somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিশেল ফুকোর বাতি জ্বালানি - সলিমুল্লাহ খান ( প্রথম পর্ব)

২৩ শে জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪)

মুখবন্ধ

নিচের প্রবন্ধটি বর্তমান লেখকের বলা একটি বক্তৃতার লিখিত ভাষ্য।
তত্ত্বজ্ঞানী জাক দেরিদার সঙ্গে ফুকোর মতভেদ প্রকৃত প্রস্তাবে মহাত্মা লাঁকার শিক্ষার দুই দিক নিয়ে টানাটানির অধিক নয়। জাক লাকাঁ ভাষার বা পদের একাধিপত্য বলে যে উপপাদ্য প্রচার করেন, দেরিদা সেই বক্তব্যই নিজের বলে জাহির করেছিলেন। ‘লেখার বাহিরে কিছু নাহিরে’ বলে তিনি বেশ বাড়াবাড়ি করেছিলেন বৈ কি ।

মিশেল ফুকো আঁকড়ে ধরেন জাক লাকাঁর অপর একটি উপপাদ্য। এই উপপাদ্য অনুসারে মানুষের ইতিহাসে ভাষাই শেষ কথা নয়, শেষ কথা ‘সহজ মানুষ’ বা সাবজেক্ট। যে ইতিহাসে অর্থ তৈরি করে থাকে তাকেই সহজ মানুষ বলে। জীবনের শেষদিকে ফুকো প্রকারান্তরে সেই সত্য স্বীকার করেছিলেন। বাতি জ্বালানি বা এনলাইটেনমেন্ট বিষয়ে মহাত্মা ফুকোর বক্তব্যে সেই অঙ্গীকারের পুবাল হাওয়ার ছোঁওয়া পাওয়া যায়।

সকলেই জানেন মনীষী মিশেল ফুকো ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৪ (অর্থাৎ তাঁহার অকাল মৃত্যুর পূর্ব) পর্যন্ত ফরাসি দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যালয় কলেজ দহ ফঁসের অধ্যাপক ছিলেন। অনেকেই জানেন তিনি ঐ বিদ্যালয়ে যে অধ্যাপনার পদ অলংকৃত করতেন তার নাম ছিল ‘চিন্তাজগতের ইতিহাস’। ইতিহাস বিচারে প্রতিষ্ঠালব্ধ ফরাসি মনীষী ফেরনঁ ব্রদেল (Fernand Braudel) প্রস্তাবিত পদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ করেন তিনি। ব্রদেল যেখানে এক যুগের সহিত অন্য যুগের যোগধর্ম বা ‘কনটনুয়িটি’ আবিষ্কার করার দিকে মন সংযোগ করতেন সেখানে ফুকো যুগান্তর বা এক যুগের সহিত অন্য যুগের বিয়োগধর্ম অথবা ‘ডিস্কনটনুয়িটি’র জয় ঘোষণা করতে বিস্তর দিনক্ষণ ব্যয় করেছিলেন। (দান্তো ১৯৯৮: ১৮১-৮২)

এই দিক থেকে দেখলে ‘মানুষের অবসান’ বিষয়ে ফুকো প্রচারিত বিতর্কে বিয়োগধর্মই বড় মনে হয়েছিল। অথচ এনলাইটেনমেন্ট ওরফে ‘বাতিজ্বালানি’ বিষয়ে তাঁর কহতব্য কী হিসাব করলে বিপরীত সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য ঠেকে। হিয়ুম্যানিজমে নাস্তিক্যজনিত অনিকেত ফুকো শেষ পর্যন্ত এনলাইটেনমেন্টে আস্তিকতা অর্জন করেছিলেন।

মূল বক্তৃতা

ফুকো এন্ড দি ইরানিয়ান রেভলুশন এই নামে একটা বই ইংরেজিতে বেরিয়েছে। এটা তাঁর লেখার কালেকশন। বইটা এখনও আমার হাতে আসে নাই। আপনারা অবশ্যই জানেন ঢাকায় গবেষণা করতে বড় অসুবিধা - সাহিত্যের, বইপত্রের অভাব। আপনি যদি এয়ুরোপীয় বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করতে চান, আপনার এয়ুরোপীয় ভাষা জানতে হবে। আর ভাষা জানলেও চলবে না, এয়ুরোপীয় মালটা, মেটারিয়েলটা তো বাজারে বা লাইব্রেরিতে পেতে হবে। আমাদের এখানে এমন কোনো লাইব্রেরি নাই, যেখানে আপনি গোছানোভাবে এয়ুরোপীয় সাহিত্য পাবেন। তো আমরা নির্ভর করি সাধারণ ব্যক্তিগত যোগযোগের উপর।

এখন ‘ফুকো’র এই লেখাগুলো সম্পর্কে একটা বাড়তি কথা আছে।

ইরানের বিপ্লব সম্পর্কে উনি কিছুদিন উৎসাহ বোধ করেছিলেন। অবশ্য পরে সেই উৎসাহের আগুনে কিছু বালিও ঢেলে দেয়া হয়। ঢেলে দেন তিনি নিজেই। সেইজন্য আমরা এ বিষয়ে তাঁর লেখা সব আর সহজে পাই না। এগুলো ঠিক তাঁর বন্ধুরাও আর ছাপতে চান না। ঘটনাচক্রে এই লেখাগুলোর একটা ইংরেজি সংকলন বেরিয়েছে ফুকো এন্ড দি ইরানিয়ান রেভলুশন নামে। আগেই বলেছি, সেটা আমি জোগাড় করতে পারি নাই। সৌভাগ্যের মধ্যে ফরাসিতে যে কয়টা লেখা বের হয়েছে সেগুলো আবার আলাদাভাবেও অনুবাদ হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, আমি পড়েছি ওই কয়টাই ।

এসব লেখা ফুকোর তিনটা ইংরেজি বইয়ে পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুর পরে এসেনশিয়াল রাইটিংস্ অব মিশেল ফুকো নামে প্রকাশিত হয়েছে এগুলো। এক ভলিয়ুমের নাম এথিক্স। দ্বিতীয়টার নাম এস্থেটিকস্। তিন নম্বরের নাম পাওয়ার। আমার হাতের এই বই [ফটোকপি দেখিয়ে] আমি কিছু কিছু এইসব থেকে তৈরি করেছি।



আমাদের এই সেমিনারের বিষয় মিশেল ফুকো। আমরা বাংলায় বলছি ‘মিশেল ফুকো বোধিনী’। ইংরেজিতে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিশেল ফুকো’। তো এখন প্রশ্ন হবে, সবাই বলবে - ‘মিশেল ফুকো’তে আমাদের আগ্রহ কেন? উত্তর হতেই পারে যে মিশেল ফুকো সম্পর্কে যে কোনো লোক যখন আগ্রহী আমরা তখন আগ্রহী হবো না কেন? কিন্তু আমি বিশেষ বলছি ফুকো কখন বিখ্যাত হন।

ফুকোর বিখ্যাত থিসিসের কথা ছেড়ে বললে বলা যায়, তাঁর প্রথম বিখ্যাত বই ১৯৬৬ সনে প্রকাশ পায়। সেই বইয়ের নাম ইংরেজিতে দি অর্ডার অব থিংস। এইটা অনুবাদ। ১৯৭০ সনে হয়েছে। মূল নাম ছিলো ‘লে মো এ লে শোজ’ (Les mots et les choses) মানে ‘ওয়ার্ডস এন্ড থিংস’। এই বইয়েরই ইংরেজি নাম হয়েছে ‘দি অর্ডার অব থিংস’।

সাবটাইটেলটা লক্ষ্য করবেন: ‘এন আর্কিওলজি অব দি হিয়ুম্যান সায়েন্সেস’। ফ্রান্সে যেটাকে ‘হিয়ুম্যান সাইন্সেস’ বলে ইংরেজিতে তাকেই আমরা ‘হিয়ুম্যানিটিজ’ আকারে চিনি। সেখান থেকে তিন চারগুচ্ছ বেছে নিয়েছেন ফুকো। তাদের জন্মবৃত্তান্ত - মানে ইতিহাসই বলা যায় - আলোচনা করেছেন। তার মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন। যেটাকে আমরা পশ্চিমে হিয়ুম্যানিজম বলি সেটা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করার মত। আমি ফুকোর থিসিসটা সংক্ষেপে আপনাদের বলছি। এতদিন যেমন আমরা মনে করতাম, হিয়ুম্যানিজম ও এনলাইটেনমেন্ট একই জিনিস। এই দুইটা বড় বড় শব্দ পশ্চিমা দর্শনে আছে, এই দুইটাকে আমরা প্রায় একই মনে করতাম। অথচ এই দুই জিনিস এক জিনিস নয়। দুইটাকে আলাদা করতে হবে।

১৯৬৬ সনে ফুকো বলেছিলেন ‘আমি হিয়ুম্যানিজম জিনিসটা পছন্দ করি না’। কারণ ‘হিয়ুম্যান’ কথাটাই অসার ও অর্বাচীন। হিয়ুম্যানিজমের সমালোচক হিসেবেই তিনি এই বইটা লেখেন। যদিও দেখবেন নাম আছে ‘হিয়ুম্যান সায়েন্সেস’, তথাপি খেয়াল রাখবেন ‘হিয়ুম্যান সায়েন্সেস’ যে অর্থে বলা হয় সেই অর্থে হিয়ুম্যানিজম বলাও চলে। যেমন ধরেন আগে স্কুল কলেজে যে বিষয়বস্তু পড়ানো হতো, যেমন গ্রামার বা বলা যাক আরবিতে যাকে বলে তফসির বা ইন্টারপ্রিটেশন, সেই ধরনের জিনিসকে ‘হিয়ুম্যান সায়েন্সেস’ এয়ুরোপখণ্ডে বলা হতো। এয়ুরোপে ওগুলোর নাম ছিল ‘হিয়ুম্যানিস্ট স্টাডিজ’। আমরা যে এখনো হিয়ুম্যানিটিজ গ্রুপ (মানবিক বিদ্যা) আর সায়েন্স গ্রুপ (বা বিজ্ঞান বিদ্যা) যোগে ম্যাট্রিক বা এসেসসি পাস করি ওইটা ওই জায়গা থেকেই এসেছে।

‘হিয়ুম্যানিজম’ কথাটা আস্তে আস্তে অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। একটা উদাহরণ দেখাতে পারি। যেমন আপনি গ্রামার পড়েন। কেন পড়েন? কারণ আপনি ভাষা বুঝতে চান। তা ভাষা পড়েন কেন? কারণ মানুষ ভাষায় কথা বলে। তাহলে, দি স্টাডি অব গ্রামার এন্ড দি স্টাডি অব ল্যাঙ্গুয়েজ ক্যান বি আল্টিমেটলি রেফারড টু ইয়োর ইন্টারেস্ট ইন হিয়ুম্যান বিয়িংস অর দি হিয়ুম্যানিটি এ্যাজ এ হোল। এই হচ্ছে বিষয়। শেষ বিচারে আপনি মানবে আস্থা রাখেন। আপনি মানবজাতিতে আগ্রহী, মানবজাতি কথা বলে সুতরাং কথা বলাটাই মানবজাতির চরিত্র। এই অর্থে আপনিও হিয়ুম্যানিস্ট। এখন আমরা বলি কি আপনি যদি ইতিহাস পড়েন, তো আপনি হিয়ুম্যানিটিজই পড়ছেন। নানাভাবে আমরা শব্দগুলির আকৃতি পরিবর্তন করে দিচ্ছি। হিয়ুম্যানিটি কথাটা লক্ষ্য করেন, এইটা থেকে হিয়ুম্যানিটিজম না হইয়া হইল ‘হিয়ুম্যানিজম’। একসময় একরকম বলা হতো, আস্তে আস্তে এর বদল ঘটলো। শব্দের ইতিহাস ট্রেস করলে, তার পায়ের চিহ্ন ধরে আগাইলে আপনি এটা বুঝতে পারবেন।

খুব সংক্ষেপে বলছি। ফুকো এপিয়ারড ইন ১৯৬৬ এ্যাজ এ ক্রিটিক অব হিয়ুম্যানিজম। লক্ষ্য করেন। এখন হিয়ুম্যানিজম মানেটা কী? আমি সেজন্য বলছি, তখন ফ্রান্সে যে বস্তুকে ‘সিয়ঁস উমেন’ বা ‘হিয়ুম্যান সায়েন্সেস’ বলা হতো সেটাই আমাদের বিদ্যার মানবিক শাখা। ওরা ফ্রেঞ্চে হিয়ুম্যান উচ্চারণ করে উমেন (humaine) আকারে।

এই যে উমেনের সমালোচনা ফুকো করলেন তার সুদ বাবদ ওঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক বারো বছর পর ১৯৭৮ সন নাগাদ উনি ‘এনলাইটেনমেন্ট কী বস্তু?’ নামধারী প্রবন্ধটা লেখেন। এটা সেই ১৯৭৮ সালের প্রবন্ধ। আমি দেখাতে চাচ্ছি বারো বছরের মধ্যে কী পরিবর্তনটা হলো। পরিবর্তনটা হয়ে গেল। ফুকো বলছেন যে, ‘১৯৬৬ সনে কী যেন বলেছিলাম আমি, তার দ্বারা আমি চিরকাল বন্দি থাকবো কেন? আমি তো বন্দি থাকতে বাধ্য নই। আই হ্যাভ এ রাইট টু চেঞ্জ মাই ওপিনিয়ন। প্রত্যেকে নিজের মতামত বদলাতে পারে।’

কিন্তু আমাদের আগ্রহ হলো উনি কী, কোন যুুক্তি দেখিয়ে নিজের মতামত বদলালেন? অথবা তিনি যেটা বলছেন সেটা দিয়ে আমাদের প্রতারিত করছেন না তো? সত্যি বদলেছেন কি নিজের মতবাদ? তখন আরেকটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন আসে, হোয়াট ইজ (হু ইজ নয়) দি রিয়েল মসিয়ঁ ফুকো? আসল ফুকো কোনটা? আমরা দেখব এটাও পরে অনেক লোকের মাথাব্যথার কারণ হবে।

আমি আবার বলি। ১৯৬৬ সনে ফুকো বলছেন, ‘আমি হিয়ুম্যানিস্ট নই, আই অ্যাম এ ক্রিটিক অব হিয়ুম্যানিজম এ্যাজ এন এপ্রোচ।’ আবার পরে বলছেন কি, ‘আই স্টিল রিমেন এ ক্রিটিক অব হিয়ুম্যানিজম। বাট নাউ লেট মি টেক আউট এনলাইটেনমেন্ট ফ্রম দ্যাট ডুয়ো - আওয়ার কাপল্। আগে হিয়ুম্যানিজম বলতে এনলাইটেনমেন্টকেও বোঝানো হতো। কমসে কম ফ্রান্সে বোঝান হতো। সেই জন্যই উনি বলছেন, আমার ক্রিটিসিজম ইজ স্টিল ভ্যালিড ইন সো ফার এজ হিয়ুম্যানিজম ইস কনসার্নড. … ..বাট আই অ্যাম নাউ এ ফলোয়ার অব দি এনলাইটেনমেন্ট ট্রেডিশন।’ কিন্তু আমরা ১৯৬৬ সনে মনে করেছিলাম, হি ইজ এ ক্রিটিক অব দি এনলাইটেনমেন্ট ট্রাডিশন টূও, হি ইজ এগেইন্স্ট দি এনলাইটেনমেন্ট।

আর ১৯৭৮ এর পর থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত (ওঁর মৃত্যু হয়েছে ১৯৮৪ সনে) এই সাত বছর উনি অনবরত একটি ভিন্ন মতবাদ প্রচার করেছেন: হোয়াট উই নিড টুডে ইজ এ নিউ এনলাইনটেনমেন্ট। এয়ুরোপের আজকে দরকার নয়া বাতি। অ্যামেরিকার আজকে দরকার নয়া বাতি। আজ সারা পৃথিবীর দরকার নয়া বাতি।

তাহলে ইনি নয়া ‘বাতি-জ্বালানি’ বা এনলাইটেনমেন্ট (Enlightenment) বলতে কী বোঝাচ্ছেন? আগের লোকেরা এনলাইটেনমেন্ট বলতে কী বোঝাত? তারপর তিনি পরিষ্কার উচ্চারণ করেছেন, আমি যাঁদের উত্তরাধিকারী তাঁদের মধ্যে - আমার পূর্বসূরীদের মধ্যে - ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বটেন। এইটা মনে রাখা দরকার। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলে তাঁর সমসাময়িক দার্শনিক কে? হাবারমাস (Habermas)। মিশেল ফুকোর জন্ম ১৯২৬ সনে। হাবারমাসের ১৯২৯ সনে। মানে ফুকোর চেয়ে তিনি তিন বছরের ছোট। হাবারমাসের একটা বই আছে ‘দ্যা ফিলোসফিকাল ডিসকোর্স অব মডার্নিটি। ওতে একলা ফুকোর উপর আছে দুইটা অধ্যায় আর অন্যান্য দার্শনিকদের উপদেশ মিলিয়ে মোট বারোটা অধ্যায়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বই। তাতে আপনি দেখতে পাবেন মিশেল ফুকো এবং হাবারমাসের মধ্যে কিছু মিল আছে আবার কিছু অমিলও আছে। আমার বক্তব্যের সারকথা এটাই।

মিশেল ফুকো যিনি ১৯৬৬ সনে হিয়ুম্যানিজমের সমালোচকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি ১৯৭৮ সন নাগাদ নিজের মতবাদ খানিকটা বদলিয়ে নিলেন। আমরা এখন অনুসন্ধান করবো, আদৌ তিনি বদলিয়েছেন কিনা। এই আমার প্রস্তাব, এই আমার প্রতিপাদ্য। আমাদের শুদ্ধ দেখতে হবে ফুকোর উপপাদ্যটা কী? উনি কী প্রমাণ করতে চান? হিয়ুম্যানিজমকে উনি যদি বর্জনই করেন তো হিয়ুম্যানিজমের ত্রুটিটা কী? আর উনি যদি নতুন করে এনলাইটেনমেন্টেরই ভক্ত হলেন তবে এনলাইটেনমেন্টের কোন গুণটা আছে যে ফুকো কারণে-অকারণে হিয়ুম্যানিজম-এনলাইটেনমেন্টর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে একলা এনলাইটেনমেন্ট তত্ত্বের আঁচলটি আকঁড়ে ধরেন?


এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথমে লক্ষ্য করবেন যাদের মধ্যে প্রথমে মিলন হয়েছিল, ফুকো প্রথমদিকে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ দেখতে পেলেন। এখন আপনাদের মধ্যে কেউ যদি আবার দুইয়ের মধ্যে নতুন মিলন ঘটাতে পারেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার।

তাহলে আমাদের আলাদাভাবে বলতে হবে হিয়ুম্যানিজম কী জিনিশ, আর এনলাইটেনমেন্টইবা কী বস্তু? তারপর আরেকটা কথা আছে। সেটাও এটার সাথে যুক্ত। আপনারা না বললেও আমি জানি, সেটার নাম ‘মডার্নিটি’, এদের সাথেই যুক্ত। আপনি তিন নম্বর হিসেবে বলতে পারেন। হিয়ুম্যানিজম, এনলাইটেনমেন্ট, মডার্নিটি। এই সব কথা এখনও এয়ুরোপে আলোচিত হয়।

এখন এয়ুরোপের নতুন দর্শনের যে অধ্যায়কে আমরা নাম দিচ্ছি ‘পোস্টমডার্নিজম’, তার প্রবক্তারা বলছেন ‘মডার্নিটি জিনিসটা একসময় জন্ম নিয়েছিল। এখন তার মৃত্যু হয়েছে।’ তারপরে আমরা আরেকটা মতবাদের জন্ম দিচ্ছি। এখন লক্ষ্য করেন এখানে একটা প্রভাবশালী শব্দ আছে ‘টাইম’। মডার্নিটি ইজ এ কনসেপ্ট রিলেটিব টু টাইম। ইট হ্যাজ বিন বর্ন অ্যান্ড ইট লিভড ফর এ হোয়াইল, সো ইট উইল ডাই সামটাইম অন। অর্থাৎ তাকে একটা অর্গানিজমের মত দেখতেছি। মডার্নিটি ইজ লাইক এ বডি, যার জন্ম আছে, বিকাশ আছে এবং মৃত্যু আছে।

কিন্তু মডার্নিটির আরেকটা ধারণাও আছে। এটার প্রবক্তা ‘বোদলেয়ার’। শার্ল বোদলেয়ার। ফরাসি কবি, যাঁর কবিতা আমরা অনেকেই ‘বুদ্ধদেব বসু’র বাংলা অনুবাদে পড়েছি। উনি বড় একজন চিত্র সমালোচকও ছিলেন। তাঁর অনেক চিত্র সমালোচনামূলক লেখা আছে। তার মধ্যে আমি দুইটা প্রবন্ধের রেফারেন্স রেখেছি এখানে, একটার নাম ‘দি পেইন্টার অব মডার্ন লাইফ’। আরো লেখা আছে। সেটার মধ্যে বোদলেয়ার মডার্নিটির সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘মডার্নিটি ডাজ নট রিলেট টু এনি টাইম, ইট ইজ এন এটিচুড’। অর্থাৎ প্রত্যেক যুগেই কিছু লোক আছে যারা মডার্ন আবার কিছু আনমডার্ন। এটা অনেকটা প্রগতি আর প্রতিক্রিয়ার মত। প্রত্যেক যুগেই কিছু ভালো মানুষ থাকে আবার কিছু মন্দ মানুষ থাকে। অর্থাৎ এমন নয় যে পৃথিবীতে মানুষ একসময় সবাই মন্দ ছিলো আর এখন আমরা সবাই ভালো, এমন নয়। মানে আগে সবাই ভালো ছিল আর এখন সবাই মন্দ হয়ে গেছি এরকম নয়। একটু যুগ ছিলো অন্ধকার যুগ আর এখন আলোকের যুগ, এটা ঠিক নাও হতে পারে। অর্থাৎ আলো অন্ধকার দিবালোক আর রাত্রির মত জড়াজড়ি করে থাকে। এই টাইপের একটি মতবাদ বোদলেয়ার বলেছেন। বোদলেয়ার বলেছেন, ‘আধুনিক জিনিসটা একটা মনোভাবের ব্যাপার, এটা সময়ের ব্যাপার নয়, কাজেই আধুনিকতার মৃত্যু হতে পারে না অথবা আধুনিকতা প্রাচীনকালে ছিলো না এটা বলা যাবে না।’

এই জন্যই বলছি প্রাচীন ভারতের মহাভারত কাব্য যদি আপনি পাঠ করেন, সেটাও আধুনিক মনে হবে। হোমারের কবিতাও আধুনিক মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কথা মাঝে মাঝেই বলেছেন। বলেছেন এর মধ্যে একটু ভুলভাল মিশিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন কি, ‘মাঝেমাঝে নদী যেমন বাঁক পরিবর্তন করে সাহিত্যও তাই করে। সেটাই আধুনিকতা।’ কারণ রবীন্দ্রনাথ একটু ইংরেজি পড়ে আন্দাজ করে বলেছিলেন। তাঁর তো ইনজেনুয়িটি আছে, নিজস্ব চিন্তাক্ষমতা আছে। আধুনিকতার সংজ্ঞা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটা প্রবন্ধ আছে। আপনারা দেখতে পারেন। ‘আধুনিক সাহিত্য’ নামে একটা ছোট সংকলন আছে, তাতেও দেখতে পারেন।

তা প্রশ্নটা হলো ‘আধুনিকতা কি স্থায়ী জিনিশ?’ নাকি এটা কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ? এখন যাঁরা পোস্টমডার্নিজম বলছেন, তাহলে তাঁদের এই কথাটার অর্থ কী? একটা হতে পারে যে, আগে মানুষের মনোভাব দুই রকম ছিল। মানুষ ছিল আগে নারী ও পুরুষ । এখন আরেকটা জাতির জন্ম হয়েছে। ধরেন এর নাম হিজড়া। তাহলে দুই লিঙ্গের জায়গায় এখন তিন লিঙ্গ তৈরি করলাম। ভালোমন্দের সাথে মাঝামাঝি আপনি আরেকটা তৈরি করলেন, যারা ভালোও নয়, মন্দও নয়। এরকমই কি আধুনিকতা? নাকি, আধুনিকতা ক্রোনোলজিকাল। এই যে ক্রোনলজি, তা ক্রোনোস বা কালের দেবতার কথা। আমরা বর্ষ ভারতে বলি মা কালি, কালি আমাদের দেবীর নাম। অনেকের ধারণা যে ভদ্রমহিলার চেহারা কালো, তাই তাকে ‘কালি’ বলি আমরা। সেটা পপুলার। সুতরাং বলা যেতেই পারে। কিন্তু এটার মধ্যে আরেকটা কথা আছে, এ কথার অর্থ কালের করাল গ্রাস। কালি মানে ‘গডেস্ অব টাইম’। কাল সবকিছুকে গ্রাস করে। আমরা বলি না ‘তোমারে কালে খাইলো’? মাঝে মাঝে আমরা খারাপ কাল সম্পর্কে বলি আকাল। যথা: ‘আকালের সন্ধানে’।

সমস্যাটা এখানে: আধুনিকতাটা কি ক্রোনোস-এর ভিতরের না বাইরের? বোদলেয়ারের মতটাই আমি সংক্ষেপে বলছি। বোদলেয়ার যেহেতু বলছেন, ‘আধুনিকতা জিনিসটা সময়ের ব্যাপার নয়’ কাজেই আমিও বলবো, ‘পোস্টমডার্নিজম’ কথাটা কোনো অর্থই বহন করে না। ‘সিনস্ দেয়ার ইজ নো মৃত্যু হাউ ক্যান দেয়ার বি পোস্ট মর্টেম?’ যেহেতু মৃত্যু নাই তাহলে আবার মরণোত্তর ময়না তদন্ত হবে কী করে? জীবন্তের কি ময়না তদন্ত হয়? এটা বোদলেয়ারের বক্তব্য। আমি এস্তেমাল করলাম মাত্র।

ফুকো সাহেবও সেই বক্তব্যটাই গ্রহণ করেছেন। গ্রহণ করে ইমানুয়েল কান্টের যুক্তির গাছে ‘গ্রাফ্ট’ করেছেন। গ্রাফ্ট মানে কি? এই যে আম গাছে ‘কলম’ করেন আপনারা। গাছের উপর গাছ লাগিয়েছেন। তাহলে, নতুন একটা বাগান হয়েছে। সেই বাগানের নাম হয়েছে নতুন বাতি-জ্বালানি, নতুন এনলাইটেনমেন্ট। মডার্নিটি ইজ সামথিং ইটার্নাল, ইট হ্যাজ অলওয়েজ বিন। উনি বলছেন এনলাইটেনমেন্টের সংজ্ঞা এই: এনলাইটেনমেন্ট মানে এতদিন যেমন আমরা যা হিয়ুম্যানিজমের সাথে যুক্ত মনে করতাম সেইটা নয়।

একদা ঈশ্বর ছিলেন, এখন তিনি মারা গেছেন। এখন তাঁর জায়গায় প্রবেশ করেছে মানুষ। এটা এয়ুরোপীয় একজন বড় দার্শনিকের উক্তি। নাম নিৎসে। নিৎসের উক্তিটায় বলা হয়েছে কি না, ‘গড ইজ ডেড’। তার মানে ‘গড ওয়াজ ওয়ানস্ এলাইব’। এট লিস্ট। এই স্বীকৃতিটুকু তো আছে। আসুন এখন আমরা শুকরিয়া আদায় করি তিনি স্বীকার করছেন যে একসময় ঈশ্বর ছিলেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘হু হ্যাজ অকুপাইড দি ডেড গডস্ চেয়ার’? এটিকে ব্যঙ্গ করেছে কার্ল মার্ক্সের শত্রুপক্ষ, আমেরিকান মিডিয়া। যেমন টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭৮-১৯৭৯ সালের দিকে একটা হেডলাইন করেছিলো, আমার মনে আছে। আমরা তখন ছাত্র। ওঁরা লিখেছিল, ‘গড ইজ ডেড, মার্ক্স ইজ ডেড এন্ড আই এম নট ফিলিং টুও ওয়েল মাইসেল্ফ’। ফরাসি দেশে আন্দ্রে গ্লুক্সমান বলে একজন দার্শনিক ছিলেন, ইনি কাজ করতেন সার্ত্রের সেক্রেটারি হিসেবে। উনি বলেন যে, ‘পৃথিবীতে এখন আস্তিকতার দিন শেষ হয়ে গেছে, এমনকি কম্যুনিজমের দিনও শেষ হয়ে গেছে, আর আমরা যারা তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি, সেই আমরাও বোধ হয় মারাই যাচ্ছি। তাহলে সামনের পৃথিবীতে কী আছে আমরা জানি না।’ কী এর নিহিতার্থ? তিনি মিশেল ফুকোর বন্ধু ছিলেন সেই সময়। অনেকটা ফুকোলশিয়ান (Foucaultian) বলা যেতে পারে। আমি ফুকোর উপর এটা আরোপ করবো না।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০৮
৬টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×