গত কাল জুমার খুতবায় গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ঈমাম সাহেব স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি শিরক নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমরা সবাই জানি, শিরক হচ্ছে সবচে বড় পাপ। আল্লাহ শিরক কে সবচে বড় 'যুলুম' বলেছেন। আমরা সরাসরি শিরক খুব একটা করি না, বা খুব বেশি মানুষ সরাসরি শিরক করে না, কিন্তু ছোট খাট শিরক আমরা নিজের অজান্তে বা অসচতেনতায় হর হামেশাই করে থাকি। ঈমাম সাহেব ছোটখাট শিরকের উদাহরণ দিতে গিয়ে ম্যাটেরিয়ালিজম এর কথা বিশেষ করে উল্লেখ করেন। এটাকে অনেকেই শিরক হিসেবে চিহ্নিত করবেন না, কিন্তু একটু চিন্তা করলে ব্যাপারটা বুঝা যায়। তৌহিদ এর মূল শিক্ষা হচ্ছে এক আল্লাহ'র উপর পূর্ণ বিশ্বাস। 'পূর্ণ বিশ্বাস' কথাটা সামান্য অস্বচ্ছ। আমার নিজের ধারণা ছিল 'পূর্ণ বিশ্বাস' বলতে বুঝায় আল্লাহ'র অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস। অর্থাৎ, আমি পরিপূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আছেন এবং তার সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। কিন্তু 'পূর্ণ বিশ্বাস' কথাটার অর্থ আরো অনেক ব্যাপক। সাধারণ একটা উদাহরণ দেই, ধরুন আপনি বিদেশে আছেন এবং দেশে আপনার অনেক সম্পদ আছে যেগুলোর দেখা শোনা করা জরুরী। কিন্তু আপনি ঘন ঘন দেশে যেতে পারবেন না। তখন আপনার বিশ্বাসী কাউকে পাওয়ার অব এটর্ণী দিয়ে দিলেন। যাকে পাওয়ার অব এটর্ণী দেবেন, তার হাতে কিন্তু আপনার সব সম্পদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা, সে ইচ্ছা করলে সব বিক্রি করে দিতে পারে বা যা ইচ্ছা করতে পারে। কিন্তু আপনি তাকে পাওয়ার অব এটর্ণী দিয়েছেন কারণ আপনি জানেন সে আপনার সব সম্পদের যথাযথ দেখাশুনা করবে, আপনার নির্দেশ ছাড়া বিক্রি বা কোন লেনদেন করবে না, আপনার ক্ষতি হয়, এমন কিছু জেনে শুনে করবে না বরং আপনার ভালোর জন্য কাজ করবে। এক কথায় বলতে গেলে তার উপর আপনার 'পূর্ণ বিশ্বাস' আছে। আল্লাহ'র উপর পূর্ণ বিশ্বাসও শুধু আল্লাহর অস্তিত্বে পূর্ণ বিশ্বাস নয়, বরং আপনার জীবনের সবকিছুতে আল্লাহ'র উপর নির্ভর করা। আপনি নতুন ব্যবসা শুরু করবেন, কঠিন পরিশ্রম করছেন, কিন্তু আপনার সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকবে, শুধুমাত্র আল্লাহ চাইলেই আপনার ব্যবসা সফল হবে আর আল্লাহ না চাইলে আপনার কঠিন পরিশ্রমের পরেও ব্যবসা ফেইল করবে। ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা আছে, কিন্তু আপনার বিশ্বাস থাকবে যে আল্লাহ চাইলে এর কয়েকগুণ বেশি টাকাও আপনার ভবিষ্যতের কোন নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।
গত কালকের খুতবায় ঈমাম সাহেব এই ব্যাপারটা খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেন। আমরা আমাদের নিজের ট্যালেন্ট, সম্পদ ইত্যাদির উপর বিশ্বাস করি। "আমার আজকের অবস্থানের পেছনে আমার এক যুগের কঠিন পরিশ্রম রয়েছে।" অথবা "আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছি।" এই ধরণের কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। অথবা যখন আমাদের কাছে কিছু সম্পদ থাকে, আমরা চিন্তা করি, এর কিছু অংশ ইনভেস্ট করব, কিছু খরচ করব, বাকিটা দিয়ে একটা বাড়ি কিনব, সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত। এই ধরনের কথা বা চিন্তা আমরা সবাই কম বেশি করি। এটা পরোক্ষ শিরক হয়ে দাঁড়ায়। আমার ভুলে যাই আমাদের সামাজিক অবস্থান কিংবা ভবিষ্যত- সবই একমাত্র আল্লাহ'র হাতে।
এই পরোক্ষ শিরক করার কারণ একটাই, ইসলামকে জীবন থেকে আলাদা করে ফেলা, নামাজ, রোজা আর মিলাদ মাহফিলের মধ্যে ইসলামকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। যদি আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা ইসলামকে মনে রাখি, তাহলে প্রত্যেক কাজের পেছনের নিয়াত হবে আল্লাহকে খুশি করা, আর প্রত্যেক কাজ হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশিত পথে। চাকরী খুজতে আমরা চিন্তা করব কোন চাকরী হালাল হবে, যদি নিরুপায় হয়ে যে কোন চাকরী করিও, সব সময় এই চিন্তা থাকবে কিভাবে হালাল ইনকাম এর ব্যবস্থা করা যায়। ব্যবসা করলে সৎ ভাবে ব্যবসা করার চেষ্টা করব। লেনদেন করার সময় ইসলাম নির্দেশিত পথে তা করার চেষ্টা করব। আমাদের মনে রাখা জরুরী, সব সময় আল্লাহর যীকর করতে হবে। জীকর মানে 'স্মরণ করা' (Remembrance); দল বেঁধে বসে পাঁচ সাত মিনিট জোরে জোরে 'ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ' করা না। প্রত্যেক কাজে আল্লাহকে স্মরণ করে তার খুশির জন্য তার নির্দেশিত পথে কাজ করা হচ্ছে আল্লাহ'র প্রকৃত যীকর। আমরা একটু চিন্তা করা দরকার। সায়েন্স, পলিটিক্স, টেকনলজি নিয়ে আমরা তো অনেক চিন্তা করি। আল্লাহ একদিন জিজ্ঞেস করবেন 'আমার দ্বীন নিয়ে চিন্তা করেছিলে?' সেদিন কি জবাব দেব? আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন, "নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে।" (আল ইমরান ১৯০)। আমরা কি বোধ সম্পন্ন লোক হতে চেষ্টা করব, নাকি নাদান থেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেব, সেটা আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে। একমাত্র আল্লাহই আমাদের পথ দেখাতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:০৩