[কেমন হবে যদি হঠাৎ করেই মাথার উপর আরও তিনটি চোখের সৃষ্টি হয়, কিংবা জিহ্বার পরিবর্তে বাগযন্ত্র হিসেবে নাসিকা ব্যবহৃত হয়, সর্বোপরি মানুষগুলোও সবসময় যদি ভূমির ১ফুট উপরের উচ্চতায় হেটে বেড়ায়...।বাস্তব জীবনে এগুলো অসংলগ্ন ভাবনা, কিন্তু বাস্তবতার ছত্রছায়ায় যে শুদ্ধ মনের বিকাশ ঘটে সেখানে এ জাতীয় ভাবনা যে নিতান্ত অচ্ছুত, সে কথা কি উচ্চকণ্ঠে বলা সম্ভব?মনের লেখচিত্র অংকনের সবচেয়ে বড় সমস্যা সম্ভবত এই যে মনকে কোন বীজগাণিতিক ফাংশনরূপে প্রকাশ করা যায়না ; হয়ত যেখানে সর্বোচ্চমান, সেখানকার মানই আবার সর্বনিম্ন! তাই মন, মান আর বাস্তবতার ত্রিমুখী সংকটে মানবিক চিন্তা-চেতনার মতো লেখকের লেখার ভাষাও হঠাৎ উল্টে গেলে “সাহিত্যের অপভ্রংশ” কি সোচ্চার হবে পরিমিত বোধ আদায়ের দাবিতে??হয়তো, হয়তো না!!]
(#)
“কাএ কাএ চেবেঁ য়কাথা ত্রচিবৈ টাছুকি মক ওলেহ খীমুতরীপবি রতিভূনুঅ রনেণ্টবমস তায়শ্চনি কেথা: খসু-খঃদু ইটানকো ক্তরিতিত্রামা তশিকাপ্র নায়হ। ওমিআ চেবেঁ ছিআ রজেনি কেপ্নস্ব থেসা য়েনি ত্রমাটিকএ রামকা, কএ জারদ,কএ রলানাজা tel-bus য়সাবা।দম্পস তেলব রনেবজীত্রছা রটাউম্পিক রআ কয়েক রজাহা ইব, ওবুত রমাআ রজারদ দফেস য়র্দাপ কিউ চ্ছেদি শ্রমিবিঅ খসু; তোইএ মিআ!!”-শত ব্যস্ততার মাঝেও দিনলিপি লেখাটা প্রাত্যহিকতার পর্যায়েই পড়ে লাবণির। সৃজনশীলতার পোকা নাকি মানুষকে তথাকথিত অকর্মায় পরিণত করে; যদিও তার কর্মপরিধি সুদূরবিস্তৃত _নাটক লেখা, ছবি আঁকা, আবৃত্তি-গান, ফ্যাশন ডিজাইন, ফটোগ্রাফি ,বেহালা বাজানো_সর্বত্রই সপ্রতিভ উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রচলিত অর্থে এগুলো কোন নির্ধারিত চাকরি না হওয়ায় নিজেকে “নিষ্কর্মা” ভেবে দারুণ পুলকিত হয় সে।অবশ্য পরিচয় দেবার মত পেশা একটা হতে পারত , কিন্তু “ডেন্টাল মেডিকেল ” থেকে পাশ করে একমুহূর্তের ভুলেও চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে চিন্তা করা আর হয়ে উঠেনি_ এটা লাবণির চরিত্রের এক অদ্ভুত খামখেয়াল(দুষ্ট খেয়ালও বলা চলে)।আত্মবিশ্লেষণ করতে গেলে নিজের স্বভাব লেখচিত্রের সঙ্গে বরাবরই y=tanx এর সাদৃশ্য খুঁজে পায় লাবণি _ অক্ষাংশের দুইপ্রান্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা অভিন্ন মানুষের মধ্যে ভর করে আছে।বয়সের শম্বুকগতি ২৯টি পহেলা বৈশাখ দেখে ফেললেও এখনও খালার সঙ্গে সাব-লেট থাকাটাই তার বিবেচনায় প্রকৃষ্ট সিদ্ধান্ত।কোলাহল, জনসমাগম তার অসহ্য লাগে , অথচ একা থাকতেও অস্বস্তি হয়; তাইতো কিছুক্ষণ পর পর খালার সঙ্গে কথা বলতেই হয় নিজেকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে।
তার অধিকাংশ কাজ-কর্মই চুক্তিভিক্তিক এবং কম্পিউটার কেন্দ্রিক হওয়ায় অতিমাত্রায় ঘরকুনো হয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন; আবার ছবি তোলার প্রয়োজনে হয়ত টানা কয়েকমাস বাইরেই কাটিয়ে দেয়!অতি স¤প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশনে “news presenter” হিসেবে নিয়োগ পাওয়ারও একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই লাবণি যদি একলা থাকার সপক্ষে যুক্তি দাড় করায় , খণ্ডানোটা হয়ত ততটা সহজসাধ্য হবেনা।
“কখনো সময় আসে - জীবন মুচকি হাসে ; ঠিক যেন পড়ে পাওয়া ১৪আনা”_সুমন চট্টোপধ্যায়ের গানের মত লাবণির জীবনপ্রবাহও পড়ে পাওয়া ১৪ আনাতে পরিপূর্ণ : কিছুদিন আগে চারুকলায় এক চিত্র প্রদর্শনী দেখা শেষে খেয়ালের বশে মন্তব্য লিখে আসার পর যে শিল্পীর প্রদর্শনী ওর মন্তব্যটা তাকে এতটাই বিমোহিত করে যে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি সেটি পড়ে শোনান_ “ দীর্ঘ ২ ঘণ্টা যাবৎ অভিভূত হওয়ার শত চেষ্টা করেও হতে পারলাম না। অথচ কী আশ্চর্য, প্রতিটি চিত্র বৈচিত্রের প্রগাঢ়তায় মনের কোণায় কোণায় যে রঙ ছড়িয়ে দিল তাকে মধ্যম বা গড়পড়তা বলারই বা সাধ্য কোথায়? তাই আমার মন্তব্য অদ্ভুত এক ‘দ্বৈত অনুভূতির ’ঝুলন্ত সেতু হয়ে রইল।”;পরদিন অধিকাংশ পত্রিকায় ওর সেই মন্তব্য ছাপা হল !চিত্রনাট্যের ১৪আনাটি আরও চমকপ্রদ : জীবনে প্রথম লেখা চিত্রনাট্যটি অনেক কট্টর প্রযোজক-পরিচালককেও বলতে বাধ্য করেছিল ‘এই মেয়ে ,তোমার মাথায় কী আছে বলতে পার!’; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যয়বহুল বিধায় চিত্রনাট্যটির চিত্রায়ণ মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তী ঘটনাটি অতিপ্রাকৃতিক :বলিউডের ‘লগান’ নামে যে সিনেমাটি কিছুদিন আগে অস্কার মনোনয়ন পেল আদতে তা তার সেই চিত্রনাট্যটিরই হিন্দি সংস্করণ!কাকতাল কি এতটাই বেতাল হয়ে উঠে মাঝে মাঝে? সম্ভবত মানুষ নিজের অজ্ঞাতেই তার শ্রেষ্ঠ নৈপূণ্য প্রকৃতিকে উপহার দেয়।
লাবণির রুমে প্রতিদিন সূর্যগ্রহণ, প্রতিরাতে অমাবশ্যা হয় ; তাই সর্বক্ষণ টিউব লাইট জ্বলে অন্ধকার দূর করতে ।এই আলো পর্দার উপর পড়লে রুমের অন্যান্য অংশ থেকে পর্দাটি আলাদা মনে হয়। এত তুচ্ছ বিষয় লক্ষ্য না করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আজ হঠাৎ সে ব্যাপারটি খেয়াল করল লেখার সময়: লিখতে লিখতে আনমনেই পর্দার দিকে চোখ চলে গেল এবং অবাক হয়ে পর্দার ওপর মানুষের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল যে কিনা পর্দার অপর পাশে স্থির বসে আছে। লাবণি তার মুখাবয়ব কল্পনা করতে চেষ্টা করল_ হায় হায়, সমস্ত মুখমণ্ডলে যে কুষ্ঠ রোগের চিহ্ন! তার বিস্ময়কে দ্বিগুণ করে নারীকণ্ঠে পর্দার মানুষটি কথা বলতে শুরু করল_
“শোন মেয়ে, এই ঘরটার ক্ষেত্রফল মাত্র ১২বর্গফুট; বাইরের পৃথিবীটাকে চেয়ে দেখ। সেখানে তোমার চেয়ে শত-সহস্র প্রতিভাধর মানুষ অনাহারে মরছে। খুবতো লেখার বড়াই কর; তোমার নিজের লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিতে পারবে যা মননকে স্পর্শ করে ,অথবা এমন কোন ডিজাইন কি করতে পেরেছো যা নিয়ে তুমি পরিতৃপ্ত?গানের কথা বলবে?সুরের সাথে প্রাণের মিলনে যে গান হয় তোমার কণ্ঠ কি সেরকম কিছু ধারণ করতে পেরেছে?.... অতএব তুমি অতিসাধারণ এক নিচুস্তরের মানুষ। ভেবে দেখো তুমি রাধতে জানোনা, মানুষের সাথে সহজভাবে মেলামেশা করতে পারনা, কী পার তুমি?তোমার যৎকিঞ্চিৎ প্রতিভা আছে, তাই বলে কি মানবীয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য তোমার ক্ষেত্রে অচল?"_লাবণি নিরুত্তর। দীর্ঘক্ষণ স্থির বসে থেকে একসময় কফি বানাতে রান্নাঘরে চলে গেল।
কফিতে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে রাগতভাবে পর্দার দিকে দৃষ্টি ফেরালো লাবণি; সেই মহিলার টিপ্পনীর সমুচিত জবাব দিতে হবে। কিন্তু লাবণির মনে হল পর্দার আড়ালে এখন অন্য কেউ এবং ওর অনুমানকে সত্যি প্রমাণিত করে পুরুষ কণ্ঠে কেউ কথা বলতে শুরু করল_
আহ!আজ জীবন পূর্ণতা পেল; তুমি কি জান ঈশ্বর দীর্ঘদিন ধরে শুধু তোমাকেই গড়েছেন, আর আমাদের হাত-পা সব নিম্নশ্রেণীর ফেরেশতারা গড়ার পর ঈশ্বর দায়সারাভাবে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এখানেই অন্যদের চেয়ে তোমার শ্রেষ্ঠত্ব! একই মানুষের পক্ষে কি লেখা,গান গাওয়া, ছবি আকা সম্ভব?অবশ্যই না।তাইতো এই নমশূদ্র তোমাকে নিয়ে গল্প লিখতে চায় লুবনা; জগতের সবাই তোমাকে লাবণি বললেও আমি তোমায় লুবনা-ই বলব, যে রবিঠাকুর কিংবা মিল্টনের নায়িকা নয়, একান্তই আমার কল্পনা।আমি জানি কোথায় তোমার একাকীত্বের বেদনা।শোন, স্মৃতি আমাদের সম্পদ যতটুকু, উপযোগিতার হেরফেরে বোঝাও হতে পারে সমপরিমাণে। তাই কলেজ জীবনের সেই কালো ছায়াকে দীর্ঘায়িত না করে তুমি বরং তার থেকে বেরিয়ে আসো, কারণ কলেজ জীবন সময়টাই হচ্ছে ভালো লাগার, সে সময় চোখে থাকে সোডিয়াম বাতি: কৃষ্ণকেও কার্তিক মনে হয়। সারাদিন বইয়ের মাঝে ডুবে থেকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখবে; তোমার এই স্বপ্নকে আমি সমীহ করি , কিন্তু সূর্যাস্তের সময় কেউ যদি তোমার খোলা চুলে মৃদু স্পর্শ করে কিংবা তোমার হাতে আকাশ-তোমার চোখে সূর্যোদয় দেখতে পায় কেউ ... তুমি নন্দনতত্ত্ব ভাল বোঝ, সত্যি করে বলতো কোন্ স্বপ্নটি তোমাকে স্বপ্নাতুর করবে?আমরা মনের দিক থেকে এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও এক অনতিক্রম্য অজানা-অদৃশ্য দেয়ালের দুইপ্রান্তে রয়ে যাব, হয়ত তোমাকে দেখাটাই আমার অদেখার আফসোস হয়ে থাকবে চিরকাল!তাই তুমি আমার নিয়তি নও, প্রণতিতে প্রবৃদ্ধ হও........ছুটির ঘণ্টা বাজে ঢংঢং/মেঘেরা হারায় বৃষ্টির রঙ/হাসির কোলে কান্না খেলে লুকিয়ে আড়ালে বিষাদ/তুমি কি হারাও নিজের ভিতর, শুনতে প্রাণের নিনাদ/অনুরাগটা অদেখা দেয়াল, পরিচয়ে প্রতিকূল/ ছায়ার মাঝে হারায় শরীর, আকাশে বৃষ্টিফুল/ঘাসফড়িঙের ডানায় স্বপ্ন; স্বপ্ন দেখার ভুল//
লাবণির সমগ্র অস্তিত্ব প্রচণ্ড ঝাকুনি খেল; কবি-শিল্পী- চিত্রকরের ঊর্ধ্বে মানুষ হিসেবে তার যে একটা পরিচয় আছে সেই স্বীকৃতি ক্রমেই কুয়াশার ধোঁয়াশায় মিশে যাচ্ছে।
প্রকৃতিগতভাবে যারা রোমাণ্টিক তারা হয়ত জীবনে সঠিক মানুষের সন্ধান পায়, কিন্তু জন্মগতভাবে রোমাণ্টিকদের অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিতই থাকে। তাইতো নিঃশব্দে তারা নিঃসঙ্গতার ভাষা অনুসন্ধান করে চলে।লাবণি বহু চেষ্টা করেও সেই দৈবপুরুষকে মন থেকে অপসারণ করতে পারছেনা; নিয়ামক হিসেবে দীর্ঘক্ষণ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে গোসল করল_যদি মাথা ঠাণ্ডা হয়!কিন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতেই পর্দার দিকে তাকালো সেই পুরৃষকে পাবার উদগ্র বাসনায়; যদিও এবারকার প্রতিবিম্বটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।ইতস্তত করতে করতে ধীর পায়ে পর্দার দিকে এগুতে উদ্যত হতেই অপর প্রান্তে শুদ্ধ ইংরেজি শুনে থমকে দাঁড়ালো সে_"nothing to lose, nothing to gain, nothing to create, nothing to damage, nothing to believe, nothing to disbelieve; living in the black-hole of nothing we all. May be it’s our life. Then এই পৃথিবীতে সবাই আগন্তুক; কেউ প্রার্থিত, কেউ অনাহূত , কেউ রবাহূত।কে জানে কে কোন্ জন?”
-এই ধরনের অসঙ্গত কথায় লাবণির মেজাজ বিগড়ে গেল, হাতে ধরা তোয়ালেটিই সবেগে পর্দায় নিক্ষেপ করে বসল; এতে সমস্ত পর্দাটি দুলে উঠল আর আড়ালের মানুষটিও যেন বাগ্মী হয়ে উঠল-
"কোন কোন সত্য খুব দুর্লভ হয় ম্যাডাম; আপনি অনেক নাম-যশ করলেন তাতে কী হল, অথবা ছন্নছাড়া-ভবঘুরে হয়ে থাকলেন সেটাই বা এমন কী দূষণীয়!আমরা কী অর্থপূর্ণভাবে অর্থহীন কাজ করে যাই ভেবেছেন কখনো?"
-“আপনি জগৎটাকে অসম্পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন বলে এ ধরনের নির্মাত্রিক কথা বলছেন; আয়নায় নিজেকে দেখলেই বুঝবেন কেন আমরা অর্থহীন কাজে আনন্দ পাই।”-লাবণির এ কথার প্রেক্ষিতেও লোকটি একইরকম নির্বিকার_
“ঠিক এই অংশটায়ই আপনার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করব।দেখুন আমি নিজের মত চলি: সকল জবাবদিহিতা- পিছুটানের বহু ঊর্ধ্বে আমার অবস্থান। কোনটি মানুষের স্বাভাবিক জীবন,কোনটি কাল্পনিক -সেই মানদণ্ড নির্ধারণ করবে কে?নৈতিক-অনৈতিক এসবের সংজ্ঞাই বা কে দিল?এই যে বেচারা রামানুজন সব ভুলে শুধু অংক কষে মাত্র ৩১এই মারা পড়ল , অথচ সে জানতেও পারলনা রোদের সাথে মেঘের খেলা কতটা আকর্ষণীয়; জীবনানন্দ কবিতা লিখে অর্ধেক জীবন নষ্ট করে ট্রামের তলায় অক্কা পেল; সে কি জানত পিচঢালা পথে নাঙ্গা পায়ে হাটায় কতখানি আনন্দ!E=mc^2 সূত্র আমি কেন শিখবো , কিংবা আপনার সাথেই বা এত কথা কেন বলছি?সবই ফালতু সময় অপচয়, nothing to solemnize, nothing to apologize, জীবনে একটি শব্দই everything & that’s – “nothing”--শেষের দিককার কথাগুলো লাবণির কর্ণগোচর হচ্ছিল না,সে তখন গভীর ভাবনায় নিমগ্ন_আজ কিছুক্ষণ পরপর ঘটে চলা এসব অদ্ভুত-অবিশ্বাস্য ঘটনার কী ব্যাখ্যা হতে পারে!ওর যতদূর ধারণা “ও” বেশ সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ;একা থাকাটা উপভোগ করলেও সবশ্রেণীর মানুষের সাথে নিঃসঙ্কোচে মিশতে পারে। সুতরাং hallucination-delusion সংক্রান্ত সমস্যার সম্ভাবনা অবান্তর, তাহলে?এই মুহূর্তে পর্দাটাকে কেবলই প্রেতাত্মার ছায়া মনে হতে লাগল, ওটার আশেপাশে যেতেও ভীষণ ভয় করছে ; কী আছে পর্দার অন্তরালে?
লাবণি এখন মনোবিজ্ঞানের মনোযোগী ছাত্রী ; পর্দা রহস্যের মীমাংসা করতেই হবে।ফ্রয়েড-ফুকো-কনফুসিয়াস যেন সারি বেধে বসে আছে ওর বিছানার ওপর অবিন্যস্তভাবে; এরই মধ্যে আবার অযাচিতভাবে পর্দার দিকে দৃষ্টিপাত: ফ্যানের বাতাসে রীতিমত উড়ছে সেটি, কিন্তু এর মাঝেও পর্দা ভেদ করে একটি ভরাট কণ্ঠস্বর তার কানে পৌছল
-“আমি “ইচ্ছাদেব”,যা ইচ্ছা তাই করতে পারি; একহাতে আমার অর্ধচন্দ্র, অন্যটাতে সৌরমণ্ডল।তোমার কি ইচ্ছে হয়না আকাশটাকে ছুয়ে দেখতে অথবা সবার নাগালের বাইরে থাকতে যাতে তোমার যে কোন কথাই সবাই অধস্তন হয়ে পালনে বাধ্য থাকবে। তোমার অগোচরে তোমাকে কে কী বলল জানতে চাও?তবে কান পেতে থাক, এখনই শুনতে পাবে_
১ম জন: আচ্ছা লাবণি নিজেকে কী ভাবে, সব ও একাই পারে, একাই বোঝে; আমরা সব মাথামোটা?
২য় জন:আরে, সেইদিন বলে কিনা একা থাকলে নিজেকে অনেক হালকা লাগে, নিজের ভেতর দ্বিতীয় অস্তিত্ত্বের উপস্থিতি বোঝা যায়!তাতো হবেই, একা ফ্ল্যাটে নিত্যনতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটানোর সুবর্ণ সুযোগ কে হাতছাড়া করে?
---- ঘৃণায় সমস্ত শরীরে আগুন ধরে গেল লাবণির। ওর মনের অবস্থা আচ করতে পেরে পর্দার ব্যক্তি ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করল_“নাহয় ওদের লেখার সমালোচনা করেছিলে, তাই বলে তোমার সম্পর্কে ওদের এত জঘন্য ধারণা!যাই হোক, তোমার নিশ্চয়ই মন খারাপ?আমি ইচ্ছাদেব, চল আজ তোমাকে পাখির মত শুন্যে ভাসাই, উড়লে মন ভালো হয়।”_
লাবণির ভ্র“ ঈষৎ কুঞ্চিত দেখে সে পুনরায় শুরু করল_“আমাকে অবিশ্বাস?ঠিক আছে, ছাদে গিয়ে পাখির মত দুহাত তুলে উড়বার চেষ্টা কর, দেখ আমি সত্যি কিনা।ভয় পেয়োনা, তোমাদের বিল্ডিং মাত্র ২তলা, তাই নিচে পড়লেও মরার আশঙ্কা নেই!” লাবণি কিছু একটা ভেবে দ্রুত ছাদে উঠে গেল, এরপর ছাদের শেষপ্রান্তে গিয়ে দুহাত তুলে......................এরপর??
বিছানায় সটান শুয়ে আছে লাবণি। শরীরে ব্যাণ্ডেজ, গতকাল কী ছেলেমানুষি করেছিল মনে পড়তেই ভীষণ হাসি পাচ্ছে।সবাই জানে “ও” হঠাৎ ছাদ থেকে পা হড়কে নিচে পড়ে গেছে , কিন্তু আসলেই কি তাই? collar-bone টা স্থানচ্যুত হয়ে গেছে, সুস্থ হওয়া কমপক্ষে দুইমাসের মামলা । এই দীর্ঘ কর্মবিরতির যন্ত্রণা শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও দুর্বিষহ, এটা ভাবতেই নিজের গালে কষে চড় মারতে ইচ্ছে করছে ওর।চলৎশক্তি ফিরে আসলে সবার আগে ওই অলক্ষুণে পর্দাটাকে ভস্মীভূত করাই আপাতত লাবণির লক্ষ্য।পর্দাটি ডেন্টাল মেডিকেলে পড়ার সময় কেনা; এতদিনের স্মৃতিবিজড়িত সম্পদকে সরিয়ে ফেলতে কেমন একটু সঙ্কোচ হচ্ছে, তাই বিছানায় শায়িত অবস্থায়ই করুণ দৃষ্টিতে পর্দার দিকে তাকালো সে এবং যথারীতি সেখানে কেউ অপেক্ষা করে আছে। লাবণির ইচ্ছে করছিল তখনই ছুটে গিয়ে পর্দাটাকে ছিড়ে-ফুড়ে আড়ালের মানুষটিকে আলোতে নিয়ে আসার।কিন্তু ইচ্ছা যে অনিচ্ছার চোরাগলিতে পথ হারিয়ে ফেলেছে :চিরচেনা হাত দুটিকে এক ইঞ্চি উপরে তুলবার মত শক্তিও সঞ্চিত নেই শরীরে। লাবণির এই অসহায়ত্বকে পর্দার নারীকণ্ঠ বিদ্রুপ করতে আরম্ভ করল_
“ছিঃ লাবণি,তুমি এইভাবে শুয়ে আছো!তুমি কি জানো এষা গান গাইতে প্যারিস
যাচ্ছে , লামিয়া interior design competition এ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া zone এ প্রথম হয়েছে, আসছে বইমেলায় শারমিনের কবিতার বই প্রকাশিত হবে........এত লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল আর তুমি জেগে জেগে দিবাস্বপ্ন দেখছো?ছিঃ ছিঃ । মেধায় ওরা কে তোমার সমকক্ষ?অথচ নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস দেখ!যাও এক্ষুণি ওদের থামাও, অথবা দোয়া কর যেন বিমান দুর্ঘটনায় এষা-লামিয়ার মৃত্যু হয়।.......বিথীকাকে দেখেছো ইদানীং কেমন চড়–ই পাখির মত উড়ে বেড়ায়; চেহারায় যেন ক্লিওপেট্রা-শকুন্তলার সংমিশ্রণ_এক তুড়িতে মুনী ঋষিরও লক্ষ বছরের ধ্যান ভেঙ্গে দেবে।তুমি বরং ওর মুখটা এসিডে ঝলসে দাও, পারবে তো?দ্রুত , দ্রুত ,যত দ্রুত পার যাও; দেরি হলে কিন্তু পস্তাবে.....!
লাবণি ছোট্ট নিঃশ্বাস নিল,নাসারন্ধ্রে কিছু একটা সেঁটে যাচ্ছে মনে হয়: পর্দাটি ক্রমশ নিকটতর হতে হতে লাবণির নিঃশ্বাসের সাথে লাবণির সত্তার মাঝেই লীন হতে চাইছে যেন!অসুস্থ লাবণি পারবে কি তার গতিরোধ করতে?