আজ মা দিবস। আজ এই মা দিবসে আসুন না, মা বাবার মর্যাদা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জেনে নিই।
আমরা অতি সংক্ষেপে মা বাবার মর্যাদা সম্পর্কে কয়েকটি আল্লাহর বানী ও রাসূলের বাণী জেনে নিই।
‘মা’ ‘বাবা’। কতই না মধুর ডাক। যারা আমাদেরকে জন্মের পর থেকে শুরু করে সত্যিকারের মানুষ গড়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের দুঃখ-দূর্দশা, কষ্ট সহ্য করে এসেছেন।
* পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন- “হে মানুষ! তোমরা কিভাবে আল্লাহর সাথে কুফরী কর। অথচ তুমি ছিলে মৃত, আল্লাহ পাক তোমাকে জিন্দা করেছেন। জিন্দা থেকে আবার মৃত করেছেন। অতঃপর আবার তোমাকে জিন্দা করবেন। আবার তোমাকে সেই আল্লাহর কাছে ফিরে আসতে হবে।”
বিজ্ঞান দ্বারাও আজকে প্রমাণিত যে মানুষ জন্মের আগে মৃত ছিল। আর তা কেমন করে? তা হচ্ছে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন আমরা মৃত ছিলাম।
* আল্লাহ পাক বলেন- “সাবধান! তোমরা মাকে ভুলে যেও না। মাকে সম্মান করো। মা বাপকে মহব্বত করো। তাদেরকে শ্রদ্ধা করো।”
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, সুন্দরী বউ পেলে মা বাপের কথা আর মনে থাকে না। সুন্দরী বউয়ের কথামতো সন্তান তার মা বাপের উপর অত্যাচার করে।
আমরা মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলবো? কিভাবে আচরণ করবো? আল্লাহ তাআলা তাও শিখিয়ে দিয়েছেন।
* আল্লাহ পাক বলেন- “তোমরা মায়ের সাথে সম্মান করে কথা বলো, মোটা করে কথা বলো না।”
সন্তান হিসেবে আমাদের কাছে সবচাইতে বড় জিনিস হচ্ছে মা বাপ। মাওলানা সাহেবের দোয়া, পীর সাহেবের দোয়া, কবুল হতেও পারে, নাও হতে পারে। ৫০-৫০। কিন্তু মা বাবার দোয়া কবুল হবে, ১০০% নিশ্চিত।
* আমাদের নবী (সাঃ) বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছে কবুল হবে। (১) মজলুম ব্যক্তির দোয়া (যে অত্যাচারিত) (২) মুসাফিরের দোয়া (৩) মা বাবার দোয়া।
* মা বাবার জন্য আল্লাহ পাক আমাদেরকে যে দোয়াটা করতে বলেছেন সেটা হচ্ছে- “হে আমার রব! আমার পিতামাতা যেমনিভাবে আমাকে ছোটবেলায় লালন পালন করেছেন তেমনিভাবে তুমি তাঁদেরকে তোমার রহমতের কোলে লালন পালন কর।”
* আল্লাহ পাক বলেছেন- “দুনিয়ার মানুষ খবরদার! মায়ের সাথে নাফরমানী করবে না। মাকে কোন কষ্ট দিবে না। মাকে সম্মান করবে।”
* হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- ‘রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হইল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খেদমত করব কার? রাসূল (সাঃ) বললেন, মায়ের। তারপর কার? রাসূল (সাঃ) বললেন, মায়ের। তাকে আবার জিজ্ঞাসা করা হইল, তারপর কার? উত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন, মায়ের। তারপর কার? অতঃপর রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমার বাবার। তোমার পিতার চাইতেও তোমার মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশি। (সুবহানাল্লাহ)
আসুন না, আমরা মা বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। মা বাবার সেবা যতœ করি। বর্তমান সময়ে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, ছেলে তার বউকে পেয়ে মা বাবার কথা ভুলে যাচ্ছে। এটা কি আসলেই ঠিক। যে মা আমাকে, আপনাকে ১০মাস গর্ভধারন করে কতই না কষ্ট সয়েছে, আর আমরা সেই মাকে আজকে পাঠাচ্ছি বৃদ্ধাশ্রমে।
* রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “মা বাপ হচ্ছে তোমাদের বেহেশত, মা বাপ হচ্ছে তোমাদের দোজখ।”
[অর্থ্যাৎ যদি আমরা মা বাবার কথামত চলি, মা বাবার মনে কোন কষ্ট না দেই তাহলেই আমাদের জন্য বেহেশত সোজা হয়ে যাবে। আর যদি মা বাবার মনে কষ্ট দেই মা বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করি তাহলে দোজখ চিরধার্য।]
আমরা বায়েজীদ বোস্তামির ঘটনাটাই মনে করি না কেন! যে ঘটনাতে ছিল মাতৃভক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যে বায়েজীদ সারারাত পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মায়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ফজরের আযান হল। মা ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন। তিনি দেখতে পেলেন বায়েজীদ পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। মা বললেন হে বায়েজীদ! তুমি এখানে এ অবস্থায় কেন? বায়েজীদ বলল, মা তুমি গভীর রাতে পানি চেয়েছিলে। কিন্তু পানি ঘরে না থাকায় অনেক দূর থেকে পানি এনেছিলাম তোমার জন্য। কিন্তু এসে দেখি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। তাই যতণ না তুমি ঘুম থেকে উঠবে ততণ আমিএই পানির গ্লাস নিয়ে তোমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ কথা শুনার সাথে সাথে বায়েজীদের মা বায়েজীদকে বিছানায় কম্বল দিয় শুইয়ে দিল। আর ফজরের নামায শেষে মা বায়েজীদের জন্য এই বলে দোয়া করলেন যে, হে আল্লাহ আজকে বায়েজীদ আমার জন্য যা করেছে তার জন্য আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে। হে আল্লাহ আমি তার মা হয়ে দোয়া করি, তুমি তাকে সুলতানুল আরেফীন বানাইয়া দিও। আর সেই দোয়া শেষ পর্যন্ত মঞ্জুর হয়ে গেল।
* আল্লাহ পাক বলেছেন- “তোমার ইবাদতের পরই হচ্ছে তোমার মা বাপ। তাই তোমরা মা বাপকে সম্মান কর।”
আসুন মা এর সম্মান নিয়ে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) এর ঘটনা পড়ি।
একদিন হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর নিকট এসে কাঁদছেন। রাসুল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু হোরায়রা তুমি কেন কাঁদছ? আবু হোরায়রা বললেন, আমার মা আমাকে মেরেছেন। রাসুল (সাঃ) বললেন, কেন তুমি কি কোন বেয়াদবী করেছ? আবু হোরায়রা বললেন, না হুজুর কোন বেয়াদবী করিনি। আপনার দরবার হতে বাড়ি যেতে আমার রাত হয়েছিল বিধায় আমার মা আমাকে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি আপনার কথা বললাম। আর আপনার কথা শুনে মা রাগে আমাকে মারধর করল আর বলল, হয়ত আমার বাড়ি ছাড়বি আর না হয় মুহাম্মদ (সাঃ) এর দরবার ছাড়বি। আমি বললাম, ও আমার মা। তুমি বুড়ি মানুষ। তোমার গায়ে যত শক্তি আছে তত শক্তি দিয়ে মারতে থাকো। মারতে মারতে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দাও। তবুও আমি আমার রাসুলকে ছাড়তে পারবো না। তখন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমার মা তোমাকে বের করে দিয়েছেন আর এজন্য আমার কাছে নালিশ করতে এসেছ? আমার তো এখানে কিছুই করার নেই। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বললেন, হে রাসূল (সাঃ) আমি আমার মায়ের জন্য এখানে নালিশ করতে আসি নাই। রাসুল (সাঃ) বললেন, তাহলে কেন এসেছ? আবু হোরায়রা বললেন, আমি জানি আপনি আল্লাহর নবী। আপনি যদি হাত উঠিয়ে আমার মায়ের জন্য দোয়া করতেন, যাতে আমার মাকে যেন আল্লাহ হেদায়েত করেন। আর তখনই সাথে সাথে রাসুল (সাঃ) হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমি দোয়া করি আপনি আবু হোরায়রার আম্মাকে হেদায়েত করে দেন।” রাসুল (সাঃ) দোয়া করলেন আর আবু হোরায়রা বাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। পিছন থেকে কয়েকজন লোক আবু হোরায়রার জামা টেনে ধরল এবং বললো, হে আবু হোরায়রা! তুমি দৌড়াচ্ছ কেন? তখন আবু হোরায়রা বললেন, ওহে সাহাবীগণ তোমরা আমার জামা ছেড়ে দাও। আমাকে দৌড়াতে দাও। আমি দৌড়াইয়া বাড়িতে গিয়ে দেখতে চাই আমি আগে পৌঁছলাম নাকি আমার নবীজির দোয়া আগে পৌঁছে গেছে। হযরত আবু হোরায়রা দরজায় নক করতে লাগলো। ভিতর থেকে তার মা যখন দরজা খুললো তখন আবু হোরায়রা দেখলেন তার মার সাদা চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। তখন মা আমাকে বললেন, হে আবু হোরায়রা! তোমাকে মারার পর আমি বড় অনুতপ্ত হয়েছি, অনুশোচনা করেছি। মনে মনে ভাবলাম আমার ছেলে তো কোন খারাপ জায়গায় যায়নি। কেন তাকে মারলাম? আমি বরং লজ্জায় পড়েছি তোমাকে মেরে। হে আবু হোরায়রা! আমি গোসল করেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি রাসুল (সাঃ) এর দরবারে নিয়ে চল। আর তখনই সাথে সাথে আবু হোরায়রা তার মাকে রাসুল (সাঃ) এর দরবারে নিয়ে গেলেন। আর তার মাকে সেখানেই কালিমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেলেন।
এইরকম আরো অসংখ্য অসংখ্য ঘটনাবলী বিদ্যমান। আসুন আমরা সবাই এসব ঘটনাবলী কোরআন ও হাদীস থেকে অধ্যয়ন করে মা বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি এবং তাদের সেবা যত্ন করে বেহেশত লাভ করি। আমিন।
[আমার এই লেখায় ভুল-ক্রুটি থাকতে পারে। দয়া করে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।]