বাঙ্গালী জাতিগত ভাবেই রোমান্টিসিজম এর ভক্ত। রিয়ালিটি না চিন্তা করে যে কোন কিছুকে রোমান্টাসাইজ করতে আমরা উস্তাদ। রোমান্টিসাইজ ব্যাপারটা একটু এক্সপ্লেইন না করলে সবাই প্রেম ভালবাসা বিষয়ক কথা মনে করবে। মিরিয়াম-ওয়েবস্টারে রোমান্টিসাইজ এর সংজ্ঞা হচ্ছেঃ “ to think about or describe something as being better or more attractive or interesting than it really is”। যে কোন ব্যাপার বা কারেক্টারকে বাস্তবতার চেয়ে বড় করে দেখা, উন্নত হিসাবে দেখা, মহান হিসাবে দেখা।
আমার মনে আছে সাদ্দাম হুসেইন যখন কুয়েত আক্রমণ করল এবং এর পরে প্রথম গালফ ওয়ার হলো, বুশ ইরাকে আক্রমণ করল, তখন আমাদের দেশে সাদ্দাম হুসেইনকে নিয়ে একটা ক্রেইজ শুরু হয়েছিল। বড় সাইজের যেকোন কিছুকেই ‘সাদ্দাম’ নাম দিয়ে বিক্রি করা শুরু হলো। বাটারবনের প্রতি আমার খুব লোভ ছিল। পরিষ্কার মনে আছে একটা দোকানে বড় সাইজের বাটারবন এর নাম সাদ্দামবন, তার দাম একটু বেশি। পত্রপত্রিকাও সাদ্দামকে মহান দেখাবার সুযোগ ছাড়ল না, কারণ পাব্লিক সাদ্দামকে মহান দেখতে চায়। বীর সাদ্দাম হুসেইন যে একসময় সি আই এ এজেন্ট ছিল, তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টকে হত্যা চেষ্টায় সে সরাসরি জড়িত ছিল, হাজার হাজার কুর্দ ও শিয়াদের হত্যা করেছিল, তার বিরোধি যে কারোকে সে কি নৃশংসভাবে হত্যা করত, সে সব আমরা খেয়াল করিনি। আমেরিকা যখন আফগানিস্তান আক্রমণ করতে এল, তখন প্রথম আলোর একটা হেডলাইন ছিল ‘অজেয় আফগান’। তাদের পরিবেশিত তথ্য সত্যি ছিল, কিন্তু ‘অজেয় আফগান’ হেডলাইন দিয়ে কিন্তু তখন আফগানিস্তানকে রোমান্টিসাইজই করা হয়েছে। আফগানিস্তান, যাকে জয় করা যায় না।
একই ধরনের রোমান্টিসিজম কাজ করে চে গুয়েভারার ক্ষেত্রে। আমরা চে গুয়েভারাকে এক মহান বিপ্লবি হিসাবে দেখতে পছন্দ করি। চে কম্যুনিজমের পক্ষে যুদ্ধ করেছে সত্যি, কিন্তু তার জীবন দেখলে দেখা যায় সে ছিল অত্যন্ত নোংরা এবং সে অনর্থক খুন করতে পছন্দ করত। তার নোংরা থাকার অভ্যাসের জন্য তাকে তার সাথীরা ‘পিগ’ বলে ডাকত।
এই জাতিগত রোমান্টিসিজম এর উল্টোটাও আমাদের মধ্যে প্রবল। উপরের উদাহরণ গুলোর কথাই ধরা যাক, যারা এই লেখাটি পড়ছে, তাদের মধ্যে একদল মনে মনে সাদ্দামের পক্ষে যুক্তি খাড়া করছেন, কিন্তু চে’র কথা পড়ে মনে মনে খুশি হচ্ছেন। আরেকদল উল্টোটা করছেন, সাদ্দামের কথা পড়ে খুশি হচ্ছেন, আর চে’র পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন। আমরা যাদেরকে পছন্দ করি না, তাদের ভাল গুনগুলোও আমরা এড়িয়ে যাই। কিন্তু মানুষ মাত্রই ভাল মন্দের সমষ্টি। সবচেয়ে খারাপ লোকের মাঝেও কিছু ভাল থাকবে, সবচেয়ে ভাল লোকের মাঝেও কিছু খারাপ থাকবে। আমজনতা এই পার্থক্য করতে পারবে না, কিন্তু শিক্ষিত চিন্তাশীল লোক যখন কোন কিছুর না কারো খারাপটা না দেখে সেটাকে বা তাকে রোমান্টিসাইজ করতে শুরু করে, এর পরিণাম ভয়াবহ না হয়ে উপায় থাকে না। ইদানিংকালের কান্ড কারখানা দেখে সেই ভয়াবহ পরিণামের দিকে আমাদের অগ্রযাত্রা দেখে আঁতকে উঠা ছাড়া উপায় নেই। তার লেটেস্ট উদাহরণ হচ্ছে ঢাকার জংগী হামলা। এই হামলার একটা কারণই কিন্তু এই রোমান্টিসিজম- নেগেটিভ রোমান্টিসিজম। আইসিসের মত জগন্য জানোয়ারদের কাজকে সঠিক মনে করা, তাদের কাজের মাধ্যমে ইসলামের সেবা করা হচ্ছে বলে মনে করা।
কয়েকটা ব্যাপার আমাদের ক্লিয়ার থাকা দরকার। যারা নিহত হয়েছে, তাদের এভাবে নিহত হওয়া কোনভাবেই উচিত হয়নি। তারা দেশি না বিদেশি, ধনী না গরিব, তারা কোন ধর্মের- এই সব প্রশ্নই অবান্তর। তারা মানুষ ছিল, নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আর যারা আক্রমণকারী, তারা হত্যাকারী সন্ত্রাসী। তারা কোন ফ্যামিলির, কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছে, কেমন করে তারা সন্ত্রাসী হলো, এসব প্রশ্নও অবান্তর। তারা পরিবারের অবহেলায় সন্ত্রাসী হলেও তাদের অপরাধ কমে যায় না।
আর কেউ কেউ ইসলামের উপর দোষ চাপাতে চেষ্টা করছেন, আবার কেউ কেউ ইসলামকে বাচাতে চেষ্টা করছেন। এব্যাপারেও আমাদের ক্লিয়ার থাকা দরকার। আগেই যেমন বলেছি, অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত লোকজন রিয়ালিটি না জেনে কোন কিছুকে বাস্তবতার চেয়ে বড় অথবা ছোট করে দেখে। কিন্তু শিক্ষিত লোক, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার জানার কথা, কোন ধর্মই সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয় না। আমেরিকায় ব্ল্যাক চার্চে গুলি করে হত্যা করা লোকটি ক্রিশ্চানিজমের প্রতিনিধিত্ব করে না, ভারতে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মুসলমান হত্যাকারিরা হিন্দুইজম এর প্রতিনিধিত্ব করে না, একইভাবে ঢাকার হত্যাকারীরাও ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না। যারা জেনেশুনে ইসলামের উপর দোষ চাপাতে চাইছে, তাদেরকে তো কেউ বোঝাতে পারবে না। আর যাদের শিক্ষা তাদেরকে এটা শেখাতে পারেনি যে ধর্ম পালনকারীর দোষ ধর্মের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না, তাদেরকেও কেউ বোঝাতে পারবে না।
আমরা হয়ত একশ ভাগ সত্যটা জানতে পারব না, কিন্তু বেসিক ব্যাপারগুলো নিয়ে যদি আমাদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ থাকে, তাহলে আমাদের শিক্ষা আসলেই বিফলে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৪৫