আপনারা হয়ত আনিসুল হক এর প্রথম আলোতে প্রকাশিত কলাম পড়েন।আমার খুব ভাল লাগে ওনার কলাম। এক কথায় বলা যায় অসাধারন লেখেন তিনি তার প্রতিটি কলাম। ত আজকে প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর লেখাটি আপনাদের সবার সাথে শেয়ার করছি(হয়ত পড়েছেন)
কলামটির শিরনাম ছিলঃ দুর্নীতিই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা
তাহলে কি ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে দুর্নীতিকেই নীতি হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম, আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে, আমাদের পারিবারিক জীবনে, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে এবং আমাদের জাতীয় জীবনে? দুর্নীতি এই দেশে মোগল আমলে ছিল, কোম্পানি আমলে ছিল, পাকিস্তানি আমলে ছিল এবং বাংলাদেশ আমলে ধীরে ধীরে এটাকে আমরা আমাদের একমাত্র নীতি হিসেবে কায়েম করে ফেললাম। ছোটবেলায় গ্রামার বইয়ে পড়েছিলাম, সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এর ইংরেজি ট্রান্সলেশন হবে, অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি। এখন আমাদের জন্য প্রযোজ্য হলো, করাপশন ইজ দি অনলি পলিসি। আগে জমিদারের নায়েব-গোমস্তারা দুর্নীতি করত, আমিন-পেশকারদের দুর্নাম ছিল, দারোগাদের সদা-সর্বদাই রাখা হতো সন্দেহভাজনদের তালিকায়। এখন দুর্নীতি আমাদের জাতীয় নীতি, দুর্নীতি আমাদের প্রতিদিনের পথচলার একমাত্র জ্বালানি। কিন্তু আগে একটা নিয়ম ছিল, রাজা নিজে দুর্নীতি করতেন না, করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, রাজকোষ মানেই ছিল রাজার কোষ।
কিন্তু এখন কি আমরা সেই যুগে প্রবেশ করলাম, যে যুগে ঘুষ খাবেন না, এমন কোনো পদধারী পাওয়া হয়ে উঠবে ভার? রাজকর্মচারীদের কেউ কেউ বা অনেকেই চিরকালই ঘুষ খেয়ে এসেছেন, কিন্তু রাজা-উজিররা ঘুষ খান, এই খবর আজকালকার পত্রিকায় আমাদের পাঠ করতে হচ্ছে এবং আমরা, বায়ুসমুদ্রে বসবাস করে যেমন চারদিকে বাতাসের উপস্থিতির কথা ভুলে যাই, তেমনি যেন মেনে নিয়েছি এই কারবারটাকে একটা অনিবার্য আর স্বাভাবিক ঘটনা বলে। আমার পেশা-ভাই প্রকৌশলীদের কেউ কেউ বা অনেকেই দুর্নীতি করেন, এটা আমরা শুনতাম। ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে গঠিত ট্রুথ কমিশনে যখন দলে দলে প্রকৌশলীরা নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে খত দিতে লাগলেন, তখন জানলাম, কিন্তু এখন তো কেবল প্রকৌশলীরা নন, শুনতে পাই, আর খবরের কাগজে পড়তে পারছি, ঘুষের বখরা চলে যায় ওপরতলা পর্যন্ত।
সরকার কোনো কিছু কিনতে চায়, কোনো কাজের আদেশ দিতে চায়, তাকে টেন্ডার প্রকাশ করতে হবে, যিনি সর্বনিম্ন দরদাতা হবেন, তিনি কাজটা পাবেন। এটা করাই হয়েছে, যাতে দুর্নীতি না হয়। তবে শুনতে পাই, প্রথমে কেকের বড় ভাগটা খেয়ে নেন ওই উজিরালয়ের সবচেয়ে উঁচু তলায় যিনি বসে আছেন, তিনি। এ যে দেখছি বিড়ালের পিঠা ভাগের গল্প। বড় কামড়টা দেন উজির, তার পরের কামড়টা দেন নাজির, এইভাবে নিচতলার কোতোয়াল পর্যন্ত যেতে যেতে পিঠার আর কিছুই আস্ত থাকে না। এই ঘটনাও আমরা পড়লাম পত্রিকাতেই। কোনো একটা স্থাপনা বানানোর কথা বলে টাকা তোলা হয়েছে, সেটার ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে আবার টাকা তোলা হয়েছে, কিন্তু আদপেই ওই জায়গায় ওই ধরনের কোনো স্থাপনাই নেই। সর্বশেষ জানতে পারলাম, পত্রিকান্তরে, দোয়েল নামের একটা ল্যাপটপ দেশে সংযোজনের নাম করে সস্তার যন্ত্রাংশ বহুগুণ দাম বাড়িয়ে কেনা হয়েছে আর সেই সরবরাহের কাজ যাঁরা করেছেন, তাঁরা তাঁদের কমিশন দেশের বাইরে পৌঁছে দিয়েছেন কর্তাদের, এমনকি উজিরালয়ের উজির নিজেও তার ভাগ পেয়েছেন। উজির অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
একটা গল্প শুনলাম সেদিন। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। গল্পের কথক ঢুকেছেন এক মহাদাপুটের কক্ষে। সেখানে তিনি দেখলেন, একজন প্রকৌশলীর মুখের ওপরে মহাদাপুটে একটা কাগজ ছুড়ে মারলেন। রাগে মহাদাপুটে গরগর করছেন। পরে তিনি ওই প্রকৌশলীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ঘটনা কী। বস এত রাগ করেছেন কেন? প্রকৌশলী বললেন, ভাই, কী বলব, একটা কাজ করতে আসলে লাগবে ১০ কোটি টাকা। আমি সেটাকে ৩০ কোটি টাকার প্রজেক্ট বানিয়ে এনেছি। উনি বলছেন, এটা কোনো প্রজেক্ট হলো? যান, ১০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট বানিয়ে আনেন।
কত কথা শুনি। শোনা কথা দিয়ে নিউজ হয় না। তাই গল্পের ছলেই বলতে হয়। বলতে হয়, এই ঘটনা ও চরিত্র পুরোটাই কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কারও সঙ্গে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এই রকম আরেক উজিরের গল্প শুনেছি। একটা সাপ্লাইয়ের টেন্ডার হচ্ছে। উজির প্রথমেই সাপ্লায়ারকে বললেন, প্রথমে আমাকে এত কোটি টাকা দেন। তারপর লোয়েস্ট-হাইয়েস্ট দেখা যাবে।
এই যে টাকাটা কর্তাদের পকেটে যাচ্ছে, এই টাকা আসলে সাপ্লায়ারের নয়, জনগণের। দেশের গরিব মানুষ একটা বিড়ি খেলেও সরকারকে টাকা দেয়, একটা সিনেমা দেখলেও সরকারকে টাকা দেয়। বিদেশ থেকে টাকা আসে, সেটাও আসে গরিব জনগণের নামে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসে ঋণ হিসেবে, এটা জনগণকে সুদে-আসলে শোধ করে দিতে হবে।
মাঝে-মধ্যে তাই মনে হয়, আমাদের যদি সরকার ছোট থাকত, তাহলে আমরা হয়তো ভালো করতাম। সরকার ছোট হওয়া মানেই স্থবিরতা ছোট হওয়া, অদক্ষতা ছোট হওয়া আর দুর্নীতি কম হওয়া।
দুর্নীতি হচ্ছে এটা কোনো খবরই না। দুর্নীতি হচ্ছে, তা নিয়ে যত না উদ্বেগ, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগ আসলে হওয়া উচিত এটা নিয়ে যে, দুর্নীতি আমরা মেনে নিয়েছি। আমরা যেন জানিই, স্কুলের দারোয়ান নিয়োগ হবে, এ জন্য টাকা দিতে হবে অত, আর তার বখরা পাবেন ওইজন, সেইজন। আমরা যেন মেনেই নিয়েছি, একটা সরকারি কাজ বা কেনাবেচা হচ্ছে, অবশ্যই এতে টাকাপয়সার লেনদেন হবেই।
আর আছে ক্ষমতাবানদের নিজেদের নামে পারমিট-লাইসেন্স বের করা আর তা বিক্রি করে দেওয়া।
বহুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, আমার কৃষক দুর্নীতি করে না। আসলেই দুঃখ লাগে এই দেশের ৯০ ভাগ মানুষের জন্য। যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করছেন, অথচ যিনি ফসলের ন্যায্য দাম পান না, তাঁকে হয়তো যে দামে সার কিনতে হয়, যন্ত্রপাতি কিনতে হয়, বিদ্যুৎ কিনতে হয়, সেই দামের একটা বড় অংশ আসলে ঘুষ হিসেবে কর্তারা আগেভাগেই খেয়ে নিয়েছেন। দুর্নীতি তিনি করেন না, আমাদের মুখের অন্ন জোগান, তিনি দুর্নীতির শিকার অথচ দুর্নাম হয় তাঁরও। গার্মেন্টসের যে মেয়েটি প্রখর আলোর নিচে নিজের তারুণ্য ও জীবনীশক্তি নিঃশেষে দান করে আমাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করছে, সে কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, কিন্তু দুর্নীতিবাজ দেশের নাগরিক হিসেবে কলঙ্কের ভাগ আর দুর্নীতির কুফলের ভোগান্তি তার কপালেই জোটে বেশি।
এই ৯০ ভাগ নিষ্কলঙ্ক, নিরপরাধ খেটে খাওয়া মানুষের মুখের দিকে তাকিয়েই হয়তো সর্বশক্তিমান আজও আমাদের রোদ দেন, বৃষ্টি দেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০৮