ছোটবেলায় আমরা অনেকেই মার্শাল আর্ট শিখতে গিয়েছি। লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে "হুঁ, হাঁ" করে পাঞ্চ প্র্যাক্টিস করেছি, কিক প্র্যাক্টিস করেছি। বাচ্চারা যখন মার্শাল আর্ট শিখতে যায়, তখন তাদেরকে কি শিক্ষা প্রথমেই দেওয়া হয়? তাদের বলা হয় মার্শাল আর্ট শুধু মারামারি করতে শেখা নয়, মার্শাল আর্ট হচ্ছে একটি লাইফ স্টাইল। দৈনন্দিন জীবনও মার্শাল আর্টের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে হতে হবে, তবেই পরিপূর্ণ সফলতা আসবে। মার্শাল আর্ট শুধু আত্মরক্ষার কৌশলই শিক্ষা দেয় না, কিভাবে জীবন যাপন করতে হয় সেই শিক্ষাও দেয়। বাচ্চারা মনযোগ দিয়ে কিছুদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, দৌড়াতে যায়, সময় মত নাস্তা খায় এবং এভাবে খুব সুন্দর রুটিন লাইফের মধ্য দিয়ে মার্শাল আর্ট শিখে। আমরা অনেকেই কিছুদিনের জন্য হলেও এই অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। অনেকেরই এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে মনে হয় আহা! কি দিন ছিল ছোটবেলার! একটু বড় হয়ে যারা কোয়ান্টাম মেডিটেশন করেছেন, বা এখনো করছেন তাদেরও একই অভিজ্ঞতা আছে। কোয়ান্টাম মেথড শুধু মেডিটেশনের একটা পদ্ধতি নয়, এটি একটি জীবন ব্যবস্থা। আসলে যেকোন কিছুই করতে যান না কেন, যতদিন আপনার পুরো জীবনটা এর উপর ভিত্তি করে না হবে, ততদিন আপনি শতভাগ সফল হতে পারবেন না। এটা মার্শাল আর্ট বলুন, কোয়ান্টাম মেথড বলুন আর মিউজিকের কথাই বলুন।
ইসলামকে কোনভাবেই এসবের সাথে তুলনা করা যায় না, শুধু উদাহরণের জন্য তুলনা করছি। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, এটা মুসলমান মাত্রই জানে। কিন্তু এই পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থাটা আসলে কি, সেটা আমরা বেশিরভাগই বুঝি না অথবা বোঝার কোন চেষ্টা করি না। চার কলেমার পরে আমাদেরকে কি শেখানো হয়েছিল, সেটা আমরা অনেকেই আজ ভুলে গেছি। ঈমানে মুজমাল আর ঈমানে মুফাসসাল বলে দুটো জিনিশ আমাদেরকে শেখানো হয় যার প্রথমটিতে আমরা বলেছিলাম,
"আমানতু বিল্লাহি কামাহুয়া বিআসমাইহি ওয়া সিফাতিহি, ওয়া ক্বাবিলতু জ্বামিয়া আহকামিহি ওয়া আরকানিহি" অর্থাৎ, "আমি ঈমান আনলাম আল্লাহ'র উপর, তার নাম সমূহের উপর এবং তার 'সিফাতে'র উপর এবং আমি তার সকল হুকুম এবং নিয়ম মেনে নিলাম।"
মুসলমান হওয়ার সবচেয়ে প্রথম শর্ত হচ্ছে ঈমান বা বিশ্বাস। মুসলমান বাবা মা'র ঘরে জন্ম দিয়ে আল্লাহ আমাদের যে নিয়ামত দিয়েছেন, তার প্রধান সুবিধা হচ্ছে ঈমানের মৌলিক জিনিসগুলো আমরা আমরা আমাদের ছোটবেলায়ই শিখতে পারছি। কিন্তু এতে আমরা কিন্তু মুসলমান হয়ে যাচ্ছি না। সাবালক হওয়ার পরে সজ্ঞানে এবং বুঝেশুনে যখন আমরা ইসলামের সকল আদর্শ এবং হুকুম আহকামের উপর আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করব তখনই আমরা নিজেকে মুসলমান হিসাবে দাবি করতে পারি।
একজন মুসলমানের জীবন হবে ইসলামের উপর ভিত্তি করে। তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ ইসলাম অনুসারে হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজের জন্য ইসলামের দিক নির্দেশনা রয়েছে। একইভাবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে, তার দিক নির্দেশনাও ইসলামে স্পষ্টভাবে রয়েছে। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি- কোনকিছুর নির্দেশনাই ইসলামে না নেই। একজন মুসলমানের ইসলামের প্রত্যেকটি বিষয়ের উপর পূর্ণ ঈমান থাকবে। এটাই ইসলামের প্রথম ভিত্তি বা মৌলিক বিষয়। আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহ এক এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ'র রাসূল, কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছিনা যে ইসলামী অর্থনীতি দিয়ে কোন দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করা সম্ভব অথবা ইসলামী সমরনীতি দিয়ে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ করা সম্ভব; তাহলে কি আমার ঈমান পরিপূর্ণ হল?
পরিপূর্ণ ঈমান আনার পরে আসে পরবর্তী ভিত্তি বা মৌলিক বিষয় পালনের পর্যায়-যেমন সালাত, সাওম, জাকাত এবং হাজ্ব। ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি হচ্ছে কালেমা, সালাত, সাওম, হজ্ব ও জাকাত। কলেমা বলতে এখানে ঈমানের কথাই বলা হয়েছে। আমরা অনেকেই মনে করি কলেমা জানলে এবং সালাত, সাওম এবং জাকাত আদায় করলেই ইসলাম পুরোপুরিভাবে পালন করা হল। কিন্তু আসলেই কি তাই? আপনি জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আপনি দেদারসে ঘুষ খাচ্ছেন, স্বজনপ্রীতি করছেন, অথবা আপনি গতানুগতিক ব্যাংক এ লোন এর কাগজ পত্র তৈরী করছেন তাহলে কি আপনি পরিপূর্ণ ইসলাম পালন করছেন? ফরয আদায় করা যেমন জরুরী, হারাম পরিহার করাও তেমনি জরুরী।
ঈমানে মুফাসসালে আপনি বলেছিলেন "আমি ঈমান আনলাম আল্লাহ'র উপর, তার ফেরেশতাদের উপর, আসমানী কিতাবের উপর, রাসূলদের উপর, শেষবিচারের দিনের উপর, ভাগ্যের ভাল এবং মন্দের উপর, এবং মৃত্যু'র পরের জীবনের উপর।" তাহলে আমরা রাসূলরা যা বলে তাতে বিশ্বাস করি, কিতাব যা বলে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমাদের কিতাব হচ্ছে আল-কুরান। কুরান আমাদেরকে আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দেয়। আমরা কি তার সবগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করছি? পালন করা পরের কথা, প্রথমে তো আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। যে কোন ব্যাপারই ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়। ইসলামের প্রথম ধাপ হচ্ছে ঈমান। ঈমান আনার পরে আসছে নির্দেশনা মানার ধাপ। সালাত, সাওম, যাকাত এবং হাজ্ব এবং অন্যান্য নির্দেশনা। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লাম, রোজা রাখলাম, যাকাতও দিলাম কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ধর্ম এবং রাষ্ট্র আলাদা, ইসলামি আইনের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না; অথবা, ইসলামি অর্থনীতি দিয়ে কোন দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তাহলে আমাদের ঈমান কি পূর্ণ হল? বর্তমান বিশ্বে হয়ত ইসলামী রাষ্ট্র নামধারী গুলো কার্যকর রাষ্ট্র নয়, কিন্তু তার জন্য ইসলামের পরিপূর্ণতার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ইসলামকে মসজিদ আর নামাজ রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ হিসাবে বিশ্বাস করা শুরু করলে আমাদের ঈমান কোন দিন পূর্ণতা পাবে?
ব্যক্তিগত ভাবে কিছু ব্যাপার আমার পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ'র কোন আইনকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের পছন্দ হোক কিংবা না হোক, ইসলামে চুরির শাস্তি হাত কেটে ফেলা। এই ধরনের কঠোর আইন আমি হয়ত মেনে নিতে পারি না, কিন্তু আল্লাহ এটিই আইন করেছেন এবং এটিই সঠিক আইন, এই বিশ্বাস কিন্তু আমরা হারাতে পারি না। তবে এই আইন অবশ্যই বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকর হতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্রের মাধ্যমে কার্যকর হতে হবে; ইসলামি আইনের নামে কেউ চোর ধরেই তার হাত কেটে দিতে পারে না, সেটা স্পষ্ট ইসলাম বিরোধী কাজ।
সূরা বাকারার পঁচাশি নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
"তবে কি তোমরা কিতাবের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কেয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন।"
কেউ যদি অবিশ্বাস করতে চায়, তাহলে সে বলতে পারে এই আয়াত আল্লাহ বনী-ইস্রাইলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, এটা সেই গোষ্ঠী এবং সময়ের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু কুর'আনের বাণী চিরন্তন এবং কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির জন্য। পূর্ববর্তী মানুষের ইতিহাসের মধ্য দিয়েই আল্লাহ আমাদের সাবধান করেছেন।
সুরা আন-কাবুতের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন,
"মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যহতি পেয়ে যাবে যে, "আমরা বিশ্বাস করি" এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদের।"
একই সূরা'র দশম থেকে তেরতম আয়াতে আল্লাহ বলেন,
"কিছু লোক বলে "আমরা আল্লাহ'র উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি" কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তারা নির্যাতিত হয়, তখন তারা মানুষের নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মত মনে করে। যখন আপনার পালনকর্তার থেকে কোন সাহায্য আসে, তখন তারা বলতে থাকে, "আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম"। বিস্বাসীদের অন্তরে যা থাকে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন?(১০) আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা বিশ্বার স্থাপন করেছে এবং নিশ্চই জেনে নেবেন যারা মুনাফেক।(১১) কাফেররা মুমিনদের বলে, "আমাদের পথ অনুসরন কর, আমরা তোমাদের পাপভার বহন করব।"অথচ তারা পাপভার কিছুতেই বহন করবে না। নিশ্চই তারা মিথ্যাবাদী।(১২) তারা নিজেদের পাপভার এবং সেই সাথে আরো কিছু পাপভার বহন করবে। অবশ্যই তারা যে সব মিথ্যাকথা উদ্ভাবন করে, তার সম্পর্কে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।(১৩)"
বর্তমান যুগের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা অনেকেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামকে পূর্ণরূপে পালন করতে পারছি না। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে ইসলামী প্রতিষ্ঠান গুলোও শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু মুসলমান হিসাবে সকল ইসলামী আইন ও বিধানের উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য। আমরা যারা ইসলামকে ভালবাসি, ইসলাম পালন করতে চাই তাদের জন্য এই বিষয়গুলো চিন্তা করা দরকার। সত্যের সন্ধান করলে আল্লাহ সবাইকে সত্যের পথ দেখান। আমরা যেন সঠিক পথের সন্ধান অন্তত করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।