নীলু নামের মেয়েটি খুবই চঞ্চল। চঞ্চল হলেও কি হবে বাবাতো ওকে আদর করে সবসময় বোকা নীলু বলেই ডাকে। বাবার অভিযোগ, ও ভালো মন্দ কিছুই যাচাই করতে পারেনা। নিজে যা ভালো বুঝে তাই করে বসে। সবসময় নিজের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিলে কি হবে, বোকা হলেও সে অনুযায়ী তার মধ্যে যে রাগ, অভিমান থাকার কথা তার লেশমাত্র নেই। খুবই শান্ত স্বভাবের। বলা যায় যে, যখন যেটা করতে বলে সেটাই করে এর জন্য নিজের ক্ষতি হচ্ছে কিনা সেই বিবেচনাবোধটুকোও নেই। বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সাহিত্য, কবিতা, বিভিন্ন রম্যরচনাই বেশি ভালোবাসে। খুব ইচ্ছে ছিল কবি হবে। প্রেম-ভালোবাসা, রোমান্টিক ট্র্যাজেডির মিশ্রিত এক নতুন অববাহিকা সৃষ্টি করবে সাহিত্যে। কিন্তু সব কিছু কি আর চাইলেই হওয়া যায়? কখনো হয়ত আমাদের ইচ্ছেটার সাথে প্রকৃতির ইচ্ছেটার অমিলের কারনে অনেক স্বপ্নই পণ্ড হয়ে যায়।
আবার হয়ত প্রকৃতি মাঝে মাঝে আমাদের জন্য এমন কিছু চেয়ে বসে যার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না, কখনোই। এবং কখনো তা মন থেকে চাওয়াতো দুরের কথা কল্পনাও করতে পারিনা। তাইতো আজ তাকে সুপ্রিম-কোর্টের শুনানিতে অংশগ্রহন করতে হচ্ছে। কোনো সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নয়, ওর নিজের বাদী হয়ে করা মামলায় উপস্থিত হওয়ার জন্য। জজকোর্ট, হাইকোর্ট সবজায়গায় হেরে যাওয়ার পরও নিজের আত্মবিশ্বাস আর বাবার সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য আজ সে তার ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে।
নীলুর স্বামী নীলয়ও উপস্থিত হয়েছে। নীলয়ের সাথে তার বাবা-মা সহ কিছু আত্মীয়-স্বজন ও ছিল। নীলু তার স্বামীর দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কি একটা অভিমানে চোখের পলক ফালানোর তালেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে দেখেছে খুব ভালো করেই লক্ষ করেছে আজও তার স্বামীর চোখে তার জন্য সম্পূর্ণ জায়গা আছে। একটুও অবহেলার পাত্র হিসেবে গণ্য হয়নি ও। এখনো সেই পুরোনো ভালোবাসাটাই রয়ে গেছে। শুধু নেই এখন আর মতের মিল। হয়ত সেটাও ছিল, কিন্তু বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধার জন্য সে হয়ত আজ নীলুর সাথে ঘর ভাঙ্গার জন্য পুরোপুরি মত দিয়েছে। বিয়ে হয়েছিল প্রায় দু'বছর। ১ বছর ৩ মাস যাওয়ার পর হঠাত নীলয়ের আম্মু যৌতুক এর জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলো আর বিষয়টা হঠাত এতটাই সিরিয়াস হল যে এর দু মাসের মাথায় উকিল নোটিশ আসলো নীলুর বাবার বাড়িতে, যখন সে অসুস্থতার সুবাধে সেখানে গিয়েছিল। এটা কোনো সাধারণ নোটিশ ছিলনা। সরাসরি ডিভোর্স লেটার। উভয় পরিবারই সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল। বিয়ের সময় দেওয়া-থোওয়া নিয়ে কোন চুক্তিই হয়নি। তারপরও নীলুর বাবা তার স্বামীর জন্য এত কিছু গিফট করবে তা হয়ত নীলুর স্বামী কখনো ভাবতে পারেনি। বাবার একমাত্র মেয়ে বলে কথা।
কিন্তু হঠাৎ যৌতুক দাবী করায় নীলুর বাবা তা সহ্য করতে পারেনি। উনার আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছিল। এটা নিয়মিত অপমান করারই অন্যরূপ ছিল। নীলু আজ ভালো করে বুঝতে পারছে ছেলের পরিবারের টাকা-পয়সার প্রতি হয়ত কোনো লোভ থাকেনা কিন্তু যৌতুক দাবী করে তা আদায় করবে এটা সকল ছেলেদের পরিবারের সদস্যদের একটা মজ্জাগত রোগ।
আচ্ছা যাই হোকনা কেন তাই বলে কি ডিভোর্স? অন্য কোন উপায় কি খোলা ছিলোনা, বা কোন মীমাংসার পথ!
নীলু ঝটপট করে তার কাবিন-নামা খুলে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো দেনমোহর এর এখানে খুব স্পষ্ট করে লেখা আছে যে, "আমি দেনমোহর হিসেবে শুধু আমার স্বামীকেই চাই, যাতে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও দেনমোহর হিসেবে তাকে আমার কাছে রেখে দিতে পারি।" খুব উদ্ভট প্রকৃতির দাবী এটা ছিল কিন্তু বিয়ের সময় এই দাবীটাকে কেউ হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেনি যে পরে কোনো ঝামেলা হতে পারে। আবার কেউ হয়ত ভাবতেও পারেনি এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর কখনো ভাঙতে পারে! অথবা এমনও হতে পারে এটা প্রকৃতির কোন একটা খেলা ছিল।
জজকোর্ট থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসার পর হাইকোর্টে এসে মিলল ১০ লক্ষ্ টাকা দেনমোহরের একটা লজ্জাজনক সম্মান। সেতো ১০ লক্ষ টাকা চায়নি ১০ কোটিও নয় সে চায় তার স্বামীকে, তার জীবনকে, তার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে।অবশ্য হাইকোর্ট একবার চেয়েছিল উভয়পক্ষে আপোষ করানোর জন্য কিন্তু কি যে ধর্মীয় কিছু নিয়ম আছে পূর্ববর্তী স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক দুরূহ পথ অতিক্রম করতে হয় এর সাথে হাইকোর্ট কোন সমন্বয় করতে পারেনি, অবশ্য ছেলের পক্ষের কঠিন বিরোধিতা ছিল আপোষ করার ক্ষেত্রে।
নীলু ভেবে অবাক হচ্ছে; মানুষের কি রূপ? দাবী করা ৩ লক্ষ্য ২৭ হাজার টাকা না দেওয়ায় তার জন্য ১০ লক্ষ্য টাকার বিনিময়েও সম্পর্ক নষ্ট করতে কোন দ্বিধা করছেনা। একটা সম্পর্কের প্রতি কোন ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধাবোধের লেশমাত্র দেখতে পাচ্ছেনা। যান্ত্রিকতার কষাঘাতে, বিজ্ঞানের ছোঁয়ায়, সাহিত্য-কাব্য চর্চার অভাবের কারনে মানুষের মধ্য থেকে বিবেকবোধের সাথে সাথে মনুষ্যত্ববোধেরও উধাও হয়ে গেছে।
সবেমাত্র তার পক্ষের উকিল আসলো। পরপরই বিপক্ষের উকিল এসে উপস্থিত। আজকে অবশ্য কোর্টে আসলেও কোন শুনানি হবেনা। আজকে বিচারক শুধু রায় দিবেন। গত শুনানিতে নীলুকে তার মত প্রকাশের জন্য কাঠগড়ায় ডাকা হলে সে একটি মাত্র কথাই বলেছিল; আমি জানি আমি হেরে যাব। আমি এও পরিকল্পনা করে রেখেছি হেরে গেলে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দাবী করব হয়ত তিনি আমাকে সঠিক ফয়সালা দিবেন।আমি মানুষের কাছে সঠিক বিচার প্রত্যাশা করলেও কখনো তা আশা করিনা। কারন এখন মানুষ আর মানুষের পর্যায়ে নেই, সবাই বিবেকহীন হয়ে পরেছ। একটা বিষয় কিন্তু ভেবে দেখা উচিৎ মাই-লর্ড, আইনতো তৈরি করা হয় মানুষ কে সুবিচার দেওয়ার জন্যই। কিন্তু আমাদের তৈরি করা আইন থেকে যদি আমরাই সুবিচার না পাই তাহলে............। (নীলু কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল)
বিচারক সেদিন সব কথা শুনে বলেছিলেন ধর্মীয় পণ্ডিত আর জুরিবোর্ডের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে আজকে রায় দিবেন।
এরই মধ্যে কখন যে বিচারক উপস্থিত হয়ে ভুমিকা-উপসংহার টানতেছিলেন তার সেদিকে কোন খেয়ালই ছিলনা। সে মুখিয়ে ছিল রায় শুনার জন্য। বিচারক যখন বলতেছিলেন ; সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে এই আদালত এই রায় দিচ্ছে যে পাত্র পক্ষ থেকে পাঠানো ডিভোর্স লেটার টাকে বাতিল বলে গণ্য করা হল এবং তাদের সম্পর্কের গুরুত্ব পাত্র-পক্ষকে উপলব্ধি করানোর জন্য নীলু ও তার স্বামী সর্বনিম্ন ৩ মাস হতে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত তার পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা ছাড়া তারা একা থাকবে....................................।
নীলু সাথে সাথে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখল নীলয়ের চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় পানি পড়ছে। ছেলে হলেও আজ মেয়েদের মতই লজ্জাহীনভাবে চোখের পানি ফালাচ্ছে। হয়ত এটা বিজয়ের কান্না ছিল, তাই। বিচারক উঠে যাওয়ার সাথে সাথে সে তার স্বামীকে জনসম্মুখে জড়িয়ে ধরল। নীলয়ের বুকে মাথা রেখে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নীলয়ের হার্ট বলছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলতে চাইনি। তোমার অনুপস্থিতি আমাকে উন্মাদ করে দিয়েছে, আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু কি এক অদ্ভুত মায়ার জ্বালে আমি আটকা পরে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম কি করব বুঝে উঠতে পারতেছিলাম না...।
নীলুর কর্ণকুহরে হঠাত একটা শব্দ আচমকা আরো বেশি ভালোলাগা বয়ে আনলো। নীলুর বাবা ওর আম্মুকে বলছে ; "বোকা মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলেই গেল!"
~অনেকদিন আগের লেখা, কোন পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু গল্পের নামটা পরিবর্তন করেছি।