somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার জাতীয় সংগীত ট্রিটমেন্ট

১১ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল বেলায় বাড়ীর উঠোনে এসে দাঁড়াই। শীতের নরম রোদটা বেশ মিঠে লাগছে। শুক্রবার বলে গ্রামের বাড়ীতে আসবার একটা মওকা পাওয়া গেছে। নলকূপের পানিতেই মুখ ধোয়ার কাজটা সারলাম। মাটির চুলোয় ভাত রান্না হচ্ছে। ফেনাভাত হবে। গাঁয়ে আলু তোলার মৌসুম এসেছে। গোটা কতক আলুও দেয়া হয়েছে ভাতের হাঁড়িতে। ফেনা ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা। সাথে কাঁচা লন্কা আর পেঁয়াজ। ভাগ্য প্রসন্ন হলে এক চামচ গাওয়া ঘি-ও মিলতে পারে। আমার অবশ্য সকাল বেলায় চা দিয়ে শুরু করতে হয়। খুব চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ফারূক জানালো চা খাবার বন্দোবস্ত নেই। ব্যাপারটা বুঝলাম, মাটির চুলো চাইলেই তো আর যখন তখন ধরানো যায় না। তাছাড়া কেউ চা খানে-ওয়ালা নেই বলে চা-পাতাও নেই। সমস্যা নেই। আমজাদ মিয়ার দোকান আছে। এখন আর চা খেতে হলে আড়ং পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয় না। বাসার কাছেই চায়ের ব্যবস্থা। আমি আর ফারূক রওনা দিলাম। বাড়ী এলেই কোত্থেকে যেনএক দঙ্গল পোলাপান জুটে যায় আমার সঙ্গে। ব্যাপারটা আগে হত না, বছর চারেক ধরে ঘটছে। আমার প্রতি ওদের নিখাঁদ ভালোবাসাটা টের পাই। কিন্তু সাত-সকালে সবাই মাঠে গেছে। আলু সময়মত না তুলতে পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। ফারূক কুমিল্লায় একটা ঔষধ কোম্পানীতে চাকরী করে। আমি এসেছি শুনলে তবেই বাড়ী আসে, আর এ ব্যাপারেই চাচীর এন্তার অভিযোগ। বড় পানা পুকুরটা ফেলে বাঁয়ে মোড় ঘুরতেই দেখা মেলে আমজাদ মিয়ার দোকানের। মেঠো পায়ে চলা পথটার ধার ঘেঁষে তৈরী করা হয়েছে। দোকান আর বসবার জায়গা, পুরোটাই বাঁশের মাঁচার ওপরে। আমজাদ মিয়া বয়স্ক লোক। একটাই ছেলে। সৌদিতে থাকে। টুকটাক পয়সা পাঠায়। তা দিয়েই দিন গুজরায় বুড়ো বুড়ির। এক পা নেই বলে মাঠে কাজ করতে পারেন না। মুক্তিযুদ্ধে পা হারিয়ে ছিলেন। চায়ের দোকানটা যতটা না আয়ের জন্য তার চেয়ে ঢের বেশী বৃদ্ধজীবন পার করে দেবার জন্য।
"চায়ে কিন্তু চিনি অইবো না ভাইস্তা, গুড় চলবো?" শনের মত একগাছি দাড়িতে হাত বুলিয়ে মুচকি মুচকি হাসেন বৃদ্ধ। তার হাসিতে ধরা পড়ে তিনি বোঝেন আমাদের চায়ের আকুলতা। চিনির বদলে গুড়ে কথায় যে আমাদের চোখ চকচক করে ওঠে তা দৃষ্টি এড়ায় না বৃদ্ধের।
জায়গাটা ভারী সুন্দর। শীতে পাতা ঝরা শুরু হলেও পাকুঁড় গাছটা এখনও ঘন ছায়া দিচ্ছে। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁক চুইয়ে নামছে নরম রোদ। কোথায় যেন একটা ডাহুক ডাকছে। আমি শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম ভালো করে। ফারূক-কে জিজ্ঞেস করলাম সিগারেট খাবে কিনা। চায়ের সঙ্গে অনেকেই খায় দেখেছি। ফারূক মিথ্যে করে বলল ও ওসব ছাইপাশ খায় না। সম্মানটা কি আমাকেই দেখালো নাকি বৃদ্ধ আমজাদ মিয়াকে এ নিয়ে যখন ভাবছি ঠিক তখনই নিরবতা ভেঙ্গে দিলো ফারূকের মোবাইল। বিরক্ত মুখে ফারূক মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকালো। অফিসের কল। ধরতে ইচ্ছে করছে না। ওর ফোনে রিং সাইলেন্ট করবার ব্যবস্থাও নেই। বিরস বদনে মোবাইল বেঞ্চির পাশে রেখে দিলো।
"জাতীয় সংগীত লাগিয়েছিস দেখছি। বাহঃ"
"ডিসেম্বর আসতেছে ভাইজান। এই কয়দিন ছিলো লাব্বায়েক তাকবীর, তার আগে ছিলো রমজানের ঐ রোজার শেষে। টাইম টু টাইম চেইঞ্জ। আপ টু ডেট থাকা লাগবে না। কি যে বলেন"
আমজাদ চাচা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ক্র্যাচ খুঁজছেন। আমি সেদিকে নজর না দিয়ে ফারূকের সাথে গল্প করতে লাগলাম। একবার ধরেনি। সুতরাং আবারো রিং এলো ফারূকের অফিস থেকে। ফারূক মহাবিরক্ত।
"হারামজাদা এক্কেবারে ফেভিকল। শুক্কুরবারে একটু রেস্ট করবো তার উপায় নাই। আমিও ফোন ধরবো না। দেখি তুই কতবড় রবার্ট ব্রুস হইছস"
আমার দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসতে লাগলো ফারূক। ফোন বেজেই চলল অন্যপাশ থেকে। আমরা গুনতে লাগলাম কয়বার রিং হয়। পাঁচবারের মাথায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো মনে হয়। আমি আর ফারূক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। হাসতে হাসতেই হঠাৎ মনে হল চায়ের কথা।
দেখি আমজাদ চাচা একপায়ে একটা বাঁশের খুঁটি ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। কষ্ট হচ্ছে বোঝাই যায়।
"আরও ফুন আইবো?" কন্ঠে যেন একটু অসহায়ত্ব বৃদ্ধের।
মজা করবার সময়ে খেয়ালই করিনি জাতীয় সংগীত বাজছে। ক্র্যাচ না পেয়ে বৃদ্ধ একপায়েই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভীষণ লজ্জাবোধ হতে লাগলো আমাদের। আর বেশী কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চা খেয়ে চলে এলাম। ঢাকা আসবার পরে মনে হলো, আমাদের মতো করে জাতীয় সংগীত পৃথিবীর কোন দেশের মানুষই ভালোবাসে না (আমি এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত)। তারপরেও আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। দেশের জন্য কিছু দেবার আগে আমরা জিজ্ঞেস করি কি দিলো আমাদেরকে এই দেশটা? এ যেন এক দেনা-পাওনার বিষয়। আমাদের মধ্যে কি তাহলে দেশপ্রেম নেই?

নিশ্চয়ই আছে। আজকে যাদের আমরা ইভটিজিং করতে দেখছি, রাস্তায় গালাগাল করতে দেখছি, তারাও কিন্তু আমাদের সম্পদ হতে পারে। মনে রাখা উচিৎ সর্বস্তরের জনগনের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই এসেছে আমাদের আজকের স্বাধীনতা। এটা ভাবাটা অবান্তর যে, শুধুমাত্র শিক্ষিত, রুচিবোধ সম্পন্ন এবং আচরনে মার্জিত জনগনই আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। কোন কাজ সেটা যত ছোটই হোক না কেন দেশের উপকারে যদি লাগে করে ফেলা উচিৎ। আমি কিছু ইভটিজারকে দেখেছি অন্ধলোককে রাস্তা পেরুতে সাহায্য করতে। একবার দেখলাম অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়া এক রিকশাওয়ালাকে দোকান দোকান ঘুরে সাহায্য তুলে দিতে। ইভটিজিং খারাপ কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওরা যে কাজটা করলো তা নগন্য হলেও আমরা অনেকেই করি না। এ কথা সত্যি যে সব কাজ আমাদের দ্বারা হবেও না, বা হয়ও না। কিন্তু যা করতে পারি, তাও কেন করতে চাই না, তাও কেন ইচ্ছে করে না? তাদের জন্যেই আমার জাতীয় সংগীত ট্রিটমেন্ট। এ ধরণের সমস্যায় পড়লে জাতীয় সংগীত শুনুন। বেশী না। মাত্র একবার। বিশ্বাস করুন, যে মনের জোর আপনি পাবেন তার কোন তুলনা নেই। জাতীয় সংগীত মোবাইলে সেট করে রাখতে পারেন। যখনই মুস্কিল, তখনই আসান। দিনের শুরুও করতে পারেন জাতীয় সংগীতে।
যার দিন শুরু হবে সোনার বাংলাকে ভালোবেসে, তার দিন কি খারাপ হতে পারে?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৫৩
৪৭টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×