লগি-বৈঠা দিয়ে রাজপথে পিটিয়ে যাদের হত্যা করা হয় তাদের একজনের নাম ছিল মুজাহিদুল ইসলাম। চারদিক থেকে তাকে ঘেরাও করে পিটানো হয়। বৃষ্টির মতো তার উপর পড়ছিল লগি-বৈঠার ঘা। কয়েকটি ঘাতেই যুবকটি মাটিতে শুয়ে পড়ে। সে নিস্তেজ হয়ে আসছিল। পিটুনিতে তার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা নানার দেয়া পায়জামা ও পাঞ্জাবী ছিঁড়ে যায়। তারপরও তাকে পিটানো হচ্ছিল। যারা পিটাচ্ছিল তাদের একজনের হাতে ছিল হাতুড়ি কাস্তে খচিত পতাকা। কারো সঙ্গে যুবকটির শত্রুতা ছিল না। জামায়াতের সমাবেশে যোগদান এবং শিবিরের কর্মী হওয়াই ছিল তার অপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাকে দু’চারটি ঘা দিলে হয়তো কারো মানবতায় চোট লাগতো না। কিন্তু যারাই টিভি পর্দায় এ নির্মম দৃশ্য দেখেছে তারাই হাহাকার করে উঠেছে। নাহ, রাজনীতির নামে এ নিষ্ঠুরতা মেনে নেয়া যায় না। লগি বৈঠা দিয়ে যারা মুজাহিদকে ঘায়ের পর ঘা মেরেছে তাদের হয়তো খুব আনন্দ হয়েছে। কিন্তু তার পিতা মাতা, তার আত্বীয় স্বজনের কেমন লেগেছে? সকালে হাসি মুখে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র মুজাহিদ ঘর থেকে বের হয়েছিল, সন্ধ্যায় সে ফিরে গেল লাশ হয়ে। মেধাবী ছাত্র মুজাহিদকে কবর দেয়ার পর তার মা বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। আর বলছিল, আমার মুজাহিদকে এনে দাও। নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হলে কি মুজাহিদের মায়ের প্রাণ জুড়াতো? সেদিন পল্টনে শুধু মুজাহিদ নয়, আরো ৬ জন নিহত ও আহত হয় কয়েক শত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মনির হোসেনকে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে দাবি করে। ওয়ার্কার্স পার্টি রাশেদ আহমেদ খান নামে তাদের এক কর্মী নিহত হয় বলে দাবি করে। লগি বৈঠার পাশাপাশি চাপাতি, বল্লম, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করা হয়। পরদিন রাজধানীর প্রতিটি দৈনিকে পিস্তল থেকে গুলিবর্ষণকারী যুবকদের ছবি ছাপা হয়। টিভি ক্যামেরায় এসব যুবকের গুলি করার দৃশ্য ধরা পড়ে। গুলিবর্ষণকারী যুবকদের পরিচয় সম্পর্কে পরষ্পরবিরোধী দাবি করা হয়। তবে ছবি দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে, তাদের বেশির ভাগই ছিল যুবলীগের। ছবিতে যে যুবকটিকে পিস্তলের গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে তার নাম জাহাঙ্গীর। পুরনো ঢাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীরকে সবাই ‘খাসি জাহাঙ্গীর’ হিসেবে চিনতো। গত ২৮ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সে ছিল সূত্রাপুর থানার ১১ নম্বর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। পল্টন ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি থাকায় সেখানে কেউ সমাবেশ করতে পারেনি। ২৭ অক্টোবর মধ্যরাতে পুলিশ আওয়ামী লীগের মঞ্চ ভেঙ্গে দিলে তারা সেখানে আবার মঞ্চ তৈরির চেষ্টা করে। মহানগর পুলিশ কমিশনার নগরীতে লগি-বৈঠা ও কাস্তে নিয়ে মিছিল নিষিদ্ধ করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল পল্টনে সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সমালোচনা করে বলেন, সাংবিধানিকভাবে ২৮ অক্টোবর বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কাজেই সমাবেশ নিষিদ্ধে পুলিশ কমিশনারের এ নির্দেশ অবৈধ। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি-ও ক্ষমতা হস্তান্তর উপলক্ষে ২৮ অক্টোবর পল্টন ময়দানে সমাবেশ আহ্বান করে। সেদিন ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। কথা ছিল যে, পল্টনে সমাবেশে ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে গিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত হয়। পল্টনে ১৪৪ জারি থাকায় বিএনপি নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলের প্রধান কার্যালয় এবং জিরো পয়েন্ট ও মুক্তাঙ্গনে পৃথক পৃথক সমাবেশ করে। চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর উপলক্ষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ছিল জামায়াতের সমাবেশ। সকাল থেকেই জামায়াত কর্মীরা গজারির লাঠি ও বাঁশ নিয়ে অবস্থান নেয়। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে সিপিবি অফিসের সামনে তাদের গতিরোধ করে। মুক্তাঙ্গনে যুবলীগের সমাবেশ থেকে সংগঠনের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও সাধারণ সম্পাদক মীর্জা আজম জামায়াতের সমাবেশে হামলা করার জন্য উস্ড়্গানি দেন। আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত মহাজোট ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দিলেও প্রকৃতপক্ষে অবরোধ শুরু হয় ২৭ অক্টোবর থেকেই। সেদিন থেকে দেশব্যাপী উন্মত্ত সহিংসতা শুরু হয়। দেশের এমন কোনো উপজেলা অথবা গ্রামগঞ্জ ছিল না যেখানে বিএনপি ও তার নেতাকর্মীদের বাড়িঘর আক্রান্তô হয়নি। আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে এমন ভয়াবহ সহিংসতা আর কখনো হয়নি। ২৭ থেকে ৩০ অক্টোবর মাত্র চারদিনের সহিংসতায় ৭৩ জন নিহত হয়। আহতদের কোনো হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি। এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটে কেবল কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব গ্রহণে বাধা দিতে গিয়ে। আগামী দিনের ইতিহাস এসব ঘটনাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে তাই জিজ্ঞাস্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৭ রাত ৩:৫৯