[তারুণ্যের শুরুর দিনগুলোতে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াকালীন প্রায় সবারই মানিক বন্দোপধ্যায়ের বহুল আলোচিত ”পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। মূল বক্তব্য যা-ই হোক, উপন্যাসের নায়িকা কপিলাকে কেউ কামতাড়িত ভাবেনা; বরং আজও কলেজ পড়–য়া অধিকাংশ তরুণের বুকপকেটে কপিলার জন্য বিশেষ স্থান বরাদ্দ থাকে। লেখক নিজেও হয়ত সেটি জানতেন; তাই সমাজ-সংসার-সংস্কারকে উপেক্ষা করে কপিলাকে কুবেরের অজানা ময়নাদ্বীপে যাত্রার সহযাত্রী করেছেন। অন্ধকার রাত্রি; নেীকার ছাদনতলায় শুধু কুবের আর কপিলা; নেীকা দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে চলছে স্রোতের সমান্তরালে, চারদিকে নিস্তব্ধতা.....কেবল কপিলা আর কুবের.......পাঠকমাত্রই এরপর কোন রসাতœক পরিস্থিতি কল্পনা করবেন।এভাবে আমাদের প্রত্যেকের উপন্যাস পাঠ পর্বের সমাপ্তি ঘটে একটি ভীষণ অতৃপ্তিসুচক জিজ্ঞাসা নিয়ে-”এরপর কি “হয়”? সুচতুর মানিক বন্দোপধ্যায় বিপদ আঁচ করতে পেরে পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে আতœরক্ষা করেছেন। ফলে ময়না দ্বীপের ময়না পাখিটি আমাদের অদেখাই রয়ে গেছে।সম্প্রতি এক বিকারগ্রস্থ তরুণ নিজেই সেই অসমাপ্ত কর্মটি সম্পণœ করার দায়িত্বভার গ্রহণ করায় একটি ঐতিহাসিক সাহিত্য-সংকটের নিরসন ঘটতে যাচ্ছে। মূল লেখক পরকালের হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত থাকায় তার অনুমতি সংগ্রহ সম্ভব হয়নি; তবে আশা করি এতে তিনি আনন্দিতই হবেন]
(১)
কার্তিক শেষে অগ্রহায়ণ আসার অপেক্ষায়। বছরের এই সময়টাতে ময়না দ্বীপে কোন কর্মচাঞ্চল্য থাকেনা। দ্বীপে অবস্থানের তিনবছর পূর্ণ হয়েছে কুবেরের ; তার মাথায় বাবড়ি চুল, চোখ দুটো নেশায় ঢুলুঢুলু; এই বিশাল দ্বীপের সে এখন একচ্ছত্র অধিপতি ; একদার গভীর অরণ্য ময়নাদ্বীপ আজ নরশিশুতে পরিপূর্ণ- তিনবছরে কপিলা তাকে উপহার দিয়েছে আড়াইটি সন্তান (বর্তমানে সে অন্তঃসত্ত্বা বিধায় ২+১/২)। দ্বীপে আসার রাত্রে নেীকার অন্দরে নর-নারীর যে চিরন্তন খেয়াল তাদের মধ্যে ভর করেছিল তারই পরম্পরায় প্রতি বছর চলছে নব অতিথির সৎকার ; কুবেরের দ্বীপে এটিই নিয়ম। বিয়ের এক বছরেও কোন দম্পতি সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ হলে তাদের সংসার ভেঙে একঘরে করে রাখা হয়- বন্ধ্যা নারী এবং অক্ষম পুরুষ- দুই-ই এখানে পরিত্যাজ্য । এ দ্বীপে কোন দম্পতির বিয়ে হয়েছে কতবছর তা হিসাব করা হয় সন্তানের সংখ্যা গণনার মাধ্যমে; ফলে দাম্পত্যের অর্থ এখানে আদিমতা, বেঁচে থাকার সুখ কৃত্রিমতা , দায়িত্ববোধ সন্তান উৎপাদনের আদিখ্যেতা। আগেকার মত এখনও নদীই এখানকার মানুষের জীবিকার মাধ্যম হলেও ধরনে এসেছে পরিবর্তন; এখন তারা মাছ ধরেনা, ধরে মানুষ! তাই নেী-সওয়ারিদের কাছে জলদস্যু কুবের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম; তাকে ধরতে কতবার পুলিশি অভিযান হল, কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে ময়নাদ্বীপ এতটাই বিচ্ছিন্ন যে পৃথিবীর কোন পুলিশের সাধ্য নেই এখান থেকে কোন অপরাধী ধরবে। একবার এক দুঃসাহসি অফিসার অল্প কিছু ফোর্স নিয়ে এসেছিল ময়না দ্বীপে... এরপর সেই অফিসারের খণ্ডিত লাশ সাতদিন ঝোলানো ছিল গাছের সঙ্গে, বাকিদের পরিণতি জানা যায়নি। শেতলবাবুর মত চুনোপুটির কাছে মাছ বিক্রির পাওনা টাকা চাইতে যে কুবের ভয়ে জড়সড় হত, সেই একই লোকই কী অবলীলায় জাদরেল এক পুলিশকে পরপারে পাঠিয়ে দেয় ! “মানুষের রূপান্তর কী অদ্ভুত”-কুবের ভাবে আর হাসতে থাকে; সে হাসি ছড়িয়ে পড়ে ময়না দ্বীপের সর্বত্র, যে হাসির প্রতি অংশে মিশে আছে নির্মমতা!
তিনবছরে অনেকটাই কেমন বুড়িয়ে গেছে কপিলা; শরীরের সেই উন্মাদনা সন্তান ধারণের প্রাত্যহিকতায় কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। ইন্দ্রিয় সুখ বরাবরই তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে; এ দ্বীপে নৈতিকতার বাঁধন অনেক শিথিল হওয়ায় এখানকার শুরুর দিনগুলো ছিল উদ্দামতায় পরিপূর্ণ। এসময় আরোও এক কুবেরের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার জীবনে যে কুবের আসল কুবেরের ছিল সবচেয়ে কাছের মানুষ-গণেশ। ভোলা-ভালা স্বভাবের গণেশ নিরুদ্দেশ কুবেরকে খুঁজতে বন্ধুত্বের টানে ছুটে এসেছিল বিজন ময়না দ্বীপে; বেঁচে থাকার জন্য কুবের তখন অমানুষিক খাটুনিতে ব্যস্ত। রাত দিন ভুলে সে দ্বীপের আদ্যোপান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে একটা কিছু অবলম্বন খুঁজতে ; সে মুহূর্তে কপিলা তার কাছে ঐচ্ছিক বিষয়। কিন্তু কপিলার চিন্তা-ভাবনা ছিল ভিন্ন; তার কাছে ময়না দ্বীপে আসার একটাই অর্থ -‘কুবেরের কাছাকাছি আসা’। সেটিতে ব্যাঘাত ঘটায় স্বভাবতই মনে জমা হতে থাকে ক্ষোভ। দুঃখ ভূলতে কুবেরের অনুপস্থিতিতে ভোলা-ভালা গণেশের সঙ্গে গল্প করেই তার সময় কাটতে থাকে; সেই গল্পের সূত্র ধরেই ধীরেধীরে ঘনিষ্ঠতা, এরপর সুযোগ হলেই দ্বীপের কোন কাঁশবনে হারিয়ে যাওয়া.....! শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও কপিলার ্ এ আকস্মিক পরিবর্তন ঠিকই কুবেরের নজরে পড়ে; বিশেষ করে গণেশের সঙ্গে কপিলার কথা বলার ধরনে পদ্মার তীরের পুরনো কপিলাই যেন ফিরে আসে- সেই একই রকম কামাতুর, ছলাকলায় পারদর্শী! কুবেরের মাথায় খুন চেপে যায়; গণেশকে সে সোজাসুজি দ্বীপ ছেড়ে যেতে অনুরোধ করে, কিন্তু গণেশ তখন অন্য মানুষ- কপিলার কৃপাচিহ্ন তার সত্তা জুড়ে, সে কী করে কুবেরের কথা শুনবে? কেতুপুরে থাকতে শ্যামাদাস এসে একবার কপিলাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল; এতদিন পরে আর কোন শ্যামাদাসকে কুবের সহ্য করতে পারেনি। তাই যে গণেশকে সঙ্গী করে অসংখ্য রাত নদীতে মাছ ধরে কাটিয়েছে, সামান্য এক নারীর মোহে গণেশকেই মাছের খাদ্য বানায় সে। গণেশকে দিয়ে শুরু...এরপর মানুষ মারতে কখনই দ্বিধাবোধ করেনি কুবের; কপিলাকেও হয়ত সে মেরেই ফেলত, কিন্তু নারীর ছলনার কাছে সে ছিল নিতান্তই শিক্ষানবিস। তাই রাত্রিকালীন বিশ্বভ্রমণেই (!)কুবের সন্তুষ্ট, তুষ্ট কপিলাও - কুবেরকে পর্যটক হিসেবে পেয়ে। তবে কপিলা এখন কুবেরের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পায় ; যে লাজুক কুবেরকে সে চিনত-ভালোবাসত সে কুবের বহুদিন আগেই ময়নাদ্বীপের অরণ্যে হারিয়ে গেছে; এই কুবের কুখ্যাত জলদস্যু, দ্বীপের সুর্যোদয়-সুর্যাস্তও যার নিয়ন্ত্রণাধীন । কুবেরও কেন যেন দিনদিন তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে; ইদানিং সে অন্য দেশেও(!) ভ্রমণ করে, কপিলার কিছুই বলার থাকেনা। তার পৃথিবীর দর্শনীয় স্থানগুলো এখন পুরাকীর্তি, আর কুবের চায় আধুনিক স্থাপত্য; কপিলা তা পাবে কোথায়?
শিক্ষার আলো ময়নাদ্বীপের প্রবেশদ্বারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখানে শিশুদের ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত গণনা শেখানোর মাধ্যমেই শিক্ষা তার দায় এড়ায়; তার বদলে তাদের শেখানো হয় কিভাবে অতর্কিত নদীতে হামলা করতে হয়, পুলিশকে ফাকি দিয়ে নিরাপদে দ্বীপে ফিরে আসা যায়। অন্যদিকে ১৪বছরের পর কোন মেয়ের কুমারী থাকা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বলে মেয়ে শিশুরা এই গণনা শেখা থেকেও বঞ্চিত; তাদের রান্নাঘরকেন্দ্রিক শৈশব কেবলই প্রতীক্ষায় থাকে ১৪বছরের, জীবনের সঠিক গন্তব্যও নিহিত এই ১৪তেই! হয়ত সেকারণেই বুলিসর্বস্ব কেতাদুরস্ত শিক্ষা ভাগাড়ে বসে বিশ্রাম নেয় কুবেরের প্রতাপে!জীবনের আরেক মেীলিক চাহিদা চিকিৎসা তার বিধ্বস্ত স্বরূপ প্রদর্শন করে আসছে সেই সূচনালগ্ন থেকেই। ডাক্তার-ডাক্তারখানা পরের কথা-সামান্য বদ্যিও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমিনুদ্দি-রইসের মত দু’একজন তন্ত্র-মন্ত্র করলেও তাতে সামান্য মাথাব্যথাও উপশম হয়না, সবচেয়ে কাছের শহরও এখান থেকে প্রায় ১০ ঘণ্টার পথ! তাই রোগ-শোক নিষ্পলক - নির্বেদ্য হয়ে বসে থাকে প্রতিটি ঘরের চালে; কারও আতœীয়-স্বজন বিদেশ-বিভুইয়ে না থাকায় ডাকঘরের প্রয়োজনীয়তা ঘোড়ারোগের মত ; তবে স্বল্প পরিসরে হলেও আছে কাঁচাবাজার, দর্জির দোকান। বিদ্যুতের আলো নেই, নেই রেডিও-টিভির কহতান; সূর্য হেলে পড়া মানেই এখানকার পৃথিবীর ছুটিতে যাওয়া, অতঃপর মানবীয় আদিমতার মহোৎসব আর কিছু নতুন মুখের পৃথিবী দর্শনের ব্যবস্থা করার সুনিপুণ আয়োজন! কে বুশ-কে লাদেন-কণ্ডোলিৎসা রাইসের স্কার্টের দৈর্ঘ্য কত কিংবা মল্লিকা শেরওয়াত কতটা সেক্সসিম্বল- এ জাতীয় ভাবনা এখানে অবান্তর; সভ্যতা কুবেরের নিজস্ব প্রজনন, কৃষ্টি দিন-রাত্রির অদ্ভুত তাগিদ; শুধু অস্থি-মজ্জার সচল কঙ্কাল হয়ে বেঁচে আছে মানুষগুলো। তাদের ভুত-ভবিষ্যত সবকিছুই দ্বীপের চৌহদ্দি পেরিয়ে অন্যকোন ভুবনে পেীছতে অপারগ। সেই মানসিক দৃঢ়তা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত।
পুলিশি হেফাজতে খুবই কষ্টে আছে হোসেন মিয়া। কেতুপুরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হোসেন মিয়া মাছের ব্যবসার অন্তরালে মাদক ব্যবসা করত; এক সংঘবদ্ধ চোরাচালান গ্র“পের সে ছিল নেী-রুটের অপারেশন কমাণ্ডার; এছাড়া জঙ্গি সংগঠন “সাফাতুল মুমিনিন” এর সঙ্গেও তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে; স¤প্রতি এ জঙ্গিগোষ্ঠী একযোগে দেশের ৬৩টি জেলায বোমা হামলা চালনোর সময় সে নোয়াখালি অঞ্চলের দায়িত্ব পায়; আর ময়না দ্বীপে আদম পাচারের মত গুরুতর অভিযোগতো আছেই।তাই র্যাবের শুদ্ধি অভিযানে ’হোসেন মিয়া’ নামটি বেশ গুরুত্বসহকারে স্থান পায়। কিন্তু চতুর হোসেন মিয়া বারবার অবস্থান বদল করে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে দেয়; ময়না দ্বীপেও সে কিছুদিন গাঁ ঢাকা দিয়ে ছিল। কিন্তু পুলিশ ছিল তার ছায়াসঙ্গী; সুতরাং এই ইদুর-বিড়াল খেলায় তারই পরাজয় ঘটে :সিলেটের কোন এক বাড়িতে অন্য তিন-চারজন সহচরসহ আতœগোপন করে থাকা অবস্থায় র্যাব-পুলিশের যৌথ বাহিনী তাদের ঘিরে ফেললে দীর্ঘ ৭ঘণ্টার অবরুদ্ধ প্রহর শেষে আতœসমর্পণে বাধ্য হয় হোসেন মিয়া। এরপর থেকে জেলের এই সেলঘরটি তার চিরস্থায়ী রোজকার আবাস; র্যাবীয় জিজ্ঞাসাবাদের ধকল এখনও তার শরীর কাটিয়ে উঠতে পারেনি; থেতলে গেছে হাত-পা’ য়ের বিভিন্ন অংশ, ২ দিন হল বাম-কানটাও অকেজো হয়ে পড়েছে--হোসেন মিয়া যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ! এই বয়সে এতটা আপ্যায়ন(!) তার সহ্য হয়নি- গতরাতে দলের সব নেতা-কর্মীর নাম-ঠিকানা ফাঁস করে দিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের সময়!
আজ সকাল থেকেই হোসেন মিয়ার কদর হঠাৎ বেড়ে গেছে; আলাদা সেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, শুকনো রুটির বদলে গরুর গোশত-রুই মাছ দিয়ে ভাত , গোসলের জন্য লাইফবয় গোল্ড সাবান, জায়নামায, তসবি- - তবে কি জেলে আজ জান্নাতুল ফেরদাউস নেমে এল!!রাত আটটায় মসজিদের ঈমাম এসে তওবাহ পাঠ করাল হোসেন মিয়াকে; ”এসবের মানে কি”-হোসেন মিয়ার ঘোর কাটছে না কিছুতেই! একটু পর তাকে গাড়িতে উঠানো হল ;গন্তব্য অজানা! শহর থেকে বেশ দূরে কোন এক নদীতীরে এসে গাড়ি থামল : “ শোন হোসেন, আমরা এখন তোমাকে ছেড়ে দেব। তুমি যত জোরে পার দেীড়াও, পেছন ফিরলেই কিন্তু গুলি”- র্যাবের অধিনায়কের এমন কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির আনন্দে দেীড় দিল হোসেন মিয়া, পেছনে তার একদল যমদুত! “সাঁই সাঁই.. .”- গুলির শব্দে কেপে উঠল নদীর পানি, হোসেন মিয়ার আর ফেরা হল না কেতুপুরে। পরদিন দেশের সবগুলো দৈনিকে একটি বিশেষ সংবাদ ছাপা হল-” র্যাবের সঙ্গে এনকাউণ্টারে শীর্ষ জঙ্গি হোসেন মিয়া নিহত”।
(চলবে)