somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবর {শেষ ঠিকানা}

২৪ শে জানুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবর
আহমেদ ফারুক

সুলতান কোদাল দিয়ে একটা কোপ বসাল মাটিতে। মাটির ভেতর কোদালের মাথাটা ঢুকে গেল সহজেই। কিন্তু মাটি কী সত্যিই নরম? নাকি এ মাটিতেই মিশে যাবে অনেক গল্প, অনেক কান্নার জল। প্রথম কোপ দেয়ার পরই সুলতান থামল।

গত বত্রিশ বছরে যা হয়নি তাই হলো তার। তার চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছে। ছেঁড়া গামছা দিয়ে চোখ মুছল সে। তার বয়স এখন চল্লিশ। সেই আট বছর বয়সে প্রথম কবর খুঁড়েছিল। সে কবরটা ছিল তার বড় কাকার। সেদিন ফজল চাচার সাথে কবরটা খুঁড়েছিল। সে কী ভয় তার!

বারবার গা শির শির করে উঠছিল। অপার্থিব এক ভয়। এ ভয়ের সাথে পৃথিবীর কোন ভয়ের কোন মিল নেই। বড় কাকার কবর খুঁড়তে খুঁড়তে গভীর রাত হয়ে যায়। কুপির আলোয় কবরটায় অদ্ভূদ অন্ধকার হয়ে ছিল। অথচ এখানেই শুয়ে থাকবে একটা মানুষ।

আর কখনো ফিরে আসবে না। ভাবলেই মন ভারী হয়ে যায়। অথচ এটাই সত্যি। এটাই চিরন্তন নিয়ম।
সুলতানের মা-বাবা ছিল না। জন্মের পরই মারা যায় তারা। তারা দেখতে কেমন ছিল সুলতান তা জানে না। তাদের কোন স্মৃতিও নেই। এতিম সুলতানকে মানুষ করে বড়কাকা।

সুলতানকে কখনো বাপের অভাব বুঝতে দেননি। সম্ভবত এ কারণে মায়ের কথা অনেক মনে পড়লেও বাপের কথা মনে পড়ত কম। সেই কাকাও হঠাৎ করে মারা গেল। আট বছরের সুলতান কবর খোঁড়ার সময় হাউমাউ করে কেঁদেছিল। একটা অদ্ভূদ শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল তার মন।

জীবনের এক সুক্ষ্ণ ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে সে। তারপর বত্রিশ বছর পার হয়েছে। কোদাল হাতে সুলতান কবর খুঁড়ে বেড়িয়েছে এ গ্রাম সে গ্রামে। রাত হলে বলগাঁও গোরস্থানে শুয়ে থাকত। রোজই একটা-দুইটা কবর খুঁড়তে হতো। লাশ আসত। সাথে আসত একদল মানুষ। তারা অঝোরে কাঁদত।

এসব কান্না সুলতানকে ছুঁয়ে যেত না। সুলতান মানুষের হৃদয়ের কান্না দেখেছে। দেখেছে থরথর হাতে কোনো বাবার ছেলের লাশ কবরে নামানোর দৃশ্য অথবা মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছে ছেলে।

মানুষের কোন কান্নাটা আত্মার, কোন কান্নাটা সবচেয়ে বেশি শুদ্ধ তা সুলতান জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারে চোখের ভাষা দেখে। মাঝে মাঝে সে যেন মানুষের প্রকৃত আত্নার প্রকৃত রূপ দেখতে পায়। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এক পার্থিব আবরণে ঢেকে রাখে। মানুষ সে ঢাকনা খুলে বের হতে চায় না।

তারপরও বের হয়ে আসে। কবরের সামনে তেমনি ঢাকনাহীন মানুষ দেখেছে সুলতান। দেখেছে মানুষের আত্মা গলে যাওয়ার দৃশ্য। এ এক অনুভূতি, কখনো কাউকে বোঝানো যায় না। কত শত মানুষের কবর যে সে এ জীবনে খুঁড়েছে তা সে নিজেও জানে না।

তারপরও প্রতিটা মৃত্যুরই যেন আলাদা গন্ধ আছে। আলাদা একটা রূপ আছে। কবর খোঁড়াটা সহজ কোনো কাজ নয়। বেশ কষ্টসাধ্য। সাড়ে তিন হাত মাটি খুঁড়তে হবে। সুন্দর করে চারকোণা বানাতে হবে। মৃত মানুষটার আকার-আকৃতির ওপর ছোট-বড় হয়। তার সাথে সুন্দর করে কাটতে হবে বাঁশ।

লাগবে চাটাই। পাশের মাটিগুলো আলগা করে রাখতে হবে। সুলতান দক্ষ হাতে এসব কাজ করে।
মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব বোঝার মতা তার নেই। তারপরও কিভাবে যেন সে বুঝতে পারে ভেতরের অজানা রহস্য। কারো কারো কবর চট করে খুঁড়ে ফেলে সে।

আবার কারো কারো কবর খুঁড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। এমন কেন হয় সুলতান তা জানে না। দক্ষিণপাড়ায় একবার কবর খুঁড়তে গিয়ে এমন হয়েছিল। গভীর রাতে মারা যায় লোকটা। শোনা যায় লোকটা নাকি প্রথম জীবনে ডাকাত ছিল। কত মানুষকে খুন করেছে তা নিজেও জানত না।

গভীর রাতে বাড়ির পেছনে কবর খুঁড়ছিল সুলতান। সাথে একটা হারিকেন আর তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়া স্পষ্ট দেখতে পায় সে। অবশ্য মনের ভুলও হতে পারে। সে চট করে টর্চ লাইটটা বের করে।

আশ্চর্য লাইট জ্বলছে না। সুলতানের পানি পিপাসা পায়। সে কবরের পাশে বসে পড়ে। সবই হয়তো মনের ভুল। অমাবস্যার রাতে নাকি মানুষের শরীর টানে। হয়তো এ কারণেই এমন হচ্ছে। আর কবর খুঁড়তে গেলে এত ছোট আত্মা হলে চলে না।

সাহস থাকতে হয় বুকে। জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলতান কবর খুঁড়ে। তারপরও সে বুঝতে পারে অজানা এক রহস্য। মাটিটা শক্ত হয়ে ছিল। শরীরের পুরো শক্তি দিয়েও কবরটা খোঁড়া যাচ্ছিল না।

সুলতান মারা গেলে কে তার কবর খুঁড়বে? তার কবরের মাটিও কি এভাবে শক্ত হয়ে যাবে? নাকি নরম হয়ে যাবে সহজেই। কেউ কি এমন অদৃশ্য ছায়া দেখতে পাবে? না কি দেখবে অন্যকিছু? ঠিক বুঝতে পারে না সে। বত্রিশ বছর পর সুলতান কাঁদছে। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

সে কবরে দ্বিতীয় কোপ বসাল। একটা মাটির চাপ তুলে ফেলল সহজেই। মাটিটা নরম। বেশ নরম। সুলতান পেছনের দিকে তাকাল। দূরে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বাড়িটার নাম স্বপ্নঘর। গতকাল রাতে এ বাড়িতেই মারা গেছে বাড়ির গৃহকর্ত্রী রোখসানা বেগম। মানুষ মারা যায় এটাই স্বাভাবিক।

এ চিরন্তন সত্য কেউ বদলে ফেলতে পারবে না। বদলে ফেলা সম্ভব না। কিন্তু রোখসানা বেগমের মৃত্যুটা মেনে নেয়া কঠিন। সম্ভবত এ কারণেই তিন গ্রামের মানুষ দেখতে এসেছে তাকে। রোখসানা বেগমের বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে ডাক্তার জাহিদুল ইসলামের সাথে।

বিয়ের পর সুখের দিন শুরু হয়। ডাক্তার হিসেবে জাহিদুল ইসলামের নামডাকও ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের বিপদে-আপদে তিনি ছুটে যান। গ্রামেই গড়ে তুলেন রোখসানা মা ও শিশু কিনিক। চার বছরের মাথায় তারা ঝিলের ধারে বাড়ি বানায়। বাড়ির নাম দেয় ‘স্বপ্নঘর’।

তাদের স্বপ্নঘরে বছর না ঘুরতেই রোখসানার কোল জুড়ে আসে জমজ সন্তান। দুটোই মেয়ে। ডাক্তার সাহেব বড় মেয়ের নাম রাখেন সূচনা। ছোটটার নাম রাখেন অনন্যা। দুই মেয়ে বড় হতে থাকে। কিন্তু মনের কোথায় যেন এক কমতি অনুভব করেন তারা।

আমরা যত সভ্যই হই না কেন, মানুষের দুটো ধারার মধ্যে চিরন্তন সত্য এক প্রভেদ লালন করি। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভাবে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাকে বুকে ধারণ করে না। ডাক্তার সাহেবের বংশ উজ্জ্বল করতে হবে। ছেলে সন্তান না হলে সমাজের অদৃশ্য কালো মেঘ দূর করা যায় না।

ইতিহাসের পাতায় এমন কান্ত গল্প অনেক আছে। তিন বছর পর ডাক্তার সাহেব আরো এক মেয়ের পিতা হন। সৃষ্টিকর্তার এমন সিদ্ধান্তে ডাক্তার সাহেবের বাস্তবিক দৃশ্যগুলো রঙিন হয় না। যে আলোতে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ খেলা করে, সে আলো দেখার মতা হয়তো তার ছিল না।

বছর না ঘুরতেই রোখসানা বেগম আবারো মা হতে চলে। এবার প্রতীক্ষার পালা। যে করেই হোক অন্ধকার থেকে এবার পুত্র সন্তান ছিনিয়ে আনতে হবে। আলোকিত করে তুলতে হবে সামাজিক বন্ধন। প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলো। রোখসানা বেগম আবার জমজ সন্তান জন্ম দিলেন। একটা ছেলে, একটা মেয়ে।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। জমজ সন্তানের মুখ দেখা হলো না তার। সন্তানের মুখে তুলে দেয়া হলো না পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র দুধ। তারও অনেক আগেই তিনি চলে গেলেন। কাউকে কিছু না বলে নীরবে হাঁটলেন অজানার উদ্দেশ্যে।

রাতেই সুলতান খবর পায়। ফজরের নামাজের পরপরই মরা বাড়িতে এসে পৌঁছায় সে। চিৎকার করে কাঁদছে অনাথ শিশুগুলো। কোদাল হাতে সুলতান শুধু দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির আঙ্গিনায়। এত মানুষের ভিড়। এত মানুষের আর্তনাদ সবই দেখছে সে। মানুষগুলো কাঁদছে।

সুলতান তাকিয়ে আছে তাদের চোখের দিকে। এদের অনেকেই রোখসানা বেগমের আত্মীয় না, নেই কোনো রক্তের সম্পর্ক। তারপরও তারা কাঁদছে। তাদের কান্নায় কোনো কৃত্রিমতা নেই। সুলতান কোদাল হাতে বসে বসে তাকিয়ে থাকে বাড়িটার দিকে।

স্বপ্নঘরে জন্ম নিয়েছে দুটো শিশু। তারা জানে না তাদের মা নেই। মায়ের বুকের উষ্ণতা তারা পায়নি। পায়নি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র আদর। তবে কি এই শিশু দুটিও এক সময় অন্ধকার এক জগতে তার মায়ের ছায়া খুঁজবে?

কিন্তু এ শিশুদুটির জন্য কোন স্মৃতি রেখে গেল তার মা? তাদের জন্ম দিতে গিয়ে নিজের আত্মত্যাগের কথা কিভাবে স্বরণ করবে তারা? নাকি দুজোড়া চোখ আজীবন খুঁজে বেড়াবে মাকে না দেখার স্মৃতি। মা বলে ডাকতে না পারার বেদনায় কি কাঁদবে নীল আকাশ?

সুলতান কবর খুঁড়তে শুরু করল। মাটিটা অনেক নরম। ছিমছাম একটা কবর তৈরি করে ফেলল নিমিষেই। এখানেই চিরনিদ্রায় শুয়ে যাবে একজন মা। শুধু দূরে বড় হতে থাকবে অনাথ শিশুগুলো।

সুত্র: ইন্টারনেট।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×