ত সব মানুষ! ঢাকা এক্সপিডিশনের অন্যতম লক্ষ দ্রুততম সময়ে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বন্দী ও হত্যা করা; রেডিও, টিভি, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সহ যাবতীয় যোগাযোগ মাধ্যম ও সংস্থা দখল করে গুড়িয়ে দেওয়া; রাজারবাগ, পিলখানায় অবস্থানরত ইপিয়ার আর পুলিশ সদস্যাদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা; পিপড়ার মত মানুষ হত্যা করে বাঙ্গালীর আত্মায় আতঙ্কের কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া- যেন স্বাধীনতা পিয়াসী এই বেয়াদপ জাতি আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে তার মুক্তির দাবী জানাতে না পারে। রাতের আঁধারে গ্রেপ্তার করলে তোমরা জাতির জনককে, দিনের আলোয় তাঁর সামনে দাঁড়ানোর মত বুকের পাটা তোমাদের ছিল না!
পেরেছিলে তোমরা? পেরেছিলে যে সুর্য উদিত হবে বলে জিদ ধরেছে, তোমাদের অন্ধকারের অত শক্তি ছিল তাকে আটকাবার? মুক্তির উন্মাদনায় জেগেছিল যে জাতি, তোমাদের বুলেটের কি ক্ষমতা ছিল তাকে রুদ্ধ করার? কেউ কখনো পেরেছে? তোমরাও পারনি। সেই রাতে কোনো নির্দেশের অপেক্ষা না করেই সাধারণ মানুষ রাস্তায় রাস্তায় বিছিয়েছিল ব্যারিকেড; রাজারবাগ, পিলখানায় বাঙ্গালি জওয়ান আর পুলিশ ভাইয়েরা গড়ে তুলেছিল অদম্য প্রতিরোধ। আমরা যুদ্ধ চাই নি, আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম! কিন্তু তোমরা যখন আমাদের পিষে মারার সিদ্ধান্ত নিলে ঠান্ডা মাথায় হিসেব কষে, হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া এই শ্যামল বাংলার কিষান- কিষাণীদের আর কী করার ছিল? গ্রেপ্তার হবেন জেনে আগ মুহুর্তে জাতির পিতা দিয়ে যান স্বাধীনতার ডাক, যা পরে চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষিত হয় ২৬ তারিখ, একই ফলশ্রুতিতে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ তারিখ বঙ্ঘবদ্ধুর পক্ষ থেকে ঘোষনা দেন- This is the Free Bengal Radio Station. I, Major Ziaur Rahman, at the direction of our great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction , In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalees to rise up against the attack of the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our motherland. Victory is, by the Grace of Allah, ours. Joy Bangla!
ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা আসে না, মুখের কথায় মুক্তি আসে নি। রক্ত ঝরিয়েই স্বাধীনতা আসে, অশ্রু ঝরিয়েই কিনতে হয় মুক্তির আরাধ্য পতাকা। ইতিহাস সাক্ষী- বড় চড়া দামে কেনা আমাদের স্বদেশের মানচিত্র। এর প্রতি ইঞ্চিতে মিশে আছে শহীদের রক্ত, বাংলার সবুজ মাটিতে এক সমুদ্র রক্ত ঝরিয়েই আমরা পেয়েছি আমাদের গর্বের লাল সবুজের পরিচয়। আজ ২৫ শে মার্চের কালো রাত, সূর্যের বিরতিহীন আবর্তনে আমাদের এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সেই রাতের শোকজাগানিয়া প্রহরের সামনে। আজ এই জনপদের প্রতিটা জানলা খোলা থাকবে সারারাত, আজ এই বাংলার বাতাসে বাতাসে গুমরে ফিরবে সেই অনির্বাণ আকুতি- ওরা আসবে চুপি চুপি,সব ক’টা জানালা খুলে দাও না!
******************************************************************
আজকের লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে, ব্লগার ইফতির ছাপার অক্ষরে প্রথম আত্মপ্রকাশ বলা যেতে পারে!
Click This Link
আমার একটানে রাতজাগা এলোমেলো আবেগী লেখাটা জানা আপু আর শরৎ দা চমৎকার সম্পাদনা করে দিয়েছেন পত্রিকার জন্য! জানা আপুকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমাকে দিয়ে লেখাটা লিখিয়ে নেওয়ার জন্য, উনার উৎসাহ-তাড়া না থাকলে ২৫ মার্চ নিয়ে অনেকক্ষণ ডুবে থাকার, নিজের ইতিহাসকে কিঞ্চিত জানার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতাম নিশ্চিত! প্রথম ছবিটা ব্লগার কাল্পনিক ভালোবাসার করা, বাকি ছবি সব গুগল করে পাওয়া। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে সব ছবির যথাযথ কোনো ক্রেডিট লাইন বা কৃতজ্ঞতা স্বীকারের মধ্যে না গিয়েই আমি ছবি গুলো পোস্টে নিয়ে আসলাম, অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছি- স্বদেশের এই সব রক্তমাখা ছবি তো সবার!