তোমরা কেন রোজা রাখ? আমরা যারা দেশের বাইরে রোজা রাখি তারা এই প্রশ্ন প্রতি বছরই শুনি। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় কোন একটা বইয়ে (স্কুলের ইসলাম শিক্ষা পাঠ্য বই ছিল কি-না, মনে নেই) পড়েছি আমরা রোজা রাখি কারণ রোজা রাখলে যারা গরীব, সব সময় খাবার পায় না, তাদের কষ্ট বোঝা যায়। আমরা তাদের প্রতি আরো বেশি সহানুভুতিশীল হতে পারি এবং তাদেরকে সাহায্য করতে উৎসাহিত হই। অনেক বছর রোজা রাখার কারণ হিসাবে আমি এই উত্তরটা মেনে নিয়েছি। কারণ দেশে থাকার সময় রোজা কেন রাখি, এই প্রশ্ন শুনিনি, কাজেই এর উত্তর নিয়ে চিন্তা করতে হয় নি। দেশের বাইরে আসার পর যখন এই প্রশ্ন শুনলাম, তখন প্রথমবার চিন্তা ভাবনা করতে হয় নি, কারণ ছোটবেলা থেকেই এই উত্তর মাথায় ছিল, তাই সাথে সাথেই উত্তর দিয়ে দিয়েছি। উত্তর দিয়ে পরে যখন ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলাম, তখন নিজের কাছেই নিজের উত্তরটা সন্তোষজনক মনে হল না। শুধুমাত্র ক্ষুধার কষ্ট বোঝার জন্য এক মাস রোজা রাখার দরকার পড়ে না। রোজা রাখলে গরিবের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল হই ঠিক আছে, কিন্তু এটা রোজা রাখার কারণ না। রোজা রাখার প্রথম কারণ হচ্ছে, আল্লাহ আমাদের উপর রোজা ফরয করে দিয়েছেন। কেন ফরয করেছেন সেটা আল্লাহ সুবহানাওয়াতা'লা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন সূরা বাক্বারা'র ১৮৩ নম্বর আয়াতে,
"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।"
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাক্বওয়া কি? আমার সীমিত জ্ঞানে যতটুকু জানি, তাকওয়া হচ্ছে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা। বর্ণিত আছে একবার হযরত ওমর ইবন খাত্তাব (রাঃ) হযরত ঊবাই ইবন ক্বাব (রাঃ) কে তাকওয়া বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ঊবাই (রাঃ) বলেন, আপনি কি কখনো কাঁটা ভরা রাস্তায় হেটেছেন? ওমর (রাঃ) জবাব দিলেন, হ্যাঁ। ঊবাই (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তখন আপনি কি করেছেন? ওমর (রাঃ) বললেন, আমি আমার কাপড় গুটিয়ে নিয়েছি যাতে কাপড়ে কাটা না লাগে, আর নিজের শরীরে যাতে কাটা না লাগে, সেজন্য খুব সাবধানে হেটেছি। ঊবাই (রাঃ) বললেন, এটিই তাক্বওয়া- জীবনের কঠিন পথে নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে চলা।
রমজান মাস আমাদের তাক্বওয়া অর্জনের বুট ক্যাম্প। এটিই রোজা রাখার মূল লক্ষ্য। একটু চিন্তা করলে তাক্বওয়ার সাথে রোজার সম্পর্ক পাওয়া যাবে। যদি রমজান মাসে রোজা রাখতে হত না, আল্লাহ বলতেন তোমরা রমজান মাসে তাক্বওয়া অর্জনের চেষ্টা কর; কিন্তু রোজা রাখতে হবে না, তাহলে কেমন হত? এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না যে তখন হাতে গোনা কিছু লোক রমজান মাসকে বিশেষ ভাবে পালন করত। কারণ যেহেতু জীবনের বাকি সব কাজই একই নিয়মে চলে, তাহলে বাকি সব মাসের সাথে এই মাসের পার্থক্য তেমন চোখে পড়ত না। রমজান মাসকে বিশেষভাবে আলাদা করে দেয়ার পরও আমরা অনেকেই রমজানে তাক্বওয়া অর্জনের কোন চেষ্টা করি না, যদি রমজান মাসের জীবন ধারা অন্য সব মাসের মত হত, তাহলে আমরা কতজন এই মাসে আলাদা করে তাক্বওয়া অর্জনের চেষ্টা করতাম, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। রোজা রাখা আমাদের তাক্বওয়া অর্জনের একটি মাধ্যম, এটিই রমজান মাসের একমাত্র ইবাদত নয়। আমরা যারা চাকরি করি, তাদের কাছে ইনসেন্টিভ শব্দটা খুব মূল্যবান। রমজান মাসে তাক্বওয়া অর্জনের চেষ্টা করার জন্য আল্লাহ পাক আমাদের বিভিন্ন ধরনের ইনসেন্টিভের ব্যবস্থা রেখেছেন। যেমন রমজানের সময়ের এক রাকাত নফল অন্য সময়ের এক রাকাত ফরজের সমান, রমজানের এক রাকাত ফরয অন্য সময়ের সত্তুর রাকাত ফরযের সমান (এই হাদিস নিয়ে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। কিছু মুহাদ্দিসিন এই হাদিসটিকে সহিহ নয় বলেছেন। একইভাবে-রমজানের প্রথম দশদিন রহমতের, দ্বিতীয় দশদিন মাগফেরাতের এবং তৃতীয় দশদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তির- এই হাদিসটিকেও কিছু মুহাদ্দিসিন সহিহ নয়ে বলেছেন); সেই সাথে ইলাতুল ক্বদর তো রয়েছেই, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। তাছাড়া এই মাসে আল্লাহ পাক সবচেয়ে বেশি মানুষকে ক্ষমা করেন।
রাসূলে পাক (সাঃ) বলেন, "রোজা মু'মিনের জন্য ঢাল স্বরূপ যা আল্লাহর বান্দাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে।" রোজা কিভাবে জাহান্নাম থেকে আমাদের রক্ষা করে? আমরা যখন রোজা রাখি, তখন আমরা তাক্বওয়া অর্জনের চেষ্টা করি। কিভাবে? আমরা গুনাহ থেকে বাঁচার চেষ্টা বেশি করে করি, আর নিয়মিত ইবাদতে পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত ইবাদতের চেষ্টা করি। এই ঢাল তখনি দিনে দিনে আরো মজবুত হবে, যখন রমজানের এই তাক্বওয়ার প্রচেষ্টা আমরা রমজানের পরেও চালিয়ে যাব আর পরবর্তী রমজানে আমরা এর থেকে আরেকটু বেশি তাক্বওয়া কিভাবে অর্জন করা যায়, সেই চেষ্টা করব।
আরেকটা গৎ বাঁধা কথা হচ্ছে রমজান মাস হচ্ছে সংযমের মাস। সংযমের মাস কথাটাকে ব্যাক্ষা না করলে মনে হয় রমজান মাস ছাড়া বাকি সব মাসে সংযম না করলেও চলবে। আর সংযমের মাস্ কথাটা থেকে অনেকেই এই ব্যক্ষা দাঁড় করিয়ে ফেলে যে ক্ষুধা লাগার পরও সারাদিন আমরা খাওয়া থেকে সংযত থাকি, এটাই সংযম। এই ব্যাপারেও আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। সংযম একজন মুসলমানের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রমজান হচ্ছে বেশি করে সেই সংযম প্র্যাক্টিসের মাস। কিন্তু সংযম প্র্যাক্টিসের মাসে সেহরী ও ইফতারে আমাদের খাওয়ার বহর দেখলে কে বলবে তা সংযমের সাধনা? সেই সাথে সেহরীতে বিশেষ কোন খাবার না হলে খেতেই পারি না, এই ধরণের কথাও আমরা অনেকেই বলি এবং শুনি। ইফতারের টেবিলে বসে একবার আমাদের সংযম সাধনার কথা চিন্তা করলে নিজের কাছেই লজ্জিত হতে হবে। সামনে দশ থেকে পনের পদের খাবার নিয়ে বসে সংযমের চিন্তাটা একটু বিব্রতকরই।
রমজানের গুরুত্ব ও তার বরকতের কথা আলোচনা করে অনেক বই লেখা যাবে, কিন্তু তবুও শেষ হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সেসব আমাদের তেমন উপকারে আসবে না যদি না আমরা নিজেদের হৃদয়ে রমজানের ব্যাপারে একটু গভীরভাবে চিন্তা না করি। রমজান আসছে, সেজন্য আমরা তৈরী হই কিভাবে? আমরা বাজার করি। ডাল, বূট, ছোলা, পছন্দের মাছ, মাংস কিনে ফ্রিজ বোঝাই করি। সেই সাথে যদি আমরা রমজানে কিভাবে আমাদের ম্রিয়মান ঈমানকে সামান্য একটু মজবুত করা যায়, কিভাবে আল্লাহর অপছন্দের কিছু কাজকে আমাদের জীবন থেকে বিতাড়িত করা যায়, কিভাবে হারাম রোজগার থেকে বেরিয়ে এসে হালাল রোজগারের ব্যবস্থা করা যায়- এসব যদি চিন্তা না করি, তাহলে আমাদের রোজা হয়ত শুধু উপবাসই হবে। কারণ রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, অনেক লোক রমজানের রোজা থেকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট ছাড়া কিছুই পায় না আর অনেক লোক তাদের রাতের নামাজ থেকে জেগে থাকা ছাড়া আর কিছুই পায় না। আল্লাহ পাক এই রমজানে আমাদের সবাইকে সামান্য হলেও তাক্বওয়া অর্জনের তৌফিক দান করুন আর আমাদের ক্ষমা করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৫ রাত ২:৪৪