আজকে আমাদের ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের গেট টুগেদার পার্টি। শুধু আমাদের ব্যাচ। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পাঁচ বছর হয়ে গেছে। অনেকের সাথে যোগাযোগ নেই। অনেকে ফেইসবুকে আছে, হাই হ্যালো হয়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে যোগাযোগ নেই। পোলাপান বড় বড় চাকরি করে, স্ট্যাটাস চেইঞ্জ করে, ভ্যাকেশনের ছবি দেয় – মালয়শিয়া, ব্যাংকক। দেখে অশান্তি লাগে। আমি ওদের সাথেই পড়তাম, ভাল রেজাল্ট করেই ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু কি করে জানি ওরা অনেক এগিয়ে গেছে। আমি শালার সেই আগের জায়গায়ই আটকে আছি। চাকরি একটা করছি, খেয়ে পরে বাচার মত টাকা রোজগার করি। এমনিতে আমি ভালই আছি। কিন্তু নতুন রেস্টুরেন্ট খুল্লেই দৌড় দিয়ে গিয়ে ডিনার করতে পারি না, ছবি আপলোড দিতে পারি না, “ডিনার এট অমুক রেস্টুরেন্ট, ইয়াম্মি ফুড” বলে। কিংবা বোনাসের টাকা দিয়ে ব্যাংকক বেড়াতে গিয়ে ছবি দিতে পারি না “জেট স্কিইং ইন পাতায়া” বলে।
আমি এখনও আশির দশকেই আছি – ওই যে আব্বা ঈদের বোনাস পেলে ঈদের বাজার হবে – ওই টাইপ। এমনিতে আমি ভালই আছি। কিন্তু যখন দেখি সারা জীবন আমার খাতা দেখে পরীক্ষা দেয়া ছেলে ইউরোপে পিএইচডি করতে যাচ্ছে, তখন মনটা খচ খচ করে। হারামজাদা আবার স্নোয়ের মধ্যে ছবি দেয়। আরে বেটা তুই পড়া শোনা করতে গেছিস, নাকি ফটো সেশন করতে! অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে মোবাইল চেক করে মাঝে মাঝে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। ভার্সিটিতে সবচেয়ে বেশি ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ছেলেটা মাঝে মাঝেই লাঞ্চের সময় ছবি দেয়, “হ্যাভিং লাঞ্চ উইথ ক্লায়েন্ট এট শেরাটন” টাইপের। তখন মনে হয় কি লাভ হলো ছয় বছর মনযোগ গিয়ে পড়াশোনা করে। একজন তো আবার আমাদের আমাদের ডিপার্টমেন্টেই জয়েন করেছে, এখন এসিটেন্ট প্রফেসর। তার বাপের টাকা ছিল। একটা গাড়ি ছিল তার নিজের। ফোর্থ ইয়ারে আমার ধারণা ছিল ওই গাড়িটা মজিদ স্যার ওর কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। স্যারকেই সবসময় ওই গাড়ি চালাতে দেখতাম। ওই ছেলে কয়দিন আগে দেখলাম স্ট্যাটাস দিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ, মাই পেপার হ্যাজ বিন এক্সেপ্টেড ইন রিনউনড অমুক জার্নাল। তোর জার্নাল এর খেতা পুড়ি। তোর ওই পেপার দিয়ে তুই ছাড়া আর কার কোন উপকারটা হবে? আর তুই তো ব্যাটা কো-অথর, তাহলে মাই পেপার বললি কোন বিবেচনায়, বলবি আওয়ার পেপার। না, আমি রাগছি না। এমনিতে আমি ভালই আছি।
এটা ঠিক, আমি বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে শাহরুখ খানের নতুন সিনেমা দেখতে গিয়ে “ওয়াচিং গুর্দাওয়ালে এট বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স উইথ মাই লাভলি ওয়াইফ” স্ট্যাটাস দিতে পারি না। আরে ব্যাট্টা, বউএর সাথে সিনেমা দেখতে যাবি, সেটাই তো স্বাভাবিক, এটা চিৎকার দিয়ে সবাইকে বলার কি আছে। বউ ফেলে শালির সাথে সিনেমা দেখতে গেলে সেটা অস্বাভাবিক হত, সেটা করলে তো কাক পক্ষীও টের পাবে না। প্রায়ই দেখি আমাদের ক্লাসের ডাকসাইটে সুন্দরি বরের গলা ধরে ঝুলে ফেইসবুকে ছবি দেয়। তার বর বেশ বড় একটা চাকরি করে। পজিশনের জোরে বউকেও একটা চাকরি পাইয়ে দিয়েছে। মেয়ের ভাব দেখে মনে হয় তার চাকরি হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একান্ত সচিবের চাকরি। পৃথিবীর অর্থনীতি তার উপরেই নির্ভর করে। ফেইসবুক খুল্লেই তার মিটিং-এর স্ট্যাটাস দেখতে দেখতে ভাবি, তাহলে কাজ করে কখন। বরের গলায় ঝুলে যখন ছবি তোলে, তখন কি সে জানে তার বর আরেক মেয়েকে নিয়ে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে যায়? হয়ত জানে, সবাই তো আর আমার মত আশির দশকে পড়ে নেই।
তবুও আমি ভালই আছি। অফিস থেকে ফিরে আমি টিভি দেখি, তারপর প্লেটে আঙ্গুল ডুবিয়ে ডাল ভাত খেয়ে শুতে যাই। ঘুম আসার আগে শেষবার ফেইসবুক খুলি, দেখি যে মেয়েটা নোটের জন্য সবসময় ঘুরঘুর করত, সে স্ট্যাটাস দিয়েছে। অনেক যত্ন করে নোট লিখতাম, আমি জানতাম ও নোট নিতে আসবে। তাই কাটাকুটি ভরা নোট থেকে পরিষ্কার করে গুছিয়ে নোট করে রাখতাম। চাইলেই কপি করে রাখতে পারতাম, কিন্তু তাহলে ও দ্বিতীয়বার নোট ফেরত দিতে আসত না। সে স্ট্যাটাস দিয়েছে, তার হাজবেন্ড অস্ট্রেলিয়াতে বাড়ি কিনেছে। চোখের ঘুমটা কেটে যায়। ভালই হয়েছে ওর জন্য। আমিও তো ভালই আছি। ঘুমটাই শুধু আসছে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:৩১