কয়েকমাস আগে নীলক্ষেতের এক বইয়ের দোকানী বলছিল_'এই দুইভাই আছে বইলাই এখনো বইয়ের ব্যবসাডা টিইকা আছে। এই সুযোগে এরা যা শুরু করছে......."
আমি বিদেশী সাহিত্যের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত। বাংলা সাহিত্যও পড়ি তবে সেগুলো বিভুতিভূষণ-তারাশঙ্কর আমলের, এবং পরবর্তীতে আখতার উজ জামান ইলিয়াসের পরেই আমার বাংলা সাহিত্য থেকে মোটামুটি ইস্তফা নেয়া হয়ে গেছে।বাংলা সাহিত্যের প্রতি উন্নাসিকতা নয়, ভীষণরকম মুগ্ধতাই আছে, তবুও বিদেশী বই পড়ার পর আর তেমন সময় পাইনা বলেই ইদানীংকালের বইগুলো সেভাবে পড়া হয়না।
হুমায়ুন আহমেদের বই কখনই সেভাবে আগ্রহ নিয়ে পড়া হয়নি। অনেক বছর আগে এপিটাফ, আর অমানুষ পড়েছিলাম। অতিসম্প্রতি বুয়েটের এক বন্ধুর বিশেষ অনুরোধে 'জোছনা ও জননীর গল্প' শেষ করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, ৩টি বই-ই চমৎকার লেগেছে, যদিও শেষোক্তটি ক্ষেত্রবিশেষে ঝিমানীও ধরিয়ে দিয়েছে। একজন লেখককে মূল্যায়ন করার জন্য মাত্র ৩টি বই যথেষ্ট কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে, বিশেষত লেখকটি যদি কযেকশো বই লিখে একটি ভাষার জনপ্রিয়তম লেখকে পরিণত হন। তাই হুমায়ুন আহমেদের ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমাকে অন্যদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
আমার পরিচিত মহলে হুমায়ুন আহমেদের ভক্সংখ্যা অগণিত। তবে তার প্রতি সেইসব ভক্তদের ধারণা শুনে অবাক হয়েছি। সবার কথাই মোটামুটি একইরকম_ 'চরম বিরক্তিকর, একঘেয়ে, অবাস্তব, গাজাখুরি।' আর আমার এক সিনিয়র আপু বলেছিলেন- 'হুমায়ুনের বই হচ্ছে হাওয়াই মিঠাইয়ের মত, পড়ার পর আর মনে থাকেনা। ধরো, তুমি দূরে কোন জায়গায় যাচ্ছো ট্রেনে করে, তখন টাইম পাস করার জন্য পড়তে পারো। এরপর পড়া শেষে টয়লেট ট্যিসু হিসেবেও ব্যবহার করতে পারো, জানালা দিয়ে ছুড়েও ফেলতে পারো।' .....এমন যাদের মূল্যায়ন তারাই বইমেলায় উপচে পড়া ভীড় জমায় অন্য প্রকাশ এর স্টলের সামনে। মাঝে মাঝে মেলায় গেলে মনে হয় ঐ স্টলের সামনে বোধহয় মারামারি লেগে গেছে, এমনকি পিস্ট হয়ে দু-একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও অবাক হবনা। প্রশ্ন হচ্ছে, সবাই যদি হুমায়ুন আহমেদের প্রতি এতই বীতশ্রদ্ধ হন, তাহলে একই মানুষেরাই ভীড় ঠেলে ঐ লেখকের বই কিনছেন কেন!!
শুভাশিস নামে আমার এক বন্ধু আছে, পড়াশোনা করছে জাবিতে। ক্লাস নাইন থেকে সে নিজেকে 'হিমু' ঘোষণা করেছে, এখনও বইমেলা আসলে তাকে হলুদ পাঞ্জাবি কিনে দিতে হয় আমাদের। শুনেছি গতবছর বইমেলায় 'হিমুদের মিছিলেও' সে অংশ নিয়েছিল! তার কণ্ঠেও হতাশা- নাহ, হিমু সিরিজ আর ভালো লাগতেছেনা।' প্রশ্ন করি- 'এবার কি তাহলে হিমু কেনা বন্ধ করতেছো?' তার জবাব- 'পাগল হইছো মিয়া! হিমু না কিনলে কি চলে নাকি!"
অদ্ভুত আমাদের মনস্তত্ত্ব। ওর কথা শুনে আমাদের এলাকার এক প্রচলিত কৌতুকের কথা মনে পড়ে গেল_ আমার শহর মানিকগঞ্জ, তো প্রতিবার নির্বাচনের আগে মোটামুটি রব উঠে যে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের এবার ভরাডুবি ঘটবে তার সুপুত্রদের কীর্তিতে, কিন্তু প্রতিবাই তিনি সেই বৈতরণী পার হযে যান। তো, ২০০১ এর নির্বাচনের পর জনৈক বৃদ্ধ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন-' ভোট দিলাম ধানের শিষে, কিন্তু খা..পোলা দেলোয়ার জিতলো কেমনে??"
আমার বন্ধুর অবস্থাও হয়েছে সেরকম। তবে, সবাই যে হুমায়ুন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এমনটি নয়। বুয়েটেরই এক প্রাজ্ঞ সিনিয়রের সঙ্গে গতবছর ক্যান্টিনে কথা হচ্ছিল বই-লেখালিখি প্রসঙ্গে। অবাধারিতভাবে এল হুমায়ুন আহমেদ। তার বক্তব্য ছিল-" হুমায়ুনের লেখায় একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। সে যেসব আইডিয়া দেয় এগুলো আর কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব নয়। সাঈদ স্যার- সৈয়দ শামসূল হক সহ যেসব মহাপণ্ডিত তার সমালোচনা করেন, পারলে উনারা এমন কিছু লিখে দেখাক। এটা আসলে ঈর্ষা।"
পাঠ্যাভ্যাস পাঠকের নিজস্ব, কে কার বই পড়বে এ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই; বইপড়া একটি মহৎ গুণ। মানুষ বই পড়ছে এটা দেখলেই প্রশান্তি চলে আসে মনে। তবে পড়ার মাঝে ব্যবসায়ী স্বার্থ ঢুকে পড়লে মেনে নিতে কষ্ট হয়। এবার বাংলা লিংক হুমায়ুন আহমেদের বই নিয়ে যে নোংরামিটা শুরু করেছে তাতে বলতে হচ্ছি -শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ, আপনি এখন আর কোন সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করছেননা, আলু-পটল-বেগুন, কিংবা হারপিক টয়লেট ক্লিনারের মত আপনিও এই কর্পোরেট নীতির একটি সচল পণ্যমাত্র। আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন।
এবার আসি জাফর ইকবাল প্রসঙ্গে। আমার বইপড়াটা শুরুই হয়েছিল জাফর ইকবাল পড়ার মাধ্যমে। কিশোর উপন্যাস-সায়েন্স ফিকশন কোনকিছুই বাদ রাখিনি একটা সময়। এমনকি ২০০৪ সালের বইমেলায় শুধু তার বই-ই কিনেছি.; বলা যায় অন্ধভক্ত ছিলাম। কিন্তু পরের বছর থেকেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এখন আমি তার কোন বই পড়িনা। মাঝে মাঝে রুমমেটদের কাছে তার বই দেখি, একটু আধটু পড়ার চেষ্টা করি আর বিরক্ত হই। ৬-৭ বছর আগে যে ধরনের লেখা লিখতেন, এখনও তাই লিখে যাচ্ছেন। কোন বৈচিত্র নেই, সেই একই ঘরানরার কাহিনী। দুষ্টু ছেলের দল-বুবুনের বাবা-দীপু নাম্বার টু-বকুলাপ্পু-হাকারবিন, খেয়াল করে দেখবেন সবগুলো বইই প্রায় একইরকম। পাঠক চায় নতুনত্ব। একটি বইয়ের সঙ্গে আর একটি বইয়ের যদি ৭০-৭৫% মিল পাওয়া যায়, তাহলে নতুন বইটি পড়ে কী লাভ। তার সায়েন্স ফিকশন গুলোতেও এখন আর চমক পাইনা। হতে পারে, তার পাঠক সব কিশোর-কিশোরী, বড় হলে আর পড়েনা। কিন্তু প্রজন্ম পরিবর্তিত হলেও বই তো একই রয়ে যাচ্ছে। আমি যে বইটি পড়েছি আমার ভাগ্নেও তাই পড়বে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি পরিণত বয়স পর্যন্ত জাফর ইকবালের বইগুলো পড়েছি, আর ও কিশোর বয়সেই আমার পড়া বইগুলো শেষ করে ফেলবে। তখন ওর নতুন বই প্রয়োজন হবে। জাফর ইকবাল স্যার কি সেই চাহিদা পূরণে সক্ষম? আমি বলবো - 'না'। গণিত অলিম্পিয়াড-ত্রাণ-বন্ধুসভা নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে তিনি টিনএজ পাঠকদের বঞ্চিত করছেন। বইমেলা কেন্দ্রিক বই লিখতে গিয়ে কেবল পুরনো কাহিনীর চর্বিত চর্বন করে যাচ্ছেন। এই ব্যাপারটি আমাকে হতাশ করেছে। কারণ, কিশোরদের মানসিক জগতে জাফর ইকবালের অবস্থানটা অবিসংবাদিত, সেই অবস্থানটা ধরে রাখার ব্যাপারে তার সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
কিছুদিন আগে বুয়েটে আমরা একটি ক্রিয়েটিভ রাইটিং কর্মশালার আয়োজন করেছিলাম। তাতে অন্যান্য কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন। প্রশ্নোত্তর পর্বে উঠে আসে তার লেখক হওয়ার বৃত্তান্ত। তার ভাষায়- একটা সময দেখলাম লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই করতেপারছিনা। ভাগ্যান্বেষণে জার্মানী গেলাম, তখন ২-১টা বই বেরিয়েছে, আমর স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে অভাবের তাড়নায়.........." এরপর তার লেখার মান নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন- 'যেহেতু লিখেই বেঁচে থাকতে হবে, তাই আমি দেখতে লাগলাম কোন্ ধরনের লেখা মানুষ বেশি পড়ে। একসময় বুঝলাম, প্রেমের সুড়সুড়িধর্মী লেখাই তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে দ্রুত পৌছায়। তাই এ ধরনের লেখাই বেশি লিখি আমি। আমি নিজেও এগুলো লিখে সে অর্থে পরিতৃপ্ত নই। তবুও লিখতে হয় অনেকটা জোর করেই।"
তার স্পষ্টবাদীতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি জাবিতে এক কর্মশালার রেফারেন্স দেন যেখানে তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন হালের জনপ্রিয় লেখক সুমন্ত আসলাম। সুমন্ত আসলাম যাওয়ার পথে নাকি সারা রাস্তা ঘুরেফিরে তাকে একটি প্রশ্নই করেন - 'কিভাবে জনপ্রিয় লেখক হওয়া যায়!'
সুমন্ত আসলামের লেখা আমার যথেষ্টই বিরক্তই লাগে। পগতবছর 'তুমি ছুয়ে যাও বৃষ্টি তবু' পড়ার পর বইটি ২ তলা থেকে ছুড়ে ফেলেছিলাম মেজাজ খারাপ করে। তার লেখাগুলো অনেকটা এরকম _ 'ভীষণ ঠাণ্ডা গলায় তুমি যখন আমার নাম ধরে ডাকলে, আমার মনে হল চাঁদ এসে চিমটি কেটেছে আমার অবশ শরীরে............................."
বইমেলা আসলেই বিভিন্ন পেশাজীবীরা রাতারাতি লেখক হয়ে উঠেন। চিত্রনায়ক-গায়ক-পেইন্টার-ডিজাইনার...সবাই লেখক। ওমর সানি- এসডি রুবেল , এমনকি ক্লোজ আপ তারকা আবিদও বই লিখছে। লিখুক, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এরা ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহার করে লেখক হবার চেষ্টা করবে কেন। লেখালেখি একটি এলিট প্রতিভা, একে গণশিক্ষা কার্যক্রমের মত "সবার জন্য লেখক হওয়া কর্মসূচীর' আওতায় আনতে হবে কেন?
গতবছর গোলাম মুরশিদের 'মধুর খোজে' বইটি নিয়ে অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু মেলা শেষে দেখলাম খুব বেশি বিক্রি হয়নি। হাসান আজিজুল হক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, হায়াৎ মামুদ....এদের বইয়েরও পাঠক কমে আসছে ধীরে ধীরে। অথচ এদের লেখা পড়ে মনে হয়, লেখালেখি কতটা পরিশ্রমলব্ধ একটা অভিজ্ঞতা, লেখার জন্য জ্ঞানের গভীরতা কতটা হওয়া প্রয়োজন।
বই পড়ার অভ্যাসটাই কমিয়ে দিচ্ছে ডি-জুস কালচার, আর যারাও বা পড়ছেন তার অধিকাংশই পড়ছেন হুমায়ুন আহমেদ-জাফর ইকবাল । আমাদের সাহিহত্যপাঠ তাই অনেকটাই এখন এই দুইভাইয়ের কলমের ফাকে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এটাকে শুভলক্ষণ , নাকি অশনি সংকেত বলব সেই দোটানা বইমেলার প্রতিটি দিনজুড়ে কেবল বাড়তেই থাকবে অমীমাংসিত রহস্য হয়ে। শুভ বইমেলা।।।