ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিশাল গেট দিয়ে ঢুকে সিড়ি বেয়ে খানিকটা উঠতেই দেখলাম রিসিপশন ডেস্ক। ভাবলাম, এখানে জিজ্ঞেস করে নিই, ফরম কোথায় পাওয়া যাবে, কত তলায় এবং কার কাছে ফরম জমা দিতে হবে, কত ফি, হাতে পেতে কতদিন লাগবে। রিসিপশন ডেস্কে সাদা পান্জাবী পড়া, মাথায় টুপি দাড়িওয়ালা একজনকে বসে থাকতে দেখে ভাবলাম, ভালই হল, এই লোক নিশ্চয়ই ধান্দাবাজ হবে না। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই উনি জানালেন, ফরম উনার কাছে আছে, মূল্য ১০টাকা। ফরম পূরণ করে করে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হবে, আর বার্থ সার্টিফিকেট হাতে পেতে দুই সপ্তাহের মত সময় লাগবে। অথবা আমি তার মাধ্যমে করাতে পারি, উনি চারদিনের মধ্যে করিয়ে দিবেন, উনাকে ৫০০টাকা দেয়া লাগবে। বোঝা হয়ে গেল, এ্ই দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা পান্জাবী পরিহিত লোকটি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা হলেও দালাল ছাড়া আর কিছু নন। সামনে অগ্রসর হয়ে দু'একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা বলল, বার্থ সার্টিফিকেটের জন্য ৯তলা, ১২তলা কিংবা ১৫তলায় যান। লিফট চড়ে ৯তলায় উঠে সেখানে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখা পেলাম। উক্ত শাখার জনৈক ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতেই উনি জানালেন, উনি করিয়ে দিতে পারবেন, উনাকে ৪০০টাকা দেয়া লাগবে এবং ৪দিনের মধ্যে উনি করিয়ে দিতে পারবেন। বাহ্ একতলা থেকে ৯তলায় উঠতেই ১০০টাকা কমে গেল। তাহলে আরো উপরে উঠে দেখি, আরো কত কমে। এবার চলে এলাম, ১২তলার জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখায়। জনৈক ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতেই উনি জানালেন, উনি করিয়ে দিতে পারবেন, উনাকে ৩০০টাকা দেয়া লাগবে এবং উনিও ৪দিন সময় চাইলেন। আরো ১০০টাকা কমল। এবার ১৫তলায় যাওয়া যাক। দেখি আরো কত কমে। ১৫তলার জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখার জনৈক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হতেই মনে পড়ল, পাঁচ বছর আগে ইনিই ৬০০টাকার বিনিময়ে আমার বার্থ সার্টিফিকেট করিয়ে দিয়েছিলেন। পুরানো কপিতে উনারও স্বাক্ষর আছে। যদিও মূল স্বাক্ষরদাতা হলেন, সিটি করপোরেশনের তৎকালীন চীফ হেলথ অফিসার। পূর্বের কপিটি দেখে উনি জানালেন, উনি করিয়ে দিতে পারবেন, উনাকে ২০০টাকা দেয়া লাগবে আর উনি ২দিন সময় চাইলেন। আমি বললাম, আগের কপিটি তো আপনারই করা, আমি তো পুরোনো কপিরই আরেকটি কপি চাচ্ছি। তাহলে ২০০টাকা চাচ্ছেন কেন, তাছাড়া আমার একটু জরুরী ভিত্তিতে দরকার। আধঘন্টা ভেবে উনি জানালেন, ঠিক আছে, কালকে আসেন, আর টাকা কিছু বাড়িয়ে দিয়েন। আমি রাজী হয়ে গেলাম। পুরানো কপিটি তার কাছে দিয়ে চলে এলাম। পরদিন গেলাম সংগ্রহ করতে। বার্থ সার্টিফিকেটটি হাতে পেয়ে মনটা ভাল না হয়ে ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কারণ মূল স্বাক্ষরদাতা হিসাবে সিটি করপোরেশনের চীফ হেলথ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: নাসির উদ্দিনের স্বাক্ষর। প্রথমত: বার্থ সার্টিফিকেটের সবকিছুই ইংরেজীতে হলেও উনার স্বাক্ষরটি বাংলায়। এবং দ্বিতীয়ত, কোনমতেই একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের স্বাক্ষর এমন হতে পারে না (খুবই কাচা হাতের স্বাক্ষর)। আমার অফিসের পিওনও বাংলা এবং ইংরেজীতে এর চেয়ে ভাল স্বাক্ষর করতে পারবে। স্বাক্ষরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই উক্ত ভদ্রলোক জানালেন, ব্রিগেডিয়ার সাহেব অনেক ব্যস্ত, এসব ছোটখাট ব্যাপারে তার তেমন মাথাব্যথা নেই। চরম ব্যস্ততার ফাঁকে উনি খুবই দ্রুততার সাথে স্বাক্ষর করেন, তাই এমন হয়েছে।
বিরস বদনে সেখান থেকে চলে আসতে হল। এবার পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয় থেকে তা সত্যায়িতকরণ। চলে এলাম, মতিঝিল পাড়ায়, যেখানে অনেকগুলো অনুবাদ কেন্দ্র রয়েছে। বেশ কয়েকটিতে ফুঁ মারলাম। সকলেই চীফ হেলথ অফিসার ব্রিগেডিয়ার সাহেবের বাংলা স্বাক্ষর এবং স্বাক্ষরের ধরন নিয়ে সন্দীহান প্রকাশ করল। আমিও আমার অসহায়তা তাদের কাছে বর্ণনা করলাম। একটি অনুবাদকেন্দ্রের লোকেরা জানাল, কোন একবার চীফ হেলথ অফিসারের স্বাক্ষরবিহীন বার্থ সার্টিফিকেটও নাকি পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয় সত্যায়িত করেছে। যাই হোক, পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয় থেকে সত্যায়িত করিয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন অনুবাদ কেন্দ্র ৫০০ থেকে ১০০০টাকা পর্যন্ত চাইল। সবনিম্ন ৫০০টাকা যারা চাইল, তাদের কাছে বার্থ সার্টিফিকেটটি দিয়ে চলে এলাম। পরদিন পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয় কর্তৃক সত্যায়িত বার্থ সার্টিফিকেট কপিও হাতে পেলাম। অ্যাম্বেসীতে জমা দিলাম, তারাও তা গ্রহণ করল। বোধ করি, তারা পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয় কর্তৃক সত্যায়িত কিনা সেটিই ভাল করে দেখল।
সবশেষে নিজেকে প্রশ্ন করলাম:
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা হয়েও ৯, ১২, ১৫তলার সবাই নিজের ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত। তাহলে বার্থ সার্টিফিকেট সংগ্রহের অফিসিয়াল উপায় কি? চীফ হেলথ অফিসার যদি এতই ব্যস্ত থাকেন, তাহলে এই দায়িত্বটি উনি অন্য কাউকে দিলেই পারেন। পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয় কিসের ভিত্তিতে আমার বার্থ সার্টিফিকেট সত্যায়িত করল? ইংরেজী বার্থ সার্টিফিকেটে চীফ হেলথ অফিসারের বাংলা স্বাক্ষর একবারও কি তাদের চোখে পড়ে নি? আমাদের দেশ কি কোনদিনও বদলাবে না? আর কত অধঃপতনের দিকে আমরা যেতে থাকব?
আমাদের এক নেত্রী দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বলে মিথ্যাচার করছেন, অন্য নেত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের অলীক স্বপ্নে জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন।
সবশেষে আমজনতার একজন হয়ে নিজেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম: আজব দেশের আজব সিটি করপোরেশন এবং আজব তার পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয়!!!
বি.দ্র.: বার্থ সার্টিফিকেটে ব্যক্তিগত তথ্যগুলো আমি মুছে দিয়েছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৩২