عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، – رضى الله عنه – قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ وَإِنَّمَا لاِمْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَإِلَى رَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَإِلَى رَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ “ .
On the authority of Omar bin Al-Khattab, who said : I heard the messenger of Allah Sallallahu Alaihi Wasallam say : “Actions are but by intention and every man shall have but that which he intended. Thus he whose migration was for Allah and His messenger, his migration was for Allah and His messenger, and he whose migration was to achieve some worldly benefit or to take some woman in marriage, his migration was for that for which he migrated.” ~ Related by Bukhari and Muslim
“ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়াহ”- এটি সম্ভবত সবচে বেশি উল্লেখকৃত হাদিস। সবাই এই হাদিস জানে এবং কোন না কোন সময় এই হাদিসটি কথায় ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এই লাইনটা একটা হাদিসের অংশ। পুরো হাদিসটা উপরে কপি করে দিয়েছি। (ইংরেজি অনুবাদটা প্রথমে পেয়েছি দেখে সেটাই দিয়ে দিয়েছি। এই লেখার পাঠকরা সবাই মোটামুটি ইংরেজি জানেন- এই এজাম্পশন নিয়ে কাজটা করেছি।)
এই হাদিসের পটভূমি হচ্ছে হুজুরে পাক (সাঃ)এর মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের সময়। মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করলেন। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মুসলমান নারী পুরুষ সবাই মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় চলে যেতে লাগলেন। যারা আল্লাহ সুবহানাওয়াত্বালার জন্য নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমালেন, আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা অনেক। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল মুসলমানদের মধ্যে একজন হিজরত করছেন কারণ তার পছন্দের নারী যাকে তিনি বিয়ে করতে চান, তিনি মদীনায় হিজরত করেছেন। এই কথা যখন রাসূলে পাক (সাঃ) কাছে পৌছাল, তখন তিনি এই মন্তব্য করেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)এর কাছ থেকে এই হাদিসটি বর্ণিত এবং ইমাম বুখারী এবং মুসলিম, দুজনেই এই হাদিসটি লিপিবদ্ধ করেছেন।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস। আমাদের ঈমান-আমলের সিংহভাগের ভিত্তিই এই হাদিস। একজন লোক মু’মিন নাকি মুনাফিক, সেটিও এই হাদিস দ্বারাই নির্ণীত হতে পারে। যে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সাঃ) উপর পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে তাওহীদের সাক্ষী দেয়, সে-ই মুসলমান; আর কেউ যদি নিজস্ব কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দ্যেশ্যে তাওহীদের সাক্ষ্য দেয়, সে মুনাফিক। তার নিয়তই তার ঈমানের মাপকাঠি।
আল্লাহ সুবহানাওয়াত্বালা তার বান্দাদের এত বেশি ভালবাসেন যে তার হিসাব করা যায় না। সন্তানের জন্য মায়ের ভালবাসা দেখে আমরা অভিভূত হই; কিন্তু বান্দার জন্য আল্লাহ’র ভালবাসা তার চেয়েও বেশি। যিনি রহমত এবং ভালবাসার উৎস, তার ভালবাসা আমাদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব হবে না। তিনি চান তার বান্দারা দুনিয়ার পরীক্ষায় সফল হোক। তাই তিনি শত শত সুবিধা দিয়ে রেখেছেন। এর একটা উদাহরণ হল, আল্লাহ আমাদের ডান কাঁধের ফেরেশতা, যিনি আমাদের ভাল কাজ লিপিবদ্ধ করেন, তাকে আমাদের বাম কাঁধের ফেরেশতার চেয়ে বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন। বাম কাঁধের ফেরেশতা কোন খারাপ কাজ লিপিবদ্ধ করার আগে ডান কাঁধের ফেরেশতার অনুমতি নেন। বান্দা যখন ভাল কাজের নিয়ত করে, ডান কাঁধের ফেরেশতা সাথে সাথে সেই কাজের পুরো সওয়াব লিখে ফেলেন। কিন্তু মন্দ কাজের নিয়ত করলে বাম কাঁধের ফেরেশতা কিন্তু গুনাহ লিখেন না। এমনকি মন্দ কাজ করার পরেও তাকে ডাক কাধের ফেরেশতার অনুমতির অপেক্ষায় থাকতে হয়। ডান কাধের ফেরেশতা বলেন এখনি লিখ না, হয়ত আল্লাহর বান্দা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন।
আল্লাহ আমাদের সোয়াব দেয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যেকোন কোন কাজ করলেই ডান কাধের ফেরেশতা সোয়াব লিখতে থাকেন। যেমন, আমরা যখন খাবার খেতে যাই, আমরা যদি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করি এবং খাবার শেষ করে মন থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, তাহলে এই খাওয়াও আল্লাহর ইবাদত হিসাবে গণ্য হয়। এভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠা থেকে রাতে আবার ঘুমানো পর্যন্ত সব কাজে আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর নাম নিয়ে করলে সব কাজই ইবাদত এবং সব কাজের জন্যই সওয়াব।
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নামাজ এবং তেলাওয়াতকেই ইবাদত হিসাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে নামাজের শেষে কিছু দুরুদ ও যিকর করলে সেটাকে আমরা অতিরিক্ত হিসাবে গন্য করি। আমরা যারা ফরয ইবাদত করতে চেষ্টা করি, তারা সেটাকে দায়িত্ব হিসাবে আদায় করতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক কাজে আমরা আল্লাহকে স্মরণ করিনা বললেই চলে। অনেকে অভ্যাসবসত মুখে বিসমিল্লাহ বলি, কিন্তু এই বিসমিল্লাহ্ আমাদের ঠোট থেকে আমাদের হৃদয়ে পৌছায় না। আমরা আসলে চিন্তা করি না। আল্লাহর রাস্তায় কিভাবে অগ্রসর হওয়া যায় তার চেষ্টা করি না। নামাজ পড়ি, কিন্তু আদায় করার চিন্তা করি না। অথচ আল্লাহ বলেছেন বান্দা তার দিকে এক পা এগুলে তিনি দশ পা এগিয়ে আসেন, বান্দা তার দিকে হেটে আসলে তিনি দৌড়ে যান। আর আল্লাহ বার বার বলেছেন তিনি বিভিন্ন নিদর্শন দিয়েছেন চিন্তাশীলদের জন্য। আমরা সারাজীবন কতই না চিন্তা করি, নিজের পড়া লেখার জন্য চিন্তা, ক্যারিয়ারের জন্য চিন্তা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে চিন্তা, পদার্থবিজ্ঞানের যুগান্তকারী মতবাদ নিয়ে চিন্তা। বিভিন্ন জটিল তত্ত্ব আমরা আয়ত্বে নিয়ে আসি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আমরা আল্লাহ ও তাঁর হুকুম সমূহ নিয়ে সাধারণ চিন্তা ভাবনা করি না।
আমরা যদি শুধু আমাদের দৈনন্দিন সাধারণ কাজ গুলো আল্লাহকে স্মরণ করে করি, আল্লাহকে খুশি করার নিয়ত নিয়ে করি, তাহলে অগনিত সাওয়াব আমাদের খাতায় জমা হতে পারে। খুবই সাধারণ কিছু উদাহরণ হচ্ছে, সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন যদি আল্লাহকে স্মরণ করি, সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে ঘুম থেকে তোলার জন্য আল্লাহ’র শুকরিয়া আদায় করি, তাহলে সওয়াব, বাথরুমে ঢোকার সময় “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউ’জুবিকা মিনাল খুবসি ওয়াল খাবাইস” বলে ঢুকি তাহলে বাথরুমে শয়তান থেকে বেঁচে থাকা যায় এবং সওয়াব, বের হওয়ার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে বের হলে সওয়াব, খাওয়া শুরু করার আগে যদি আল্লাহর নাম নিয়ে খাওয়া শুরু করি এবং শেষ করার পর রিযক দান করার জন্য আল্লাহ’র শুকরিয়া আদায় করি তাহলে পুরো খাওয়ার সময়টাই ইবাদাত হিসাবে লেখা হবে। এমনকি জুতা পরার সময়ও সুন্নাহ অনুসারে ডান পায়ে প্রথমে জুতা পরি এবং পরার সময় বিসমিল্লাহ্ বলি, সেটাও ইবাদত।
পরিবারের জন্য আমরা বাজার তো অবশ্যই করি। আল্লাহ বলেন পরিবারকে রোজগার করে খাওয়ানো সাদকায়ে জারিয়ার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু আমরা যদি এই চিন্তাও কখনো না করি, বরং এটাকে শুধুমাত্র একটা দায়িত্ব হিসাবে দেখি, তাহলে আমরা কিভাবে সেই সওয়াব পাব? আপনি আল্লাহ’র কথা ভেবে আল্লাহ’র খুশির নিয়তে খুশি মনে পরিবারের জন্য খাবার কিনে আনুন, আপনার এই কষ্টের বাজার সদকায়ে জারিয়া হিসাবে আপনার আমলনামায় লেখা হবে।
এভাবে যেকোন হালাল কাজ আমরা আল্লাহ’র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যদি করি, সেটা আল্লাহর ইবাদত হিসাবে আল্লাহ কবুল করে নেবেন।
এ তো গেল ছোট ছোট কাজের কথা। জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলো নিতে আমরা আল্লাহকে স্মরণ করি? একটা ছেলে বা মেয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায় তখন যদি চিন্তা করে কোন সাবজেক্ট পড়লে আল্লাহর হুকুম মানা সহজ হবে, হালাল রোজগারের সম্ভাবনা বেশি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তার সেই সৎ চিন্তার জন্য তাকে পুরষ্কৃত করবেন। তার পুরো শিক্ষা জীবনটাই তখন আল্লাহর ইবাদত হয়ে দাঁড়ায়। যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করি, তখন যদি কেউ আল্লাহ কে খুশি করার জন্য একটা হারাম চাকরী না নিয়ে কিছুটা কম বেতনের একটা চাকরী গ্রহণ করি, যেটার রোজগার তুলনামূলকভাবে কম প্রশ্নসাপেক্ষ, তাহলে তার সেই হালাল রোজগারের পুরষ্কার আল্লাহ তা’লা তাকে অবশ্যই দান করবেন। তার সমস্ত চাকরিজীবনই ইবাদত হিসাবে গণ্য হতে পারে। আল্লাহর কাছে তো রহমতের অভাব নেই। গাড়ি কিনবেন, বাড়ি কিনবেন। যদি আল্লাহর ভয়ে ট্র্যাডিশনাল ব্যাংক থেকে লোন না নেন, আল্লাহ কি খুশি হবেন না?
সমাজের মানুষের সাথে আমাদের চলতে হয়। এর মধ্যে অনেকের সাথে চলা অনেক কষ্টকর। কিন্তু যদি আল্লাহকে খুশি করার জন্য বিবাদ এড়িয়ে যান, তাহলে তার পুরষ্কার আল্লাহ অবশ্যই দেবেন।
আমরা যদি আমাদের ফরয গুলো পালন করি, আর দৈনন্দিন কাজে আল্লাহকে স্মরণ করে তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজগুলো করি, তাহলে শেষবিচারের দিনে আমাদের লজ্জিত হতে হবে না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শেষ বিচারের দিনে লজ্জিত হওয়ার মত ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছোট বড় সব কাজে আল্লাহকে স্মরণ করার তৌফিক দিন, আমাদের নিয়াহ কে শুদ্ধ করে দিন। প্রতিমুহূর্তে আমাদের স্মরণ রাখার তৌফিক দিনঃ “অতএব, তোমরা তোমাদের রবের কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”