দর্শনের নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন অনেকে ! একটু দম লন । বাংলা ভাষা বুঝেন , তাইলে আসেন খুব সহজ করে দেখি অস্তিত্ববাদ নিয়া উইকিপিডিয়ায় কি লেখা আছে ! আর অস্তিত্ববাদ এর সাথে সার্ত্র এর নাম ও আলাদা করা যায় না । তাই সার্ত্র এর জীবন আর কর্মও দেখা যাইতে পারে ।
এক নজরে একটু দেখা যাক ।
সেলাম !
অস্তিত্ববাদ
এটি বিংশ শতাব্দীর একটি শীর্ষ স্থানীয় মতবাদ। এই মতবাদটি মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। অস্তিত্ত্ববাদের কথা,নীতিমালা মানুষের কাছে একটা সময়ে কর্তব্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।বিশেষ করে সাধারণ মানুষে র কাছে।যেখানে উনিশ শতকের জীবন দর্শন অভিজাত শ্রেণীর জন্যই শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ ছিলো। এই অভিজ্ঞতাবাদ এককথায় সাধারণ মানুষের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছে।এ মতবাদ তাত্ত্বিক বিষয়ের বিপরীতে জাগতিক বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করে।এ দর্শন তৈরি হবার পিছনে কিছু পূর্ব শর্তের প্রয়োজন হয়। এ পূর্বশর্তগুলো আমেরিকা ইংল্যান্ড ও মতো পুজিবাদী দেশগুলোতে তৈরি হয়নি বা ব্যাবহার হয়নি।
অস্ত্বিত্ববাদীদের সম্বন্ধে বক্তব্য : ক) এ সম্প্রদায়ের প্রায় সব দার্শনিকই ব্যাক্তিসত্তার পূর্বে সাধারণ সত্তাকে স্বীকার করার বিরোধী।এবং তাদের মতে, ব্যাক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার পূর্বগামী। খ) নৈতিকতা বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদীরা অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক।
অস্তিত্ববাদীদেরকে মুলত; দুইটি শ্রেণীভূক্ত করা হয়। যথাঃ আস্তিক্যবাদী ও নাস্তিক্যবাদী। নীটশে, সার্ত্র, হাইডেগার, প্রমুখ অস্তিত্ববাদী দার্শনিক।
জার্মান অস্তিত্ববাদ
মানুষের মধ্যকার সামজিক নিরাপত্তাহীনতা,ভয় উৎকন্ঠাজনিত ইত্যাদি সমস্যার কথাকে অস্তিত্বের সংকট বিবেচনা করে তা আলোচনা করেন কার্ল জ্যাসপার্স।তাঁর মতে হেগেল তাঁর অধিবিদ্যা ও যুক্তিশাস্ত্রে সত্তা সম্বন্ধে এ কথা বলে গেছেন যে কাজ সম্পাদন করতে হবে।কারণ এ কাজ সামাজিক অবস্থা সহযোগী। অন্যদিকে হাইডেগার এই সমস্যার সমাধান খোঁজবার চেষ্টা করেন যেমনটি তাঁর গুরু হুলার্স রুপতত্ত্বে সন্ধান করেছিলেন। হাইডেগারের মতে বস্তুবাদী দার্শনিকের বিপরীতে ভাববাদী দর্শনকে নতুনভাবে বিকশিত করার কথা বলেছেন। তাঁর মতে কান্ট হেগেল ও জার্মান ভাববাদ সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। যদি আদতে হতোই তবে জার্মান সমাজের এ দুরবস্থা হতোনা বলে তিনি মনে করতেন।
ফ্রেঞ্চ অস্তিত্ববাদ
ফ্রেঞ্চ অস্তিত্ববাদের কথা প্রথম যিনি বলেন তিনি হলেন জাঁ পল সার্ত্রে।এ অস্তিত্ববাদ নান্দনিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়। সার্ত্রে সামাজিক সংস্কারবন্চিত লোক। তিনি প্রথম জীবনে হাইডেগারের অনুসারী হতে চেয়েছিলেন।সামাজিক সমস্যা সমাধানে তার কথা হলো মানুষের সত্তা বা অধিবিদ্যক ধারণার আদতে কোনো প্রয়োজনই নেই কারণ তা মানুষের জীবনে সুখ পরিপূর্ণভাবে প্রদান করে না। মানুষের জন্য দরকার নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করা। অস্তিত্ব স্বীকার হলেই মানুষের জীবনে সত্য অর্জিত হয়। কারণ মানুস সবসময়েই মূলত স্বাধীন।স্বাধীনতাই মানুষকে সাহায্য করে সবকিছুকে চিনতে,ভাবতে ও অর্জন করতে। সার্ত্রে তার নানা সাহিত্য কর্মে উপন্যাসে দেখিয়েছেন একটি সমগ্রের বিবেচনাহীনতার কাছে ব্যাক্তিমানুষ কতই না অসহায়! তিনি মনে করেন এই মানবতাবাদ পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল মানুষের জন্য হতে পারে চুড়ান্ত মানবতার। ব্যাক্তি যদি তার অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন থাকে তবে তাকে শোষন করা সহজ নয়।
জাঁ-পল সার্ত্র
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, চিন্তানায়ক জাঁ পল সার্ত্রের জন্ম ফ্রান্সের প্যারিস শহরে, ১৯০৫ সালের ২১ জুন। ফরাসী নৌবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর পিতা জ্যঁ ব্যাবিস্টে সার্ত্রে । যদিও সার্ত্রে’র ১৫ মাস বয়সে মারা যাওয়া এই বাবা সম্পর্কে কখনই উল্লেখ করার মতো কিছু আসেনি সাত্রে’র লেখায়। অন্যদিকে ১৯৫২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী আলবার্ট সোয়াইৎজার ভ্রাতুষ্পুত্রী আনেমারি তাঁর মা। শৈশবে একটি বড় সময় কেটেছে যাদের সঙ্গে সেই মা এনি ম্যারি এবং দাদা চার্লস শোয়েটজারের প্রভাবকেই জীবনে বড় বলে মেনেছেন সার্ত্রে। যদিও সার্ত্রে’র বয়স যখন নয় তখন দ্বিতীয় বিয়ের কারণে মায়ের সাথেও খানিকটা দূরত্ব বাড়ে সার্ত্রে’র। সেই সাথে আশৈশব স্কুল এবং কলেজের মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সার্ত্রে’র আচরণে অনিশ্চয়তা এবং জেদের বিষয়গুলোও স্পষ্ট হতে থাকে।
জ্যঁ পল সার্ত্রের জীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একদিকে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির তেমন তোয়াক্কা করেননি। অপরদিকে যখন যা সঠিক বলে মনে করেছেন তাই-ই অকপটে ব্যক্ত করেছেন। আমরা তাঁর শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের উপর আলোকপাত করে তাঁর জীবনের বিশাল ব্যাপ্তি ও পরিধির সন্ধান পাই। জ্যা পল সার্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় প্যারিস শহরের লিসে দ্য ল’ রোসেইয়া এবং লিসে লেগ্রাঁদ স্কুলে। এরপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন ইকোলে নরমালে সুপিরিউর কোর্সে। সাফল্যের সাথে কোর্স সমাপ্ত করে হাভ্র, লাঁও এবং নয়নিতে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। মূলত কৈশোরের মাঝামাঝি সময় থেকেই দর্শনের প্রতি আগ্রহ অনুভব করতে থাকেন সার্ত্রে। স্বীয় আগ্রহ আর কৌতূহল থেকে প্যারিসের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একোলি নরমাল সুপেরিয়ের থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন। এছাড়া ফ্রান্স ও বিশ্বের খ্যাতনামা একাধিক দার্শনিকের সংস্পর্শেও ক্রমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন সার্ত্রে। সেই সাথে চলতে থাকে কেন্ট, হেগেল এবং হেইডেগারের মতো দার্শনিকদের তত্ত্ব থেকে ধারণা লাভের প্রক্রিয়াটিও। এরই মাঝে ১৯২৯ সালে সার্ত্রের পরিচয় ঘটে সেই সময়কার আরেক আলোচিত লেখিকা সিমন দ্য বোভোঁয়ার সঙ্গে, যার সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটি চমৎকার সম্পর্ক বজায় ছিল সার্ত্রে’র। এরপর সার্ত্র ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত টানা ৫ বছর মিসর, গ্রীস, ইতালি ও জার্মানি ঘুরে বেড়ান। প্রাচীন সভ্যতার এসব নগরী ঘুরে তিনি দার্শনিক জিজ্ঞাসার বিভিন্ন তথ্য, উপাত্তের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন। ১৯৩১ সালে দর্শনের প্রফেসর হিসেবে লা হার্ভেতে যোগ দেন সার্ত্রে। আর এর ঠিক পরের বছরেই বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে দর্শনশাস্ত্রের ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করতে যান তিনি। এ সময় সমকালীন ইউরোপের অনেক বড় মাপের দার্শনিকদের সাথেও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠে সার্ত্রে’র। যদিও সার্ত্রে’র জীবন ও কর্মের ওপর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় ফরাসি সৈন্যবাহিনীর সাথে একজন ‘মেটেরোলজিস্ট’ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবেই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে যান সার্ত্রে। তাঁর দার্শনিকতা ও জীবন জিজ্ঞাসা আরও ব্যাপক আকাঙক্ষার জন্ম দেয়। ফলে একদিকে তিনি ১৯৩৫ সালে প্যারিসের লিসে কঁদরসে শিক্ষকতা শুরু করেন। অন্যদিকে এডমুন্ড হুসরল ও মার্টিন হাইত্তোগার-এর কাছে দর্শনশাস্ত্র পাঠ করতে থাকেন। এভাবেই চলতে থাকে তাঁর দর্শনচর্চা। কিন্তু এর মধ্যে বেজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এ সময় তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি নাৎসীদের হাতে বন্দীও হন। জার্মানদের হাতে যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থাতেই রচনা করেন তার প্রথম নাটক। যদিও অসুস্থতার কারণে বন্দি হবার বছরখানেকের মাথাতেই সার্ত্রেকে মুক্তি দেয় নাজি বাহিনী। তবে যুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তার পর্যবেক্ষিত বাস্তবতা গভীর ছাপ ফেলে যায় সার্ত্রে’র জীবন ও দর্শনে। এ সময় প্যারিসে ফিরে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত একটি আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপে(নাৎসী বিরোধী দলে)র সাথেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন সার্ত্রে। সেই সাথে ক্রমান্বয়ে বেগবান হতে থাকে সার্ত্রে’র স্বতন্ত্র লেখনীও। বিশেষ করে ১৯৪৪ সালে প্যারিসে যুদ্ধাবসানের সময়কালে জোরদার লেখনী দিয়ে ক্রমেই তার দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে অন্যদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন সার্ত্রে। এরপর তিনি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। তাঁর এসব বক্তৃতা খুবই প্রশংসিত হয় এবং তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই পাশ্চাত্য জগতের এ দার্শনিক চিন্তানায়ক সারাবিশ্বে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেন। মার্কসবাদ ঘেঁষা তাঁর দার্শনিক মতবাদ তাঁর মনোভঙ্গিও তদনুরূপ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ল’ ত্রে এত্ল্য নিয়াত বা বিং এন্ড নাথিং নেস প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। এরপর তাঁর নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ ‘লেস্ শেমিনস্ দ্য লা লিবার্তে’ তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। সার্ত্রের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ‘ক্রিতিক দ্য লা রেসঁ দিয়া লেক্তিক’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৭১ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্লরেয়ার’ প্রকাশিত হলে সারাবিশ্বে বিস্ময়কর আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
ব্যক্তিজীবনে সমাজতান্ত্রিক কোনো দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও নানা সময়ে তার লেখনীতে খুঁজে পাওয়া যায় এ ধারার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি। এছাড়া নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিশ্বাস ও স্পষ্ট ভাষণের কারণে নানা সময়ে বহু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে সার্ত্রেকে। এমনকি আলজেরিয়ায় ফরাসি আগ্রাসন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধেরও কট্টর সমালোচক ছিলেন সার্ত্রে। অন্যদিকে নানা সময়ে সার্ত্রে’র যে লেখনীগুলো তাকে বিশ্ব-দরবারে স্বতন্ত্র পরিচিতি এনে দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হওয়া সার্ত্রে’র প্রথম উপন্যাস ‘লা নাজি’, ‘দ্য মুর’, ‘ব্যারিওনা’ (প্রথম নাটক), ‘দ্য ফ্লাইজ’, ‘নো এক্সিট’, ‘দ্য এজ অব রিজন’, ‘দ্য রেসপেক্টফুল প্রস্টিটিউট’, ‘দ্য ভিক্টরস’, ‘দ্য চিপস্ আর ডাউন’, ‘ইন দ্য ম্যাস’, ‘ডার্টি হ্যান্ডস’, ‘ট্রাবলড পি’, ‘দ্য ডেভিল অ্যান্ড দ্য গুড লর্ড’, ‘কিন’, ‘দ্য কনডেমড অব আলটোনা’, দ্য ট্রোজান ওম্যান’, ‘দ্য ফ্রড সিনারিও’ প্রভৃতি। মূলত উল্লিখিত এ সবগুলোই ছিল সার্ত্রে’র লেখা উপন্যাস, নাটক ও ছোটগল্পের তালিকা। আর এসবের বাইরে দার্শনিক যেসব প্রবন্ধ ও সমালোচনা দিয়ে সার্ত্রে বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন তার মধ্যে রয়েছে ‘ইমেজিনেশন : এ সাইকোলজিক্যাল ক্রিটিক’, ‘দ্য ট্রানসেন্ডেন্স অব দ্য ইগো’, ‘স্কেচ ফর এ থিওরি অব দ্য ইমোশন্স’, ‘দ্য ইমেজিনারি’, ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’, ‘এক্সিসটেনসিয়ালিজম ইজ এ হিউম্যানিজম’, ‘সার্চ ফর এ মেথড’, ‘ক্রিটিক অব ডায়ালেকটিক্যাল রিজন’, ‘এন্টি সেমাইট অ্যান্ড জিউ’, ‘বদলেয়ার’, সিচুয়েশন সিরিজ (ওয়ান টু টেন), ‘ব্ল্যাক অরফিউজ’, ‘দ্য হেনরি মার্টিন অ্যাফেয়ার’ প্রভৃতি। এছাড়া সার্ত্রে’র লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সার্ত্রে বাই হিমসেল্ফ’, ‘দ্য ওয়ার্ডস’, ‘উইটনেস টু মাই লাইফ কোয়াইট মোমেন্টস ইন এ ওয়ার’ এবং ‘ওয়ার ডায়েরি’স’। ব্যক্তি মানুষের হয়ে কলম ধরার কারণে বহুবারই পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন সার্ত্রে। এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে বেশ ক’বার।
আগেই বলেছি জঁ-পল সার্ত্র্ প্রথাবিরোধী লোক। তিনি বিয়ে করেননি, বিখ্যাত ফরাসী নারীবাদী লেখিকা সিমন দ্য বুভেয়ার সাথে বসবাস করেছেন আজীবন। সার্ত্রে ও বান্ধবী বুভেয়া’র মিলে ‘লেস ভেজপস মোদারনেস’ নামক মাসিক পত্রিকা বের করতেন। এ পত্রিকাটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তাঁর বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু বেঁকে বসেন জা পল সার্ত্রে। যথাসময়ে তাঁকে এ পুরস্কার দেয়া হয়নি। এই অভিযোগ তুলে তিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। এমনি ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। অবশেষে ফুসফুস সংক্রান্ত জটিলতা এবং শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৪ বছর বয়সে জন্মস্থান প্যারিসেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহান দার্শনিক, চিন্তানায়ক জ্যঁ পল সার্ত্রে।
এই গেলো ওনার জীবন আর কর্ম !
বজলুল করিম বাহার সাহেবের একটা লেখা পাইলাম , সার্ত্রকে নিয়া , তিনি শিরোনাম দিয়েছেন -
এক বিশ্বমনীষার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গ
[ তো এইবারে পড়া যাক ]
এক বিশ্বমনীষার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গ
জাঁ-পল সার্ত্র। বিশ্বের প্রতিভাশালী দার্শনিকদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। যাঁর প্রতিভা, মানবমুখিনতা ও মেধাচিহ্নিত মৌলিকতা বিশ্বের দর্শন ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছিল। তাঁর দার্শনিক জীবন শুরু হয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে। সে সময়টা ছিল এক ক্রান্তিকাল। দুই মহাযুদ্ধের তান্ডব ও ধ্বংসলীলায় গোটা বিশ্বের মানবজাতি তখন রক্তাক্ত, আহত, পীড়িত ও মুমূর্ষু অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছিলো। মানুষের আর্থসামাজিক অস্তিত্ব ভেঙ্গে পড়েছিলো। এ ধরনের দুর্দশা ও ব্যক্তি সংকট মানুষ এর আগে কখনো এভাবে প্রত্যক্ষ করেনি। হতাশা ও নৈরাশ্যবোধ তাকে আক্রান্ত করেছিলো। শান্তি ও স্বাধীনতা হয়েছিল বিলুপ্ত। এ সময়েই গোটা মানবজাতির রক্ষাকর্তা হিসেবে যেন আবির্ভূত হয়েছিলেন এই বিশ্বনন্দিত দার্শনিক। তাঁর দর্শনের সারবস্তু ছিল ‘এগজিস্টটেনশিয়ালিজম।’ অস্তিত্ববাদ। তিনি এই দার্শনিক তত্ত্বের আড়াল থেকে ঘোষনা দিলেন যে, Existence is prior to essence মানুষের স্বাধীন অস্তিত্ব তার সত্তার আগে। মানুষের অস্তিত্বই হচ্ছে তার স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করা। প্রথমে মানুষ আসবে, তারপর স্বাধীনতার বিষয়টি আসবে, এমনটি নয়। মানুষের সত্তা এবং স্বাধীনতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জীবন জুড়ে সক্রিয় থাকে।
১৯৪৩ সালে সার্ত্র অস্তিবাদের উপর লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ। যার নাম বিং এন্ড নাথিংনেস। সত্তা ও শূণ্যতা। এতে তিনি সত্তার দুটি দিক বিশদ আলোচনার দ্বারা বুঝিয়ে দিলেন। বিং ফর ইটসেলফ ও বিং ইন ইটসেলফ। একটি নিজের জন্য সত্তা ও পরটি নিজের মধ্যে স্থিত সত্তা। নিজের মধ্যে স্থিত সত্তা হচ্ছে এই জড় জগৎ। আর নিজের জন্য সত্তা এমন কিছু যা থাকে না। চেতনা সর্বদা কোন বিষয়ের চেতনা হিসেবে বিরাজ করে। অন্য কোন কিছুর দিকে ধাবমান অথচ তা চেতনা নয়। সেজন্য গতিশীল চেতনা একটি শূণ্যতা। সার্ত্রের মতে মানবিক বাস্তবতাই হচ্ছে চেতনা। এটি এমন একটি সত্তা যার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায়। যেহেতু এ ধরনের সত্তা তার থেকে স্বতন্ত্র একটি সত্তার সাথে বিজড়িত। মানবিক সত্তাকে কোন কিছু দিয়ে নির্ধারন করা যায় না।
সার্ত্র তাই বললেন, “আমার স্বাধীনতা মূল্যের একমাত্র ভিত্তি এবং কোন মূল্য আমি নেবো, তার কোন নিয়ম নেই। মূল্যের ভিত্তি হয়ে আমার স্বাধীনতা উদ্বিগ্ন, অন্যদিকে তার কোন ভিত্তি নেই। সার্ত্রে মনে করতেন, উদ্বেগ্নজাত স্বাধীনতা প্রত্যেক যুগের মানুষের স্বাভাবিক ও সার্বজনীন অবস্থা। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন মানুষের এই স্বাধীণতা প্রতিনিয়ত কীভাবে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, উৎপীড়িত, যুদ্ধ ও নবৎসী অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছে। সার্ত্রে শুধু দার্শনিক ছিলেন না। তিনি একাধারে ছিলেন বিপ্লবী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সমাজতাত্ত্বিক শিল্পী। সমসাময়িক কালে এমন কোন অত্যাচার, নির্যাতন বা নিপীড়ন হয়নি, তিনি যার সমালোচক ছিলেন না। আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন, স্পেনের ফ্যাসিবাদী ফ্রাঙ্কো সরকারের বিরুদ্ধতা, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া- সর্বত্র সব ধরনের বর্বরতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রকাশ্য সমালোচক। বিরুদ্ধ মতালম্বী।
১৯৬০ সালে আলজিরিয় মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একজন ফরাসী হয়েও ফরাসী সরকারের এই বিরোধীতায় তিনি যুক্ত হন। তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁর বিচার দাবী করা হয়। তাঁর বাসভবনে দু দুবার বোমা ফেলা হয়। সামরিক আদালত থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কৈফিয়ৎ তলব করা হয়। এর প্রতি উত্তরে সার্ত্রে এক অসাধারণ বিবৃতি দেন, যা তৎকালীন ফরাসী দ্যগলীয় সরকারের গদিকে টলিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তিনি এর জবাব দ্ব্যর্থহীন জোরালো ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, সামরিক আদালতের শুনানিতে উপস্থিত হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। সে কারণে আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার মনোভাব কথঞ্চিত বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে আমি উৎসুক। অভিযুক্তদের সাথে আমার পূর্ণ সংহতি ঘোষণা করা বস্তুত সামান্য কথা; কেন এই সংহতি সেটা বলা দরকার। …এখানে একটা অস্পষ্ট ধারনা দূর করা প্রয়োজন। আলজিরিয় সংগ্রামীদের সাথে তিনি যে সংহতি স্থাপন করেন তার মূলে কোনো মহৎ নীতি নেই, অথবা যেখানেই অত্যাচার সেখানেই তা প্রতিরোধ করবার কোনো সাধারণ সংকল্প নেই। তার মূলে আছে ফ্রান্সেরই পরিস্থিতির রাজনৈতিক বিশ্লেষন। প্রকৃত পক্ষে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা অর্জিত হয়ে গিয়েছে। তা দেখা দেবে এক বছর অথবা পাঁচ বছরের মধ্যে। ফ্রান্সের সঙ্গে মিটমাট করে অথবা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গণ ভোটের পর অথবা সংঘর্ষের আন্তর্জাতিক ফয়সালার মারফৎ। ঠিক কিভাবে আমি আমি জানিনা। কিন্তু এই স্বাধীনতা ইতিমধ্যেই এক বাস্তবসত্যে পরিণত হয়েছে। …অতএব, আমি আবার বলছি এ স্বাধীনতা নিশ্চিত। যা নিশ্চিত নয় তা হল ফ্রান্সের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। কারণ আলজিরিয় যুদ্ধ এই দেশকে পচিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্রমবর্ধমানতার সংকোচন, রাজনৈতিক জীবনের বিলোপ, দৈহিক নিপীড়নের সর্ব ব্যাপকতা, অসামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক শক্তির স্থায়ী বিদ্রোহ যে বিবর্তন সূচিত করেছে তাকে বিনা অতিরঞ্জনে ফ্যাসিস্ট বলে অভিহিত করা যায়।’
জাঁ-পল সার্ত্র নিঃসন্দেহে ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। একই সঙ্গে দার্শনিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক। তাঁর দর্শন কেবলমাত্র জগত ও জীবনকে ব্যাখ্যা করে না; এসবের পরিবর্তন করতে চায়। দর্শনের ভাবনাকে তিনি শুধু তত্ত্ব হিসেবে রেখে দেননি, এসবের মূল্য যাচাই করে বাস্তবায়িত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অসাধারণ বিবেকবান মানুষ ছিলেন। তাঁর সদাজাগ্রত বিবেক ও দায়িত্ববোধ সর্বখালে এক দৃষ্টান্ত হিসেবে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন আশাবাদী। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা ছিল মনুষত্ব অর্জন। ছিলেন আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান এক আপোষহীন যোদ্ধা। যিনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে রক্ষা করার সংকল্পে এক আপোষহীন সমাজতান্ত্রিক যোদ্ধা। বিশ শতকের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু তিনি এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। নোবেল কমিটির অনুরোধ ও নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের এ ধরনের বিরল ঘটনা বোধ করি নজির মেলা ভার। নোবেল পুরস্কারের মতো বিশ্বশ্রুত আন্তর্জাতিক সম্মানকে তিনি যে ভাষায় এবং যে যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তার দৃষ্টান্তা আর নেই। এ প্রসঙ্গে নোবেল পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, পুরস্কার অস্বীকার করার যুক্তিটি তাঁর ব্যক্তিগত ও বস্তুগত দুই-ই হতে পারে। ব্যক্তিগত যুক্তি এই যে তাঁর এই প্রত্যাখ্যান করাটা তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত নয়। কারণ চিরকালই কোন অ্যাকাডেমিক সম্মান তিনি প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। যুদ্ধের পর তাঁকে ‘লিজিয়ন অব অনার’ প্রদান করার প্রস্তাব উঠেছিল। তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে কলেজ দ্য ফ্রান্সে তাঁকে একটি উঁচু পদে আসীন করার প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এইসব সিদ্ধান্ত লেখক হিসেবে আমার যা ভূমিকা সেই ধারণার ওপর নির্ভর করে হয়েছে। একজন লেখক যিনি রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাহিত্যগত দিকের পক্ষ নিয়েছেন, তিনি শুধুমাত্র সেসব অর্থবহতার প্রতিই বিশ্বাস রাখতে পারেন। তিনি বিশ্বাস রাখেন যা তাঁর লিখিত শব্দ। যে কোন সম্মানই তিনি গ্রহণ করুন না কেন, তা তাঁর পাঠকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যা আমার পছন্দ নয়। জাঁ পল সার্ত্র স্বাক্ষরটা এক জিনিস; আর জাঁ পল সার্ত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্বাক্ষরটি অন্যকিছু। সুতরাং লেখক নিজেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দিতে পারেন না, এমন কি কোন সম্মানজনক পরিবেষ্টনরি মধ্যেও, যেমন বর্তমান এই অবস্থায়। …আমার কাছে এর অর্থ আরও বাস্তব স্বাধীনতা- এক জোড়ার চেয়ে বেশী জুতো থাকার এবং খিদে পেলে খাওয়ার অধিকার। সেখানেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানকে গ্রহণের চেয়ে কম বিবাদজনক মনে হয়েছে আমার। গ্রহণ করলে আমার বর্ণনা মতো নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া হবে।”
কথিত আছে বাংলাদেশের একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রবল চিন্তাশক্তির এক আগ্নেয় পাহাড় ছিলেন তিনি। তাঁর এই চিন্তার উৎস ও অণুরনন ছিল মস্তিস্ক থেকে হৃদয় অবধি ব্যাপ্ত। চিন্তার এই আনবিক ক্ষমতা এবং সততার যোগসূত্র বিশ শতকের আর কোনো মনীষীর ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়নি। তাঁর সতীর্থ অনেকেই এজন্য মন্তব্য করতেন, ‘বোধহয় এক ঘুমোনোর সময় ছাড়া সার্ত্র সর্বক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকতে পছন্দ করতেন।’
জীবনযাপনেও ছিলেন এক ব্যতিক্রমী বিরল মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পাঠের সময় পরিচয় হয় আর এক প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকার সঙ্গে। নাম সিমন দ্য বোভোয়ার। আজীবন একত্রে ছিলেন। যুগতল জীবনযাপনে আমৃত্যু কাটিয়েছেন এই মেধাবী নারীর সংসর্গে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হননি। কোন অভ্যাসের যান্ত্রিকতায় নিজেকে সম্পর্কিত করেননি কখনো। লেখকের দ্য ট্রায়ল ও নসিয়া এই দুখানি উপন্যাস বিশ্বসাতিহ্যে এক অতুলনীয় নক্ষত্র হয়ে রয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যে তিনিই প্রথম এন্টি নভেলের সার্থক স্রষ্টা।
সার্ত্র ব্যক্তির স্বাধীন বিশ্বাসকে সমর্থন করতেন। তিনি মনে করতেন, বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি ও বিশ্বাসের সততার যদি জোর থাকে তবে সকল অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত ব্যক্তি তার দৃষ্টি শক্তি দিয়েই লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। এই লড়াইয়ে শেষাবধি অত্যাচারীতেরই জয় হয়। সার্ত্র একথাটি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন
লক্ষ্য করুন পাঠক মান্যবর -
ইহা একটি কপি পেস্ট টাইপ পোস্ট, কিছূই মৌলিক নহে, মূলত বিজ্ঞানের অপ্রচলিত কিন্তু কৌতূহলী সব বিষয় এর প্রাথমিক কথা উল্লেখ থাকবে।