লং ড্রাইভে দেখি কম-বেশী সবারই আগ্রহ রয়েছে। অবশ্য শহুরে কোলাহলময় জীবনের চাপে যেখানে প্রাণ তিষ্ঠানো দায় সেখানে লং ড্রাইভ ভালো লাগবারই কথা। তাজা বাতাসেরও যে একটা আলাদা আবেদন রয়েছে তার মূল্যায়ন ঢাকার লোকে করতে পারে বই কি। এ কথা বোঝার মতন অবস্থা ঢাকার বাইরের লোকের এখনও হয়নি। তা না হোক সেটা আমাদের সবারই কাম্য। আসল কথায় আসি। আমার প্রায়ই লং ড্রাইভে যাওয়া হয়। বছরে একবার চাঁদপুরে যাই। ছোট হলেও পঞ্চগড়ে আমাদের এক চিলতে চা-বাগান ছিলো। বাবা বছর দুয়েক আগে বিক্রী করে দিয়েছেন। কাজেই চা বাগান দেখতে এখন শ্রীমঙ্গল যেতে হয়। বছরে কম করে হলেও পাঁচ-ছ'বার যাওয়া হয়, সুতরাং ধার-কর্জ করে একটা গাড়ী কিনেছিলাম। এন্তার পুরোনো জিনিস। পুরোনো চাল ভাতে বাড়বার মতন আমার গাড়ীটাও আমাকে মুগ্ধ করে যাচ্ছে। প্রতিবেশীর নগদ ঈর্ষা কামিয়ে যাচ্ছি নিয়মিত। ড্রাইভারের বালাই নেই, ইচ্ছে হলেই বেড়িয়ে পড়ি। ছোট ভাই-বেরাদররা জুটে যায় সব সময়েই।
আশুগঞ্জ পেরোলেই চোখে পড়ে বিশাল জলাশয়। একেক ঋতুতে তার একেক রকম সৌন্দর্য্য। কোনসময় হয়তো থইথই জল। ডিঙি নৌকা তে-রঙা পাল খাটিয়ে তরতর করে চলছে। কোন কোনটার আবার ধূসর ছই দেখা যাচ্ছে। টুকটাক জেলে নৌকারও দেখা মেলে। আমার তাজা মাছের লোভ হয়। গাড়ীটা রাস্তার পাশে পার্ক করি। সাঙ্গ-পাঙ্গরা হইহই করে ওঠে।
"ঐ মাঝি, এদিকে আস। কি মাছ উঠছে দেখি"
কেউ বলে,"ভাই। ছোটমাছ, কাঁটা হবে। আপনি তো কাঁটা খাইতে পারেন না"
আরেকজন হেঁকে ওঠে,"ভাই। তাজা মাছ। কড়া ভাজি করলে জোস হবে। চিপসের মতন খাবেন। কাঁটা-কুঁটা আলাপ পাইবেন না"
ধানের মৌসুমে এখানে এলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দিগন্ত জোড়া সবুজের সমুদ্র। বাতাসে ধানক্ষেতে ঢেউ খেললে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়। আমার রেগুলার পার্টনারদের মধ্যে কেউ বাদ পড়লে তাকে ফোন করে ঈর্ষান্বিত করা হয়, "তুই আসলি না, আর আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে ভুট্টাপোড়া খাইতেছি"
অপর প্রান্তের আহত কন্ঠ্স্বর হয়তো সত্যতা যাচাই না করেই বলবে,
"হ, তোরাই খা।
আমরা তো কারো ভাই না, তাই কিছু পাই না।
যদি কিছু কই, চুকা লাগে দই।"
অন্তরে জ্বলুনী দেবার পরে ছেলে-পুলেগুলো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে। আমিও মজা পাই ওদের কান্ড দেখে।
রথের মেলা দেখা আমার আরেকটা প্রিয় বিষয়। মেলা দেখতে যেতে হবে রাত দশটার পরে। লং ড্রাইভ অবশ্যই। আশুগঞ্জ পেরিয়ে এগুতে হবে। একজ্যাক্ট জায়গাটার নাম ঠিকানা কিছুই বলতে পারছি না। কারণ মেলাটা অস্থায়ী। একেকবার একেক জায়গায় বসে। হাওড়ের ধারেই বসে অবশ্য।
রাত বাড়বার সাথে সাথে জমে ওঠে মেলা। বড় বড় দু/তিনটে বজরা আসে। হরেক রকম বাতি দিয়ে সাজানো থাকে বজরাগুলো। ভেতরে পাপেট শো'র ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন ধরণের মিঠাই, ছাঁচি, পিঠা, সেওই এর ব্যবস্থা থাকে। স্থানীয় মুসলমানেরা চটপটি, ফুচকার ঠেলা নিয়ে ভীড় জমান। হাওড়ের ধারেই শান বাঁধানো ঘাট। ওখানে বসার দিব্যি ব্যবস্থা।
কে যেন বলেছিলো বজরার ভেতরে নাকি চা খাবার আয়োজন আছে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। যারা পূজোর আয়োজন করেন তাদের খাবার ব্যবস্থা থাকলে অবশ্য আলাদা কথা।
এবার দেশের বাইরের লং ড্রাইভের কথা বলি। একবার ফ্রান্স থেকে সুইটজারল্যান্ডে বাই রোডে রওনা দিলাম। সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার রাস্তা। চাট্টিখানি কথা নয়। দুপুরে ল্যুভ মিউজিয়াম ক্যাফে থেকে খেয়েছি। মরোক্কান খাবার "কুছকুছ"। একদম মিহিদানার মতন হলদে রঙা চাল। ওপরে কি সব পেস্তাবাদাম, কিসমিস আর অলিভ ছড়িয়ে দেয়া। সাথে স্যামন মাছের কারি। এক্সট্রা হিসেবে নিলাম ভেড়ার মাংসের ফ্রাই। ক্যাফের নামটা এখানে একটু জানিয়ে দেয়া দরকার। ওয়ার্ল্ড ক্যাফে। দুনিয়ার হেন খাবার নেই যা মেলেনা ওখানে। কি চাই? ইন্দোনেশিয়ান, চায়নিজ, জাপানিজ, ঈজিপশিয়ান, ইতালিয়ান, সুইস, ডাচ, রাশান, ইন্ডিয়ান, ইরানিয়ান সব খাবার আছে। পরের অংশটুকু খানিকটা ছবি ব্লগের মতোই।
সবাই আইফেলের ছবি দেয়। আমি আপাতত সাধারণ একটা বিল্ডিং-এর ছবি দিয়েই শুরু করলাম। আইফেল, ল্যুভ, বাস্তিল এদের ছবি কম-বেশী আমরা সবাই চিনি। ভ্রমন সংক্রান্ত কিছু লিখলে ছবিগুলো সেখানে দেবার ইচ্ছে রাখি
রাস্তা এখানে আলাদা হয়ে গেছে। আমরা চলেছি বোরডক্স-নান্তেস এর রাস্তায়। সোজা গেলে সুইটজারল্যান্ড। ডানপাশে ইতালী যাবার রাস্তা।
আকাশ মেঘলা। তবে বন্ধুপ্রবরটি জানালেন আমরা অলরেডী মেঘের উপরে উঠে গেছি। সি লেভেল থেকে প্রায় চার হাজার ফুট উঁচুতে। ছবিতে যা দেখছেন সেটা বৃষ্টি নয়, মেঘ। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে। গাছের পাতাগুলো দেখুন। বৃষ্টি পড়বার কোন চিহ্ন নেই সেখানে।
এই যে, আবার মেঘের নীচে নেমে এলাম। রাস্তা-ঘাট সব খটখটে শুকনো।
ফ্রান্সের কান্ট্রিসাইডে গেলে দেখা যায় মাইলের পর মাইল বিস্তৃত আঙ্গুর ক্ষেত। মূলত: আঙ্গুরের খামারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে লোকালয়। আর সেই লোকালয়ের জন্য গড়ে উঠেছে ছোট্ট একটা ব্যাংক, মুদি দোকান, সরাইখানা কিংবা পুলিশ স্টেশন।
গাড়ীর গতি ঘন্টায় ১৬০ কি.মি.। আমি যদিও কিছু টের পাচ্ছিলাম না, স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখলে মনে হয় ভুল বলছে। বন্ধুপত্নি জানালেন প্যারিস আসবার সময় তারা ২২০ কি.মি. গতিতে চালিয়ে এসেছেন। আমি অনেকক্ষণ ধরে জানালার বাইরের এক চিলতে প্রকৃতির ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম। নিরলস চেষ্টার ফসল এই ছবি।
রাস্তার পাশে গাড়ী পার্ক করলাম। চা খাবো।
বাহ্, চায়ের দোকানে আবার দেখি বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খাবার ব্যবস্থাও আছে। মই বেয়ে উঠে গেলেই হলো। সামনে অবারিত প্রান্তর।
মূল চায়ের দোকান। ক্যাফে বললেও আপত্তি নেই। শ্যাম্পেন খাবার ব্যবস্থাও রয়েছে। আমি মেক্সিকান কফি খেয়েছি। উইথ রীচ ফোম।
চায়ের দোকানের পিছনেই সুবিশাল প্রান্তর। একটা গোলপোস্ট দেখে বুঝলাম খেলাধূলা করা হয়।
এটা একটা গ্যাস স্টেশন। চায়ের দোকানের পেছনে। একটা ট্রেলার গ্যাস নিচ্ছে। চায়ের দোকানের পেছনে ছোট্ট একটা সুইমিং পুলও আছে। ছবিও তুলেছিলাম। কিভাবে মুছে গেলো বুঝতে পারছি না।
আবার পথ চলা শুরু। আঁধার ঘনিয়ে এলে আর ছবি তোলা হয়নি। ফ্রেঞ্চ আল্পসের ভেতর দিয়ে প্যাঁচালো সুড়ংগ দিয়ে চললাম আমরা। আঠারো থেকে কুড়িটা টানেল পেরিয়েছিলাম। সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মূহুর্ত হলো যখন দেখলাম রাস্তার একপাশে বরফাচ্ছন্ন চূড়া। খাড়া উঠে গেছে। অন্যপাশে খাদ নেমে গেছে কয়েক হাজার ফুট নীচে। রাতের আঁধারে বরফের রঙ নীলচে লাগছিলো। আমার ক্যামেরার নাইট ফিল্টার নেই। পরেরবার গেলে অবশ্যই কিনে নিয়ে যাবো বলে নিজেকে স্বান্তনা দিতে থাকলাম। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। লং ড্রাইভের পরের অংশটুকু দেখতে পারিনি।
উপসংহার: এমন রোমাঞ্চকর লং ড্রাইভের পরেও একটা কথা না বলে পারছি না। লং ড্রাইভ বললেই আমার চোখের সামনে শ্রীমঙ্গল বা আশুগঞ্জের বিশাল হাওড় ভেসে ওঠে। সেখানে পাইরিনাস কিংবা ফ্রেঞ্চ আল্পসের সেই দুর্গম পাহাড়ী রাস্তার কোন অস্তিত্ত্ব নেই। আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করতে থাকে আমার ঝরঝরে গাড়ীটা উদ্দাম ছুটে চলছে। দুপাশে থইথই জল। আকাশজুড়ে মেঘ করেছে। এই বৃষ্টি নামলো বলে।
উৎসর্গ: প্রিয় ব্লগার মেহেরুন কে। ওনার পর্যটক হবার খুব ইচ্ছা। দোয়া রইলো উনি যেন পৃথিবীর সব ক'টি দেশ ঘুরতে পারেন।