সাম্প্রতিক সময়ে 'হক ও সত্য' নিয়মিতই পরাস্ত হয়ে আসছে মিডিয়ার কাছে। ফেসবুকে রাসূল সা. এর ছবি আঁকার প্রতিযোগীতা হয়, প্রতিবাদ করলে কোন কাজ হয়না। কিন্তু কারো সাহস থাকে তো বলুক জার্মানিতে কোন হলোকাস্ট হয়নি, অথবা হলোকাস্ট হলেও ৬০ লক্ষ ইহুদী নিধনের কথা ভূয়া কি অতিরঞ্জিত। হলোকাস্টের কোন প্রমান নেই এমন স্লোগান নিয়ে কেউ যদি ফেসবুকে গ্রুপ খোলে তবে সে নিশ্চিত অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যান হয়ে যাবে।
বিবিসি নিউজে ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী লক্ষাধিক লোককে ২ হাজার বলে প্রচার করা হয়। বিবিসি সিএনএন চ্যানেলে ইসরাইলী আগ্রাসনকে বলা হয় 'বসতি স্থাপন'। আর ট্যাংকের গোলাবর্ষণের মুখে ফিলিস্তিনী শিশুদের পাথর নিক্ষেপকে বলা হয় 'সহিংসতা'।
টিভি চ্যানেলঃ
নতুন বাংলা চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান চরিত্র বর্তমানে মুন্নি সাহা। জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে এ সময়ে প্রতিদিন একটা করে টকশো করেন তিনি। প্রতিটি টকশোতে তরিকত ফেডারেশনের লাইভ টেলি সাক্ষাৎকার নিয়ে তিনি যেমন পুলকিত তরিকত ফেডারেশনও পুলকিত। কিন্তু একটি বারের জন্যও এ ব্যাপারে জামায়াতের সেক্রেটারীর বক্তব্য বা অভিযোগ জানার কোন প্রয়োজন বোধ করেননা তিনি, টকশোতে আমন্ত্রণ জানানো তো বহু পরের কথা। অন্য কোন চ্যানেল যদি জামায়াত নেতাদের সাক্ষাৎকার বা বক্তব্য পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রচার করে তবে নিশ্চিত সে চ্যানেলের ভবিষ্যত চ্যানেল ওয়ানের দিকেই গড়াবে, এ তথ্য চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই জানেন।
মির্জা আব্বাসের বাসায় ব্যাবের সন্ত্রাসকে মিডিয়ায় সমালোচনা করা হয় 'কিছুটা বারাবারি' বলে। অথচ জামায়াতের মিছিল চলাকালে ঘটনাক্রমে সে পথ দিয়ে অতিক্রমকারী রাষ্ট্রপতির গাড়ির গতি হ্রাস করানোর অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ তিন নেতাকে দেয়া ৩ দিনের রিমান্ডকে অতিমাত্রায় যৌক্তিক বলে মাথা নাড়ান মুন্নিসাহা ও তার টকশোর অতিথিরা।
পত্রপত্রিকাঃ
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রত্যেকটি পত্রিকায় সংবাদ আসে, ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্রসংগঠনটি দেশের এই করেছে সেই করেছে, জাতির ক্রান্তিকালে তারা উদ্ধার কর্তার ভূমিকা পালন করেছে। ছোটখাট কিছু অভিযোগ থাকলেও আগামি দিনে তাদের হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে বলে বিজ্ঞ মতামত প্রকাশ করা হয়। . . . অন্যদিকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজে পরিচ্ছন্ন ও চরিত্র গঠনের কর্মসূচীবাহী এ সংগঠনকে উপস্থাপন করা হবে, "শুরু থেকেই বিতর্কিত ও জাঙ্গিবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত এ সংগঠনটি . . ." এই বলে। জাসদ বাসদ ছাত্রফন্ট ফরোয়ার্ড পার্টি ইত্যাদি নাম সর্বস্ব দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর খবর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। কিন্তু ছাত্র মসজিলস, শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন কি খেলাফত মজলিস ইত্যাদির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর খবর তো বটে এসব দলের নাম উচ্চারণ করাও যেন মিডিয়ার জন্য পাপ।
বাংলা ব্লগঃ
ব্লগগুলোতে দেখা যায় আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে উদ্ভট মন্তব্য করা হয়, রাসুল সা. এর বিরুদ্ধে কুরআনের বিরুদ্ধে করা সমালোচনা কখোনো কখোনো তা চরম অশালীন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এটি নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা। প্রতিবাদ করলে বহু সময় পরে সকলের পড়া শেষ হলে কখোনোবা পোস্ট সরানো হয়। কিন্তু ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের তাত্বিক সমালোচনাও যদি কেই করে তবে তার বিরুদ্ধে সাথে সাথে একশন।
ব্লগগুলোতে জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ সব শালীনতা ছাড়িয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষের কোন প্রতিক্রিয়া হয়না, কিন্তু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সমালোচনা করলে, তাও যদি ঘটনাক্রমে আগস্ট মাসে হয়, কর্তপক্ষীয় খড়গ নেমে আসে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইনডেমনিটি জারি করা থাকে, কেউ নির্ধারিত ছকের বাহিরে যুক্তি-প্রমাণ সহ কথা বললেও তাকে নিস্তব্ধ করে দেয় হয়।
বাংলাদেশ পেরিয়ে বিশ্বে কিংবা বিশ্বের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে, সর্বত্রই অসংখ্য রক্তের ফোঁটা, চোখের পানি কিংবা বিক্ষুদ্ধ প্রতিবাদ আটকে যায় এ সময়ের গণমাধ্যমগুলোর লৌহ শিকলে। নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ক্রমেই বিষাক্ত উঠছে বাতাস। তাদের কথা শোনার মত অথবা বলার মত কেউ নেই অথচ টেলিভিশন খুললে চ্যানেলেরও অভাব নেই, ইন্টারনেট খুললে ওয়েব সাইটের অভাব নেই কিংবা পত্রিকা স্টলে পত্রিকার অভাব নেই।
অন্ধকার কেটে যাবে, হতাশাও দূর হবেঃ
চোখের সামনে ঘটা সত্যকে মিডিয়ায় মিথ্যা হিসেবে দেখতে পাওয়া, মানবতার কল্যাণে কাজ করে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা পাওয়া, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারা- এ যে কত বড় কষ্ট তা কেবল ভুক্তোভোগীই জানেন। সারা বিশ্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বের শিকার মুসলিমরা অথবা ইসলাম নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠন। ফলে মুসলমানদের মধ্য থেকেই প্রতিরোধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে।
প্রতিরোধের সূচনাঃ
প্রতিবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল মক্কা কোলার মাধ্যমে, আর মিডিয়া জগতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বিশ্বের জনপ্রিয় ওয়েব সাইটের ভার্সন তৈরীর কাজে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন দেশের মুসলিম তরুণরা। উইকিপিডিয়ার বিকল্প তৈরী করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত কানাডীয় মুসলিম তরুণ মোস্তফা প্যাটেল। নাম দিয়েছেন ইলমপিডিয়া। বাংলা ভাষায়ও এটি পড়া যাবে। ১০০ তরুন বিনা পারিশ্রমিকে এজন্য কাজ করছেন। উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ওয়েব সাইটে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তীকর তথ্য পাওয়া যায় যারা বিকল্প হিসেবে তারা এ সাইটটি তৈরী করছেন বলে জানান।
ফেসবুকে রসূল সা. এর কার্টুন অংকন প্রতিযোগীতার প্রতিবাদ স্বরূপ কিছু মুসলিম তরুনরা তৈরী করেছে স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট ইসলামীক ফেসবুক ডট কম, মদীনা ডট কম, মিল্লাত ডট কম, ইত্যাদি। ইউটিউবের আদলে সৌদি আরবে তৈরী হেয়েছে নাকা টিউব। চালু হয়েছে ইমহালাল ডট কম। বাংলা পত্রিকায় সাম্প্রতিককালের একচেটিয়া বামতন্ত্রের বিরুদ্ধে অল্প হলেও বিকল্প দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। একাধিক বাংলা ব্লগ হয়ে একচেটিয়া কণ্ঠরোধের প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেছে। বিডি নিউজের বিকল্প হিসেবে একাধিক ২৪ ঘন্টা সংবাদ সংস্থা চালু হয়েছে।
সমাপনিঃ
মিডিয়া জগতের বিশাল বিশাল সম্রাটদের বিপক্ষে এসব প্রতিবাদ তেমন কিছুই না। আর এসব ওয়েব সাইটের নামের সাথে মক্কা, মদীনা, ইসলাম, মুসলিম এসব শব্দ যোগ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোগগুলো এককেন্দ্রীক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে সমালোচকদের মত। তবে আমাদের মতে, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে, তারা জেগে উঠতে শুরু করেছেন। এ প্রতিরোধ অব্যহত থাকলে ধীরে ধীরে আরো মানুষ এর সাথে যুক্ত হবেন। আরো দক্ষ লোক যুক্ত হবেন। উদ্যোগুলো আরো সার্বজনীনতা লাভ করবে, নতুনত্বের সমন্বয় ঘটবে। কেননা ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানব জাতির জন্য কল্যাণস্বরূপ। মুসলমানরা পৃথিবী শাসনকালে যা কিছু করেছেন তার কল্যাণ ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে সকলে লাভ করেছে। সুতরাং এই প্রতিরোধ উদ্যোগ পৃথিবীর সকল বঞ্চিত মানুষের আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৫:৫৫