দানশীলতা বিষয়ে আমরা কম বেশি সবাই জানি, বেশি করে দান করা উচিত, গোপনে দান করা উচিত, যারা অবস্থা খারাপ হওয়ার পরও দান নিতে চায় না, তাদেরকে বেশি করে দান করা উচিত – ইত্যাদি। তবে আমরা অনেকেই দান করাকে আল্লাহপাক কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটা খেয়াল করি না। এমন অনেক কাজকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দেই যার কথা কুরআনে একবারো সরাসরি আসে নি, কিন্তু যেসব কথা আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’লা সরাসরি কুরআনে বার বার উল্লেখ করেছেন, অনেক সময় আমরা সেগুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে ভুলে যাই। দানশীলতা এমনই একটি কাজ। আল্লাহ কুরআনে বার বার দান করার কথা বলেছেন। সূরা বাকারার ২৬১ থেকে পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ অত্যন্ত পরিষ্কার ও সুন্দর করে দানশীলতার কথা বর্ণনা করেছেনঃ
[2:261]
যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।
[2:262]
যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, এরপর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদেরই জন্যে তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোন আশংকা নেই, তারা চিন্তিতও হবে না।
[2:263]
নম্র কথা বলে দেয়া এবং ক্ষমা প্রদর্শন করা ঐ দান খয়রাত অপেক্ষা উত্তম, যার পরে কষ্ট দেয়া হয়। আল্লাহ তা’আলা সম্পদশালী, সহিঞ্চু।
[2:264]
হে ঈমানদারগণ!তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যাক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ঐ বস্তুর কোন সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।
[2:265]
যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্যে তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মত, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হাল্কা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।
[2:266]
তোমাদের কেউ পছন্দ করে যে, তার একটি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান হবে, এর তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে, আর এতে সর্বপ্রকার ফল-ফসল থাকবে এবং সে বার্ধক্যে পৌছবে, তার দুর্বল সন্তান সন্ততিও থাকবে, এমতাবস্থায় এ বাগানের একটি ঘূর্ণিবায়ু আসবে, যাতে আগুন রয়েছে, অনন্তর বাগানটি ভষ্মীভূত হয়ে যাবে? এমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে নিদর্শনসমূহ বর্ননা করেন-যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর।
[2:267]
হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করো না। কেননা, তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাব মুক্ত, প্রশংসিত।
[2:268]
শয়তান তোমাদেরকে অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশী অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।
[2:269]
তিনি যাকে ইচ্ছা বিশেষ জ্ঞান দান করেন এবং যাকে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়, সে প্রভুত কল্যাণকর বস্তু প্রাপ্ত হয়। উপদেশ তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানবান।
[2:270]
তোমরা যে খয়রাত বা সদ্ব্যয় কর কিংবা কোন মানত কর, আল্লাহ নিশ্চয়ই সেসব কিছুই জানেন। অন্যায়কারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।
[2:271]
যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন।
[2:272]
তাদেরকে সৎপথে আনার দায় তোমার নয়। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। যে মাল তোমরা ব্যয় কর, তা নিজ উপাকারার্থেই কর। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যয় করো না। তোমরা যে, অর্থ ব্যয় করবে, তার পুরস্কার পুরোপুরি পেয়ে যাবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।
[2:273]
খয়রাত ঐ সকল গরীব লোকের জন্যে যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে-জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা যাঞ্চা না করার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না। তোমরা যে অর্থ ব্যয় করবে, তা আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই পরিজ্ঞাত।
[2:274]
যারা স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, রাত্রে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্যে তাদের সওয়াব রয়েছে তাদের পালনকর্তার কাছে। তাদের কোন আশংঙ্কা নেই এবং তারা চিন্তিত ও হবে না।
এখানে উল্লেখিত প্রথম আয়াত থেকে এটা পরিষ্কার যে, আল্লাহর রাস্তায় দান করার পুরষ্কার আল্লাহ পাক সাতশ গুণ পর্যন্ত দিতে পারেন। তবে এই পুরষ্কার তারাই পাবে, যারা আল্লাহ’র রাস্তায় ব্যয় করার পর সেটার কথা অন্যের কাছে বলে বেড়ায় না, কিংবা যাকে দান করেছে তাকেও সেই দানের কথা মনে করিয়ে কষ্ট দেয় না। আজকাল এই দুটো ব্যাপারই ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। কাউকে বা কোথাও দান করে সেই দানের কথা প্রচার করা তো আমাদের সমাজের একটা অত্যন্ত প্রচলিত কাজ। আমরা যারাই এই কাজ করি, তাদের মনে রাখা দরকার এই দান আল্লাহর রাস্তায় দান নয়। আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’লা সেটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন পরবর্তী আয়াতে। আরেকটা ব্যাপার আমাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে, সেটা হচ্ছে প্রতিদানের জন্য দান করা। প্রায়ই দেখা যায় আশে পাশের গরীব লোককে মানুষ দান করে যাতে কাজের সময় তাদের পাওয়া যায়। কাউকে দান করে সেই দানের কথা তাকে জিজ্ঞেস করে তাকে কষ্ট দিতে আল্লাহ পাক সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছেন। অথচ আমরা দান করি যাতে পরবর্তীতে তাদের দিয়ে কাজ করাতে পারি। এই দান আদৌ আল্লাহর রাস্তায় দান হবে না।
২৬৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’লা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কথা বলেছেন। যদি দান করতে না পারেন, তাহলে নম্রভাবে তা বলে দেয়া ওই দানের চেয়ে উত্তম যে দান করার পর সেই দানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে দান গ্রহণকারীকে কষ্ট দেয়া হয়। যিনি দান করবেন, তার মনে রাখা দরকার, এই দান তিনি তার নিজের জন্য করছেন। যাকে দান করছেন তার অভাব দূর করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ পাকের। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, তিনি সম্পদশালী ও ক্ষমাশীল।
এর পরের আয়াতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আল্লাহ সরাসরি আমাদের বলে দিয়েছেন যা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই এবং এই ভুল করে থাকি। আল্লাহ বলেছেন দান করে সেই দানের কথা প্রকাশ করে সেই দানকে নষ্ট করে দিও না। এই আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে সেই দানের কথা বলে বেড়ালে সেই দানের সুফল নষ্ট হয়ে যাবে, সেই দান আল্লাহ’র কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে না। এই দানের উদাহরণ একটি মসৃণ পাথরের উপর কিছু মাটি জমা হওয়ার মত। দান করলাম, পাথরের উপর কিছু মাটি জমা হল। তারপর সেই দানের কথা বলে বেড়া্লাম, যেন সেই মাটির উপর ঝুম বৃষ্টি হল। পাথরের উপর আলগা মাটিতে বৃষ্টি পড়লে সেই মাটি ধুয়ে যায়, একইভাবে দান করার পর সেই দানের কথা বলে বেড়ালে সেই দানও আমাদের আমল থেকে মুছে যায়।
আরো দুটি ব্যাপার আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। একটি হলো খারাপ জিনিস দান করা। যেমন পুরোনো কাপড়, বাসি খাবার, পোকায় খাওয়া ফসল-ইত্যাদি। আরেকটি হলো দান গ্রহণকারীর চরিত্র বিচার। এই লোক বেয়াদব, একে দান করবো না, ওই লোক মসজিদে আসে না, ওকেও দান করা যাবে না- এই ধরনের বিশ্লেষণ। ২৬৭ এবং ২৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ এই দুটি ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন তোমাদের সম্পদ ও ফসল, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দিয়েছেন তা থেকে খারাপটা দান করো না, তোমরা নিজেরা এটা গ্রহণ করবে না, তাহলে আরেকজনকে এটা কেন দিচ্ছ।আর ২৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, যাদেরকে দান করা হয়, তাদের সৎ পথে আনার দায়িত্ব দানকারীর নয়। যিনি দান করছেন, তিনি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করেন, তাহলে দান গ্রহণকারী সেই দান নিয়ে কি করছে, সেটার জন্য তার দান বাতিল হয়ে যাবে না, এটা তার দেখারও দরকার নেই।
কুরাআনের অনেক আয়াত আছে যেগুলোতে আল্লাহ সরাসরি আদেশ নির্দেশ না দিয়ে উদাহরণ হিসেবে দিয়েছেন, বা বিস্তারিত নির্দেশ দেন নি। কিন্তু কিছু কিছু আয়াতে আল্লাহ পাক সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন, কিভাবে সেই নির্দেশ পালন করতে হবে তা বলেও দিয়েছেন। দানশীলতা সম্পর্কে উপরের আয়াতগুলো এরকমই কিছু আয়াত যেগুলোতে আল্লাহ পাক বিস্তারিতভাবে দানশীলতা, এর ফযিলত, কিভাবে এবং কাকে দান করতে হবে, দান করার পর কি করা যাবে না সবই বলে দিয়েছেন। এই আয়াতগুলোর মূল বিষয় বুঝার জন্য কোন তফসীর গ্রন্থের দরকার পড়ে না। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এই আয়াতগুলো পড়ে বুঝার এবং তা মনে রাখার এবং এই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমাদের সমাজে প্রচলিত ভুল গুলো থেকে ধীরে ধীরে আমাদের মুক্ত করুন- এই প্রার্থনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৩