[উপক্রমনিকা: আমার গত পর্বটি ছিলো রাশান জায়ান্ট ম্রিয়াকে নিয়ে লেখা। লেখাটি নিয়ে ক্ষুদ্র আকারে গবেষনা করতে গিয়ে নজরে এলো বিশ্বের শক্তিশালী আর দামী সামরিক বিমান গুলোর চেহারা। দেখলাম এগুলো নিয়েই দিব্যি একটা পোস্ট দাঁড়িয়ে যেতে পারে। ভাবছিলাম হিস্টোরিক্যাল এয়ারক্র্যাশ নিয়ে লিখবো, কিন্তু মনোযোগ চলে এলো এটার দিকেই। মার্কিন-রাশান স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে কিছু বিমান আত্নপ্রকাশ করেছে, সেগুলোই উঠে এসেছে এই লেখায়। রাশানরা একটু নিভৃতচারী বিধায় মার্কিনীদের বিমানগুলোর তথ্যই পাওয়া গেছে। রাশানরা শেষমেষ কি বোমা ফাটাবে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে সুতরাং রাশান এয়ারক্র্যাফট নিয়ে আপাতত খুব বেশী তথ্য দিচ্ছি না।]
এফ/এ-১৮ হর্নেট
দাম $৯৪ মিলিয়ন। টুইন এঞ্জিন বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানটি ইউ.এস.আর্মির ফ্রন্টলাইন অ্যাটাকার অর্থাৎ আক্রমনের সম্মুখভাগে থাকতে হয় একে। অ্যাটাকে লিড দেয়াই বলুন কিংবা ভূমি কি আকাশে আক্রমনই বলুন, সর্বকাজেই সমান পারঙ্গম হর্নেট। ইরাকে আপারেশন ডেসার্ট স্টর্মে (ইউ.এস নেভীর ব্লু অ্যাঞ্জেল ফ্লাইট ডেমোস্ট্রেশন স্কোয়াড্রনে) কাজ করে বাহবা কুড়িয়েছে বিমানটি। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, কুয়েত, মালয়েশিয়া, স্পেন ও সুইজারল্যান্ড তাদের বিমানবাহিনী সুসজ্জিত করেছে হর্নেট দিয়ে।
ই.এ-১৮জি গ্রাউলার
মূল্যমান $১০২ মিলিয়নের কাছাকাছি। হর্নেটের খানিকটা বেশী অস্ত্রসজ্জিত উন্নততর সংস্করন বলেও কেউ কেউ চালিয়ে দেন। যে যাই বলুন, গ্রাউলার এখন আর এয়ারফোর্সের অংগ নয়। ইউ.এস নেভীর কাছে বছর খানেক আগেই হস্তান্তর করা হয়েছে একে। যদিও মূলত: ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের জন্যই গ্রাউলারকে তৈরী করা হয়েছে, এন্টি এয়ারক্র্যাফট গান খুঁজে বের করে ধ্বংস করতেও গ্রাউলারের জুড়ি মেলা ভার। শুধু তাই ই নয়, শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থা জ্যাম করে দিতেও পারঙ্গম এই হাই-টেক যুদ্ধবিমানটি।
ভি-২২ অসপ্রে
দাম $১১৮ মিলিয়ন। অসাধারন একটি টিল্টরোটর এয়ারক্রাফট। ভার্টিক্যাল টেক অফ (হেলিক্প্টারের মতন উলম্ব বা খাড়া ভাবে টেক অফ করা) এবং ল্যান্ডিং করতে পারে অথচ ছুটতে পারে অন্য যে কোন বিমানের গতিতেই। এই বিমানটি অনেক মুখরোচক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে হোয়াইট হাউজে। ফ্লাইং এবং অপারেশনের সময় অসপ্রে তৈরীর নকশা ও নির্মান ত্রুটির জন্য অন্তত ৩০ জন মেরিন সেনা মারা যান। প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত ক্ষমতা খাটিয়ে অসপ্রে-কে ক্রমাগত গ্রাউন্ডেড করবার চেষ্টা চালাতে থাকেন। কাজের কিছু যে হয়নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সেই ২০০৭ সালে ইরাক যুদ্ধে প্রথম ব্যবহার করা হয় অসপ্রে এবং পরবর্তীতেও এর ব্যাপ্তি ও বহুমুখিতার কথা বিবেচনা করে আমেরিকান সরকার এক স্কোয়াড্রন অসপ্রে আফগানিস্তানে ডেপ্লয় করেছেন।
এফ-৩৫ লাইটেনিং (ভার্সন টু)
এর দাম $১২২ মিলিয়ন। নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানের নাম লকহিড মার্টিন (ইউ.এস এয়ারফোর্সের এর সবচাইতে বড় বিমান নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান) যারা ২০০১ সালে এফ-৩৫ তৈরী করার একটি কনট্রাক্ট করে গভর্মেন্টের সঙ্গে। সেটি ছিলো তৎকালীন আমলের সবচাইতে বড় সামরিক কন্ট্রাক্ট। এই কন্ট্রাক্ট নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। মার্কিনিরা একটু চেঁচামেচি করে কাজ করতেই আনন্দ পায় সম্ভবত। কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী লকহীড মার্টিন একজাতীয় স্টেলথ, সুপারসনিক জেট ফাইটার তৈরী করে দেবে বলে কথা ছিলো যেটা মার্কিন এয়ারফোর্সের পুরোনো ফাইটার আর্সেনাল-কে রিপ্লেস করবে। মার্কিনি এবং তাদের মিত্রদের জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার প্রোগ্রামের অংশ ছিলো এটি, কিন্তু ওভারওয়েট এবং আন্ডারপাওয়ার হিসেবে সমালোচনার তীর ধেয়ে আসে এফ-৩৫ এর ওপরে। বলা হয় এই দুর্বলতার ফলে বিমানটি শত্রুপক্ষের সহজ টার্গেটে পরিনত হবে।
আগুনে ঘি ঢালে আর একটি গুজব। সাইবার গোয়েন্দারা নাকি জয়েন্ট স্ট্রাইক প্রোগ্রাম ফাইটারের ৭.৫ মিলিয়ন লাইনের পাওয়ার কোড হ্যাক করেছে। মার্কিনীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় এবং তাদের বদ্ধমূল ধারনা হয় এর ফলে এফ-৩৫ এর কারিগরি নকশা এবং দুর্বলতা দুটোই প্রকাশ পেয়ে যাবে। শেষতক এপ্রিল ২০০৯ এ লকহীড মার্টিন ঘোষনা দেয় যে, জয়েন্ট স্ট্রাইক প্রোগ্রাম ফাইটারের ৭.৫ মিলিয়ন লাইনের পাওয়ার কোডটি আদতে হ্যাক হয়নি।
ই-২ডি অ্যাডভান্সড হক আই
এই স্টেজে একলাফে ২০০ মিলিয়নের লাইন ক্রস করেছে মার্কিন বিমানগুলো। $২৩২ মিলিয়ন এক একটির দাম। মার্কিনীদেরকে শত্রুপক্ষের চেয়ে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে এই বিমানটি। "হক আই"-এর শক্তিশালী রাডার সিস্টেম অন্যান্য রাডার ব্যবস্থা থেকেও অন্তত ৩০০% বেশী জায়গা মনিটর করতে সক্ষম। কি রকম সেটার একটা উদাহরন দেই। গত জুলাই মাসে ইউ.এস ন্যাশনাল ডিফেন্সকে লেক্সিংটন ইন্সটিটিউটের জনৈক এনালিস্ট জানান, “এর দ্বারা সম্ভবত ইরানের একটা মটরদানাকেও আমরা ওপর থেকে দেখতে পারবো”। যদিও বিমানটি এখনও ডেভেলপমেন্ট ফেইজে আছে তারপরেও দুটো পরীক্ষামূলক ভার্সন নেভীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ছবির দুটোই এই এক্সপেরিমেন্টাল ভার্সন। ডিফেন্স বাজেট ঘাটতি ধারনার থেকেও "হক আই"-কে আরও একটি বছর বেশী গ্রাউন্ডেড রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান।
ভি.এইচ-৭১ কেস্ট্রাল
দাম $২৪১ মিলিয়ন। হোয়াইট হাউজের সেই পুরোনো চর্বিত চর্বন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ক্ষমতায় আসেন তখনই এই হাই-টেক হেলিকপ্টার প্রোজেক্টটি বাজেটের ৫০% অতিরিক্ত খরচ করে ফেলেছে। তিনি যুদ্ধ বিরোধী বলে প্রোজেক্টটি বন্ধেরঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয় যে প্রোজেক্টটিতে আরও $৪৮৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। যথার্থই, বেল পাকলে কাকের কি?
পি-৮এ পসেইডন
$২৯০ মিলিয়ন ডলার। দেখে যে কেউই একে যাত্রীবাহী বিমান বলে ধোঁকা খাবে এবং ভুলটা করবে এখানেই। মূলতঃ এটি বোয়িং ৭৪৭ এর সাজানো গোছানো সামরিক ভার্সন। এই বিমানটি নেভীকে হস্তান্তর করা হবে ২০১৩ সাল নাগাদ আর ব্যবহার করা হবে এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার আর ইন্টেলিজেন্সের কাজে। পসেইডন সাবমেরিন খুঁজে বের করবার জন্য ডেপথ চার্জ করতে পারবে (ইউ-৫৭১ মুভিটা দেখে নিন, ডেপথ চার্জ সম্পর্কে ভালো ধারনা পেয়ে যেতে পারেন মুফতে) আর সঙ্গে বইতে পারবে টর্পেডো সহ অন্যান্য আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র।
সি-১৭এ গ্লোবমাস্টার থ্রি
দাম $৩২৮ মিলিয়ন। যুদ্ধক্ষেত্রে গ্রাউন্ডট্রুপ মুভ করাবার জন্যই হোক কিংবা এয়ারড্রপের জন্যেই হোক, গ্লোবমাস্টারের সমকক্ষ খুঁজে বের করা মুশকিল। চারটি অতিকায় টার্বোফ্যান ক্রমাগত প্রপেল করে গ্লোবমাস্টারকে। বোয়িং ৭৫৭ তে যে ধরনের এঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিলো ঠিক সে ধরনের এঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে এই এয়ারক্রাফটটিতে। প্রতিবারে ১০২ জন প্যারাট্রুপার ড্রপ করতে পারে গ্লোবমাস্টার। ইরাক এবং আফগানিস্তানে জরুরী ত্রান এবং সাহায্য পাঠাতে ব্যবহার করা হয়েছে একে। ইউ.এস এয়ারফোর্সের কাছে এমন বিমান আছে ১৯০ টি।
এফ-২২ র্যাপটর
$৩৫০ মিলিয়ন। একটি সোভিয়েত এয়ারক্রাফটের (সম্ভবত টি-৫০) সঙ্গে পাল্লা দেবার আশায় লকহীড মার্টিন এই দানবটিকে তৈরী করে। আদৌ রাশান এয়ারক্রাফটটি তৈরী হয়েছিলো কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে মার্কিনীদের (অবশ্য আমি পোস্টের শেষ পর্যায়ে এসে এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছি)। মার্কিনীদের বিচারে র্যাপটরই দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী দানব, দামী তো বটেই। বিশ্বের তাবৎ রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম র্যাপটর। কি পারেনা ও? অব্যর্থ নিশানায় গুলি করে শত্রুপক্ষের মিসাইল ভূপাতিত করা, সুপারসনিক গতিতে শত্রুপক্ষের সীমানায় ঢুকে পড়া ( গতিবেগ শুনলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য, ২৪১০ মাইল/ঘণ্টা), শূন্য থেকে ভূমিতে কিংবা শূন্য থেকে শূন্যে আক্রমন, সব কাজেই পারঙ্গম। এ কারনেই তো এফ-২২ র্যাপটর এক্সপোর্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে ফেডারেল কোর্ট। আরও গোটা সাতেক বানাবার ব্যাপারে কথা-বার্তা চলছে লকহীড মার্টিনের সঙ্গে। বিতর্ক এই নিয়ে যে, $১.৬৭ বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স গোনাটা কতটুকু কাজের হবে কিংবা এতে করে যে বিশ্বমন্দার মাঝে ২৫০০০ লোকের কর্ম সংস্থান হবে এবং তাতে ওবামা পরিষদের ভোট ব্যাংক কতটুকু ফুলে ফেঁপে উঠবে। যেটাই ঘটুক র্যাপটর যে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছে তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বি-২ স্পিরিট
দাম না শোনাই মঙ্গলজনক। তবুও দামী এয়ারক্র্যাফটের কথা যেহেতু বলাই হচ্ছে দামটাও শুনে রাখুন। মাত্র $২.৪ বিলিয়ন। দাম অত্যাধিক হওয়ায় ইউ.এস কংগ্রেস ১৯৮৭ সালের পার্চেজ অর্ডার ১৩২ থেকে কমিয়ে ২১ এ নামিয়ে আনে। ২০০৮ সালে একটি বি-২ স্পিরিট ক্র্যাশ করলে এর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২০ এ। ইনফ্রা-রেড, অ্যাকাউস্টিক, ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক, ভিজ্যুয়াল কিংবা রাডার কোনটিতেই এর উপস্থিতি সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। এই অবিশ্বাস্য স্টেলথ সক্ষমতার কারনেই প্রায় নিখুঁতভাবে শত্রুপক্ষের সীমানায় বোমা মেরে পালিয়ে আসতে পারে বি-২। ১৯৯৩ সালে সার্ভিসে যোগ দেয়া বি-২ অংশগ্রহণ করেছে ইরাক, আফগানিস্তান সহ গুরুত্বপূর্ন প্রায় সব যুদ্ধেই।
সুখোই টি-৫০
দাম খুব বেশী নয়। তৈরী করতে র্যাপটরের চেয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার কম লাগে বলে দাবী করেছে সুখোই (সোভিয়েত মিলিটারির বিমান ম্যানুফ্যাকচারার)। দাঁড়ান, দাঁড়ান, হতাশ হবেন না। দামে কম বলে অবহেলা করবেন না। কারণ এর যে দামে নয়, গুনে পরিচয়। লম্বায় আর উইংস্প্যানে র্যাপটরকে খানিকটা ছাড়িয়ে গেছে এটি। তাতে কি? ৩০ মি.মি.র দুটো কামান আর গুনে গুনে ১৬ টি মিসাইল (৮ টি ভেতরে আর ৮ টি বাইরে) বইতে পারে টি-৫০, র্যাপটর পারে মোটে ২০ মি.মি. র একটি কামান আর ১২ টি মিসাইল। গতিতে র্যাপটর একটু এগিয়ে থাকলেও টি-৫০ এর রেঞ্জ র্যাপটরের চেয়ে ২৫০০ কি.মি.-এরও বেশী। বলা হয়ে থাকে টি-৫০ এর শরীরের সুক্ষ্ণ অ্যাংগেলড এক্সটারনাল জিওমেট্রির কারনে এর উপস্থিতি এনিমির রাডার ওয়েভে বা অন্য কোন ওয়েভে ডিটেক্ট করা অসম্ভব। সুপারসনিক ক্রুজিং স্পিড সও্বেও খুব সহজেই ম্যানুয়েভার করা সম্ভব টি-৫০ কে। আর এর কমব্যাট রেডিয়াসও বেশী। এবার বলুন কাকে মানবেন আকাশের রাজা। আকাশ যুদ্ধে কে জয়ী হবে সে বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়ে আপাতত বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকবেন সবাই।
উৎসর্গ: ব্লগার উৎকৃষ্টতম বন্ধু কে..