রিচার্ড লিংকলেটারের একটা মুভি দেখেছিলাম, বিফোর সানরাইজ। ট্রেনে একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের পরিচয় কিভাবে প্রেমে রূপান্তরিত হয়। সম্ভবত একটা রোমান্টিক গল্প এভাবেই শুরু হয়। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এ জাতীয় কিছুই ঘটেনি। জীবন আর সিনেমার মাঝে বিস্তর ফারাক। আমি লিখতে বসেছিলাম ভ্রমনকাহিনী, লেখা শেষে দেখি একে কোনভাবে হয়ত সস্তা কোন প্রেমের উপন্যাস বলেও চালিয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু ভ্রমনকাহিনী? কখনোই না। নিজের অযোগ্যতায় আমি নিজের ওপরই তিতিবিরক্ত, গল্পের নামটাও পর্যন্ত পাল্টানো হল না। পাঠকদের কাছে অনুরোধ থাকলো যেহেতু গল্পটা একটু লম্বা, খানিকটা সময় নিয়েই পড়বেন।
কাস্পিয়ানের পর থেকেই তন্ময় হয়ে ককেশাস রেঞ্জের সৌন্দর্য্য দেখছিলাম। বরফে ছাওয়া উঁচু পর্বত। আর চোখ ধাঁধানো শুভ্রতা। মাঝে মাঝে সরু ফিতার মতন এঁকেবেঁকে যাওয়া নদী। কাঁটাচামচে খানিকটা স্যামন তুলে মুখে চালিয়ে দিলাম। ঘুমিয়েছি বেশ খানিকক্ষণ, ঝরঝরে লাগছে। সম্ভবত এয়ারহোস্টেস হালকা মিষ্টি আওয়াজে জানতে চেয়েছিলো আমি জেগে আছি কিনা এবং খাবারটা আমি এখনই চাই কিনা। আমার ঘুম খুব একটা গাঢ় নয়। ওতেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। মিষ্টি হেসে যদিও বা ধন্যবাদ দিয়েছি কিন্তু ঘুম ভাঙ্গবার জন্য মেজাজটা তখন থেকেই খানিকটা গরম। কিন্তু ককেশাসের বরফের ঠাণ্ডায় মেজাজটা আর কতক্ষন গরম থাকবে? মনটা ভালো হয়ে গেলো। খাবারটা গরম আর চমৎকার। স্মোকড স্যামন উইথ ফ্রেঞ্চ গ্রীন বীন অ্যান্ড অলিভ। স্যামন চিবুতে চিবুতে আমি পিকেল ফর্কে একটা জলপাই গেঁথে নিলাম, যেই মুখে দিতে যাবো অমনি চোখাচোখি হয়ে গেল মেয়েটার সঙ্গে। স্বাগত জানাবার ভঙ্গিতে হালকা একটা হাসি দিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। খুবই সহজ আর স্বাভাবিক। স্মৃতির পাতা হাতড়ে মনে করবার চেষ্টা চালাতে লাগলাম ওকে কোথায় দেখেছিলাম। মনে পড়লো এর সঙ্গেই আমার এয়ারপোর্টে বহুবার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। মেয়েটা চোখে পড়বার মতন সুন্দরী। যতবার চোখ পড়েছে আমিই বরং চোখ নামিয়ে নিয়েছি। আল্লাহ মালুম, আমাকে কোন শ্রেণীর অসভ্য ভাবছে এই ভয়ে। কিন্তু কেনো যেন বারেবারেই চোখ আটকে যাচ্ছিলো ওর দিকে। প্রতিবারই ও হেসেছে। মুক্তোঝরানো হাসি? হুমম, হতে পারে। চার/পাঁচ বছর আগে হলে হয়ত চিন্তাও করতাম না। তখন অনেক মেয়েই ওভাবে হাসত। কিন্তু এখন সেরকম করে হাসবার কথা নয়। শরীরে মেদ জমেছে, হালকা পেট বেরিয়েছে আর চুলেও খানিকটা পাক ধরেছে। সুতরাং, কচি খোকা যে নই তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ওরকম অনেকেই হাসে ভেবে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। কয়েকবার কোলের ওপর রাখা “টাইম” ম্যাগাজিনটায় চোখ বোলাবার ব্যর্থ চেষ্টা নিলাম। নাহ, মাথা থেকে যাচ্ছে না ব্যাপারটা। মেয়েটার চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিলো।এই হাসির সাথে আমি বিশেষ পরিচিত, সেই ভার্সিটি লাইফ থেকেই। ভুল হবার কথা নয়। কথা বলতে চাচ্ছে মেয়েটা। ডানপাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাহ, ওইতো দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণসাগর। কালো নয়, গভীর নীল। মাঝে-সাঝে দলছুট মেঘেরা পেঁজাতুলোর মতন ভেসে বেড়াচ্ছে।
আয়েশিভঙ্গিতে মুখে ফ্রেঞ্চবীন ভর্তি চামচ পুরে শেষ করলাম খাবারটা। তারপর ন্যাপকিন দিয়ে মুখটা যত্ন করে মুছে নিলাম। স্বচ্ছ গ্লাসে হালকা বাদামীরঙা শীতল অ্যাপলজুস নিয়ে হেঁটে গেলাম সামনের সারিতে। কানে হেডফোন গুঁজে সীটের ওপর পা ভাঁজ করে গান শুনছিলো মেয়েটি। হাতে কলম। সীট-ট্রে তে রাখা পাসপোর্ট। খুব সম্ভবত বোর্ডিংকার্ড পূরণ করছিলো। আমার সাড়া পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। ঠোঁটে হালকা হাসি।
“মাইন্ড ইফ আই সিট?”
দুপাশে মাথা নাড়লো ও। রীতিমতন শ্যাম্পুর অ্যাড। কাজেই দেরী না করে বসে পড়লাম। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মেয়েটি। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে আমার হৃদকম্প শুরু হয়ে গেলো। আমি নির্বাক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। খুব বেশীক্ষন হয়ত হবে না। কিন্তু মনে হল যেন অনন্তকাল। টানাটানা ডাগর কালো চোখ কিংবা আয়তলোচন কোন উপমাতেই যেন খাটে না ওর চোখগুলো; কিংবা ওগুলো খুব বেশীমাত্রার কাব্যিক বলে উপমা হিসেবে ব্যবহার করতেও ইচ্ছে হয় না। সোজা কথায় বললে ওর চোখগুলো ভীষণ প্রানবন্ত। স্বচ্ছ ঝকঝকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। কারো হার্টবিট মিস করাবার জন্য যথেষ্ট। গ্লাসে হালকা চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলাম, “আগে কি কোথাও দেখা হয়েছিলো আমাদের?” । দূর ছাই, এতো তৃতীয়শ্রেনীর বাংলাছবি বিবর্জিত ডায়ালগ হয়ে গেলো। মেয়েটাও মনে হল আহত হয়েছে। সম্ভবত আমাকে আরো একটু স্মার্ট ঠাওরে নিয়েছিলো সে। একটু আমতা আমতা করে বললাম, “তুমি কি অপরাজিতা?”
ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে উত্তর এলো। “য়্যু গট মি রাইট”
“আমিও তাই ভেবেছিলাম, ধানমন্ডি ৬ এ থাকো না তুমি?”
“ওটা বাবার বাড়ী। ভার্সিটি কাছে হয় বলে বনানীতে থাকি আমি” - “মামার বাসায়” একটু থেমে যোগ করলো অপরাজিতা।
“চট্টগ্রামে কে কে থাকে?”
“গ্রামের বাড়ী? এখন কেউ থাকে না ওখানে” চোখে কৌতুক অপরাজিতার। যেন কিছুতেই অবাক হবে না বলে পণ করে করেছে। নার্ভ বটে মেয়েটার। আমি গ্লাসে হালকা একটা চুমুক দেই। আর কি জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছিলাম না। অপরাজিতা আমার দিকে চেয়ে আছে। বাঁ পাশের ভ্রু নাঁচালো একবার।
"কি? বোর্ডিং কার্ডে আর কিছু লেখা নেই?"
আমি হেসে ফেললাম। অপরাজিতা হাত বাড়িয়ে দিলো।
"মাই ফ্রেন্ডস কল মি অপি, য়্যু ক্যান ডু সো, ইফ য়্যু লাভ টু"
"আমি নীল"
"আগে পিছে কিছু নেই? নাথিং? পিওর নীল?"
"একদম"
"নীল নামে কাকে যেন চিনতাম...মনে করতে পারছি না"
"কি বলছো? আমাদের কোথাও কোন শাখা নেই"
"য়্যু আর রাইট। দ্যাট ওয়াজ সামওয়ান রুদ্রনীল"
"তো? ইস্তাম্বুলে কোথায় উঠছো?"
"উহু, আমি যাচ্ছি স্টকহোম। ইস্তাম্বুল ইজ আ স্টপওভা"
"বাহ। আমি বোর্ডিং কার্ড লিখতে দেখে ভাবলাম তুমি আমার সাথেই যাচ্ছো।"
"ওহ। কি মজাই না হত" অপির চোখে দুষ্টুমী ঝিলিক দিয়ে গেলো, "বোর্ডিং কার্ড ফিল আপ করা একটা বার্নিং পেইন। প্লেনে উঠেই আমি আগে থেকে ওটা চেয়ে নেই। নামার আগে আই ডোন্ট ওয়ানা ডু দ্যাট হ্যাসল"
বুদ্ধি মন্দ নয়। সত্যি বলতে কি বিরক্ত আমারও লাগে কিন্তু অপি যেভাবে গলায় কেজিখানেক মধু ঢেলে বোর্ডিং কার্ড চাইতে পারে সেভাবে কি আর আমি পারবো?
"ইস্তাম্বুল কেন যাচ্ছেন? বিজনেস?"
আমি হেসে ফেললাম। আমি ছা-পোষা মানুষ কিন্তু সেটা ওকে না বুঝতে দেয়াই ভালো।
"আগে বলো তুমি সুইডেন যাচ্ছো কেন?"
"মাই হাজব্যান্ড লিভস দেয়া"
উরে, কি সাংঘাতিক। এত্তটুকুন মেয়ে বিয়েও করে ফেলেছে। আমি বজ্রাহতের মত ঠায় বসে রইলাম কিছুক্ষণ। অপিও সম্ভবত এটাই আশা করেছিলো। হয়ত ওর সঙ্গে পরিচিত হবার পরে যে কারোর কাছে নিশ্চিতভাবেই বজ্রাহত হবার মত সংবাদ এটাই।
অপির মুখটাও কেমন যেন মলিন। আমার ওর জন্য খারাপ লাগতে লাগলো, একটা ভালো বন্ধু আশা করতেই পারে সে। বিবাহিত হলে কি ভালো বন্ধু পাওয়া যাবে না?
আমি হেসে ফেললাম।
"তো কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো?"
উজ্জ্বল হলো অপির মুখ। "ওয়াট? য়্যু মিন হু ওয়াজ দ্য গাই?"
"হ্যাঁ, সৌভাগ্যবান লোকটি কে?"
"ও এখনও পড়াশুনা করছে। মামাতো ভাই।"
"বাহ। বিয়ের আগেই শ্বশুরবাড়ী? তুমি তো দেখছি ঈর্ষা করার মতন সৌভাগ্যবান"
"ওহ, নো নো নো নো....দ্যাট ওয়াজ এনাদার আন্কল। দ্য ইয়ংগার ওয়ান। য়্যু গট ইট রং ব্রাদার"
"ব্রাদার? কভু নেহী। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা লোক হতে চাই না"
খানিকটা শব্দ করেই হেসে ফেললো অপি। সেজন্যেই কিনা পেছনের সীট থেকে উঁকি দিলো মিজান ভাই।
"ভইনডি কি আম্রিকা যাইতেছেন?"
অপি খানিকটা ভড়কে গেলো বোধহয়। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমাবার কোন ইচ্ছে তার নেই, আমি নিশ্চিত। লোকটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে শাহজালাল এয়ারপোর্টে। আমাকে দিয়ে বোর্ডিং কার্ড পূরণ করিয়েছিলো। জুতোর ফ্যাক্টরি আছে সম্ভবত। নিউইয়র্ক (অথবা লস অ্যাঞ্জেলস, সঠিক মনে পড়ছে না) যাচ্ছে জীবনে প্রথমবার। কেন যাচ্ছে জানাবার জন্যেই বললো,"হালাগো কপালে জুতা মাইরা আহি, ভাইডি। দুয়া কইরেন"
অপির চেহারা দেখে মনে হল বেশী ঘাটালে মিজান ভাইয়ের কপালেই জুতো জুটবার সম্ভবনা আছে। কিন্তু মিজান ভাই ঘাগু চিজ। হাঁ করে অপির পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সীটের ওপর পা তুলেই বসেছিলো অপি। ফোল্ডেড জিন্সটা হাঁটুর সামান্য নীচে এসেই শেষ হয়ে গেছে। ওয়াক্সিং করা মাখনরঙা পায়ে সরু একটা রূপোলী নূপুর। নখগুলোয় হালকা গোলাপী আভা। নিয়মিত পেডিকিওর করলে যা হয় আর কি।
ঈষৎ বিরক্ত হয়েই পা নামিয়ে বসলো বেচারী।
আমিই উপযাচক হয়ে বললাম সে সুইডেন যাচ্ছে।
"অ, আমি ভাবলাম কুনো সুন্দরী পর্তিযুগিতায় যায় মুনে লয়"
ফিক হেসে ফেললো অপি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ওর সামনের দুটো দাঁত যেন ঝিকিয়ে উঠলো। গালের টোল ভর্তি নিষ্পাপ ভালোবাসা।
আমি অবাক হয়ে খেয়াল করেছি প্রশংসা যদি ঠিকভাবে আর ঠিকসময়ে করা যায় মেয়েরা খুব সহজেই তা গ্রহন করে। তা সে প্রশংসাকারী যেই হোক না কেন।
গ্রীন সিগন্যাল পেয়েছে। মহা উৎসাহে মিজান ভাই গল্প করতে লাগলো। আমাকে মাঝে মাঝে দোভাষির কাজ করতে হল।
"নীল, দিস গাই ইজ কমপ্লিটলি নাট। উড ইউ টেল হিম?"
(মিজান ভাই, অফ যান)
"ভইনডি, এইযে আফনে ত্যানার লাহান আঙ্গুলে চুল প্যাঁচাইবার লাগছেন। আফনের ভাবীরে যতই কই, এমুন মাঞ্জা লইবার পারে না"
(হি লাইকস দ্য ওয়ে ইউ আর কার্লিং ইওর হেয়ার)
"আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট। বাট ইটস হার্ড টু ইমাজিন সামওয়ান লাইক হিম ইজ ফ্ল্যাটারিং মি।"
(মিজান ভাই দেখি আপনার বোনকে লজ্জায় ফেলে দিলেন)
এবারে মিজান ভাই ক্ষান্ত দিলেন। অপি আঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম ফেলার ভঙ্গি করলো। আমরা আবার গল্পে ফিরে এলাম।
"টার্কিতে ফার্স্ট টাইম?"
"হ্যাঁ"
"এখানে একটা সুইটস শপ আছে। বাবা হাজের। আই হ্যাড ওয়ানস হোয়াইল আই ওয়াজ রিটার্নিং ফ্রম টরন্টো। দারুন খেতে"
"মিষ্টি লাগবে তো? চমচমের পর চা খেতে কারো মিষ্টি লাগার কথা নয়। এত মিষ্টি একটা মেয়ে দেখার পরে....."
"স্টপ ইট নীল"
আমি স্টপ হয়ে গেলাম। অপি আবার শুরু করলো, "আমি টার্কিশ আইসক্রিম খাইনি কখনও। আপনি খেয়েছেন?"
"কোথা থেকে খাবো? আমি তো আগে এখানে আসিনি কখনও। দেশে মুভেন পিকে যা বিক্রী করে আমার দৌড় ঐ পর্যন্তই। তবে বেলজিয়াম আর সুইটজারল্যান্ডের আইসক্রীম নাকি মজার"
"আমিও শুনেছি। আমি আর সজীব এবার সামারে ইউরোপ ঘুরে বেড়াবো। আই ওয়ানা টেস্ট সুইস আইসক্রীম। সজীব আগেও খেয়েছে, হি লাভস টু ট্রাভেল। প্রিটি লাকি গাই"
"টেকো লোকটার কথা বলছো?"
অপি অবাকই হলো খানিকটা, "ইউ নো হিম?"
"না তো"
"হাউ ডিড ইউ সে, হি ইজ ব্যালড?"
"কপাল না হলে কি আর তোমার মতন একটা বউ পায়? ওর তো পুরো মাথাটাই কপাল। তাই ভাবলাম...."
এবারে জোরে হেসে উঠলো অপরাজিতা। মুখে এক হাত চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো একটু পরে।
"সত্যিই টেকো?" আমি একটু দু:খিত হলাম।
"উহু, ব্যাটে বলে হয়নি। তবে মাথায় চুল একটু কম"
এর মধ্যেই এয়ারহোস্টেস এসে জানতে চাইলো অপি কোন ধরণের ড্রিংকস পছন্দ করে। মিজান ভাই আবার গলা বাড়িয়ে জানতে চায় আমেরিকা যেতে আর কতক্ষণ লাগবে।
অপি আতঙ্কিত হয়ে বলল, "আই ডোন্ট নিড এনিথিং বাট কুড ইউ গিভ দ্য গাই সামথিং দ্যাট উড নক হিম আউট ফর অ্যান আওয়ার"
মিজান ভাই বুঝলো তাকে নিয়ে কিছু বলা হচ্ছে।
"ভাইডি, কি কয়?"
"ইউ মিন হার্ড ড্রিংকস?" এয়ারহোস্টেস জানতে চাইলো।
"এক্সট্রা হার্ড" লম্বা করে টেনে বলে অপি।
(মিজান ভাই, ফাউ পাগলা পানি দিচ্ছে। কবুল বলেন)
দাঁত কেলিয়ে হেসে মাথা ঝাঁকালো মিজান ভাই, "ইয়েস, ইয়েস"
টার্কিশ এয়ারওয়েজের কালেকশনে কি কি গান আছে খুঁজতে লাগলাম। গান শুনতে শুনতে পরের দুটো ঘন্টা অপি আর আমি অনেক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বললাম। বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ এবং রুচিবোধের ব্যাপারে আমার সাথে কোন মেয়ের এত মিল থাকতে পারে তা কল্পনাতেও ছিলোনা কোনদিন। ও ফুটবলের পাঁড় ভক্ত, মিউজিক পছন্দ করে, প্রচুর পড়তে ভালোবাসে আর মুভি দেখে। আমি আবার কবিতা বুঝি কম। মনে পড়ে, একবার মোখলেসুর রহমান নামের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নামজাদা এক চিত্রকরের সঙ্গে আমার পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন শিল্প হচ্ছে অনুভূতির বিষয়। অনুভূতিকে নাড়িয়ে গেলেই শিল্পী সার্থক। তেমনি কবিতা যদি অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায়, সেখানেই কবির সার্থকতা। ইংরেজী কবিতা বলতে আমরা যেমন ইয়েটস-কেই বুঝি, আমার কিন্তু কেন যেন ইয়েটস পড়বার সৌভাগ্য হয়নি। বলা ভালো পড়বার ইচ্ছে জাগেনি। আমার পছন্দ খানিকটা ব্যতিক্রমধর্মী (সম্ভবত সবারই)। পুরনোদের মাঝে রবার্ট লুই স্টিভেনসন, ক্রিশ্চিনা রোসেট্টি আর অধুনা পাবলো নেরুদা। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো কবিতার ব্যাপারে ওর সাথে আমার অদ্ভুত মিল। রীতিমতন কাকতালীয়।
বাইরে তাকালাম, ইস্তাম্বুল এসে গেছে। অপি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলো। কি ভাবছে কে জানে। ঢাকা ছেড়েছি সেই সাতসকালে। বাইরে উঁকি দিলাম। বসফরাস প্রনালী দেখা যাচ্ছে। কি গভীর নীল। ইস্তাম্বুলের সবগুলো বাড়ীর ছাতই টকটকে লাল। নীচে চওড়া সব রাস্তা আর ছুটে চলা যানবাহন।
"কেয়ারফুল" মৃদুস্বরে বলল অপি। ওর দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো। গালে হালকা লালচে আভা।
লজ্জা পাচ্ছে কেন? ও আচ্ছা, খেয়ালই করিনি বাইরে দেখতে গিয়ে ওকে ডিঙিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার গালটা ওর ঠোঁট থেকে ইঞ্চি খানেক তফাতে। জিভ কেটে তাড়াতাড়ি নিজের সীটে বসে পড়লাম। ঘোষনা এলো সীটবেল্ট পড়ে নেবার জন্য। কামাল আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে বিমান।
অপির স্টকহোমের বিমান ধরতে হবে। তবে স্ক্রীনে রিপোর্টিং টাইমের দেরী দেখে মনে হলো খুশীই হয়েছে ও। আর সৌভাগ্যবশত: মিজান ভাই বিদায় নিয়েছেন আগেই। অপির কফির তৃষ্ণা পেয়েছে, একটু খুঁজতেই স্টারবাকসের দেখা মিলল। দুনিয়ার সব বড় বড় এয়ারপোর্টেই দেখি আছে এরা। অ্যামস্টারডাম, প্যারিস, জেনেভা, দিল্লী, ইস্তাম্বুল মায় আমাদের কলম্বো পর্যন্ত। আফসোস, আমাদের দেশে নেই। এখানকার স্টারবাকসের অ্যাকোমোডেশনটা বেশ ছোট। তার ওপর একসাথে বেশ কতকগুলো বিমান নামায় স্টারবাকস ফ্যানরা সব এসে জুটেছে। আমাদের বসবার জায়গা নেই। সুতরাং, আমরা দুজন লাউঞ্জের একটা খোলা রেস্টুরেন্টে বসলাম। রেস্টুরেন্টের নাম "দ্য গ্রীনপোর্ট"। চারপাশটা প্রাকৃতিকভাবেই সবুজ বাঁশ আর লতাপাতা দিয়ে ঘেরা। ঝাঁ চকচকে চেয়ার-টেবিল। পালিশ করা কাউন্টার। আমার ভারী পছন্দ হয়ে গেলো। ছাতের ওপর থেকেও ঝুলছে বুনো লতা।
"আয়্যাম গোইং টু গ্র্যাব আ কফি, আই জাস্ট লাভ স্টারবাকস। য়্যু ওয়েট হিয়া অ্যান্ড অর্ডার সামথিং ফ্রম দ্য মেনিউ"
টো-এর ওপর আধপাক ঘুরে রওনা হলো অপি। আমিও দীর্যক্ষণ পরে অন্য কিছু দেখার ফুরসৎ পেলাম। গমগম করছে কামাল আতাতুর্ক। এশিয়ান, আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, আমেরিকান সব দেশের মানুষই এসে ভিড় করেছে এখানে। কেউ যাবে মিউনিখ, কেউ যাবে রোম, কেউবা বার্সেলোনা, প্যারিস, অসলো অথবা লিসবন। পুরো ইউরোপ জুড়ে বিমান যায় এখান থেকে। গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে ইউরোপে। বেশ একটা উৎসব উৎসব আমেজ চারিদিকে। আশ্চর্যের বিষয় মাত্রাতিরিক্ত চেঁচামেচি নেই কোথাও। আমার বাঁ পাশের লতাপাতার বেড়াজালের ফাঁক গলে নজরে পড়ছে নীল বসফরাস (বারে বারেই কথাটা বলতে হচ্ছে, আসলে কতটা নীল না দেখলে অনুমান করা শক্ত), নানান রঙা ইয়ট আর ক্রুজশীপ ভাসছে ওখানে। মিষ্টি রোদে ঝিলমিল করছে চারদিক। আমার মনে হলো দিব্যি এয়ারপোর্টে বসেই ছুটিটা আমি কাটিয়ে দিতে পারি।
"য়্যু লুক অ্যামেজিং নীল। আই লাভ দ্য ওয়ে য়্যু আর লুকিং অ্যাট দ্য এয়ারপোর্ট। মনে হচ্ছে যেন কোন শিশু হাঁ করে নতুন জিনিস দেখছে"
অপি কখন এসেছে টেরই পাইনি। আমার মতন নির্লজ্জও লজ্জা পেয়ে গেলো। আমি অতি অল্পতেই মুগ্ধ হই। আর ইউরোপেও সেবার প্রথম। খানিকটা বিস্ময়বোধ থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
নিজের জন্য কফি আর আমার জন্য আর্ল গ্রে টি এনেছে অপি। আর্ল গ্রে পৃথিবীর সেরা চা, সন্দেহ নেই তবে আমার মুগ্ধবোধ আরোও বেড়ে গেলো অন্য কারণে। আমার গ্যাসট্রিকের সমস্যা হয় বলে কফি খাইনা, বিমানে একটা গ্যাসট্রিকের ট্যাবলেটও খেয়েছিলাম। সেটা নজর এড়ায়নি অপরাজিতার। আমার মাথাভর্তি চুল। তবে কেনো যে টেকো হলাম না সে নিয়ে জীবনে প্রথম আফসোস হয়েছিলো সেবার।
হালকা একটা গান বাজছিলো গ্রীনপোর্টে। এলদিন হুসেনবেগোভিচের গান। বসনিয়ান এই ভদ্রলোকের সুফি গানের দারুন ভক্ত আমি। প্রথম "রাস্তাভি" গানটা শুনেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যদ্দুর মনে পড়ে টার্কিশ ভাষায় গাওয়া গান, ভাষাটা না বুঝলেও গানের সুরটা মন উদাস করে দেয়া। অপিও দেখলাম হুসেনবেগোভিচের গান শোনে।
"আই লাভ নুসরাত ফতেহ আলি, হি ওয়াজ আউটস্ট্যান্ডিং" ও বলেছিলো।
দ্বিমত করবার কোন উপায় দেখি না। সত্যিই ফতেহ আলি সাহেবের কোন তুলনা নেই।
"নীল, ডু ইউ লাভ দ্য তাজ?" অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে হঠাৎ করেই প্রশ্ন করে বসলো অপি।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমি কোনকালেই তাজমহল পছন্দ করতাম না। তাছাড়া আমি প্রেমিক নই। তাজ পছন্দ করতে যাবো কোন দু:খে? অপি দেখলাম ব্যাপারটায় খুব দু:খিত হলো।
"যে কাজ করতে বিশ হাজার লোকের কব্জি কাটতে হলো সেটা পছন্দ হয়না আমার, আমি আমার কব্জিকে ভীষণ ভালোবাসি"
"লোকটার ভালোবাসাটা তো দেখবেন। কত ভালোবাসতো মুমতাজ কে"
"বাহ, আমি নিজেও তো ওর চাইতে বড় প্রেমিক। কই আমাকে কি তাজমহল বানাতে দেখেছো?"
"আমাকে প্রমান দেখান" হাতের ওপর থুতনী রেখে সামনে ঝুঁকে এলো অপি। মুখে দুষ্টুমীর সেই হাসি।
"কি রকম প্রমান দেখতে চাও?"
"ইমপ্রেস মি"
আমি চিন্তা করলাম। আমার মতন বোকাচন্দর ওকে ইমপ্রেস করতে পারবে না। নিজে ভাঁড় সাজার কোন মানে নেই। আপাতত বিতর্কে ইস্তফা দেই। চা শেষ করে আরাম করে একটা হেলান দিলাম। অপি ওর ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। পাওলো কোয়েলহো'র বই। বাই দ্য রিভার পিয়েদ্রা আই স্যাট ডাউন অ্যান্ড ওয়েপ্ট। পাওলো কোয়েলহো'র দারুন ভক্ত আমি, কিন্তু কেন যেন কিছুতেই এই বইটা শেষ করতে পারিনি। আমি আজও জানিনা শেষ পর্যন্ত নায়ক- নায়িকার মিল হয়েছিলো কিনা। কিছু কিছু রহস্য মনে হয় আঁধারে থাকাই ভালো। প্রত্যেকটা মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী, আশ্চর্যজনক ভাবে অপরাজিতার সাথে আমার রুচিবোধের যে অদ্ভুত মিল সেটার রহস্য নিয়ে আমি আজও আঁধারে আছি।
"নীল, কিপ দিস বুক উইথ য়্যু"
"অপি, আমার কাছে আছে বইটা"
"আমি আপনাকে এটা গিফ্ট হিসেবে দিলাম। আমার অটোগ্রাফ সহ....... আরে, আই অ্যাম কিডিং, এখানে আমার সেল নম্বর আছে। অরটেল সীম। অল ইউরোপ কাভারেজ। সো ওয়্যারেভার আই অ্যাম, য়্যু উইল ফাইন্ড মি"
"সেকি। শেষমেষ তুমি আমাকে কাঁদিয়ে চলে যাবে? এখানে আমি পিয়েদ্রা নদী কোথায় পাবো? ওটা তো ফ্রান্সে।"
"তাহলে বসফরাসের সামনে কাঁদুন গিয়ে, আমার ওঠার সময় হয়েছে"
সত্যিই অপির ওঠার সময় হয়ে গিয়েছে। আমার কেন যেন মন খারাপ হতে লাগলো। লাগুক, ওসব সস্তা আবেগ পাত্তা দিয়ে কি হবে। ওরকম তো অনেকই হয় আমার। কেউ আমার জন্য মন খারাপ করে নাকি? মিনিট দুয়েকের অটো-সাজেশনে মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলাম।
"স্টপ প্রিটেন্ডিং স্মাইলিং নীল, য়্যু লুক প্যাথেটিক"
কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা। কিছুই দৃষ্টি এড়ায় না দেখছি। মিনিট দশেক হাঁটবার পরেই ফ্লাইট ট্রান্সফারের গেটে চলে এলাম আমরা। এবারে বিদায় নেবার পালা। কোন সিনেমাটিক কিছুই ঘটলো না। জীবনটা যে আসলেই সিনেমা নয়। অপি লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। আর আমি ওখান থেকে চলে এলাম।
লাল কুর্তা গায়ে একজন লোক তুর্কী টুপী মাথায় আইসক্রীম বিক্রী করছিলো। তার একটা ছবি তুললাম। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। একটা বেঞ্চিতে বসে অপির দেয়া বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলাম। দেখি শেষমেষ কি আছে নায়িকার কপালে। ভালো লাগলো না। বইয়ের প্রথম পাতায় গোটা গোটা হরফে লেখা অপির নাম, তার নীচেই সেল নম্বর। পেয়েছি বুদ্ধি। বাঙ্গালী হয়ে হেরে যাবো প্রেমে? কভু নেহী। ঐতো পে-ফোন দেখা যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম।
"হ্যালো, অপরাজিতা?"
"নীল?"
"কি করে চিনলে?"
"আমাকে কেউই অপরাজিতা বলে না" কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললো "অপি বলে ডাকে। আপনি হঠাৎ পে-ফোন থেকে কল করতে গেলেন কেনো? দিস ইজ ম্যাডলি এক্সপেনসিভ"
"হোক গিয়ে। শাহজাহানও তো কখনও মুমতাজের সঙ্গে কথা বলবার জন্য পয়সা খরচ করতেন না। আমি তোমার সাথে দু মিনিট কথা বলবার জন্যও খরচ করছি। আমি কি শাহজাহানের চেয়েও বড় প্রেমিক নই?"
উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দ অন্যপাশে। অনেকক্ষণ পরে থামলো যেন।
"আই বিলিভ, য়্যু আর"
(অনেকক্ষণ নীরবতা)
"ভালো থেকো অপরাজিতা"