[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশটিকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোণা করায় প্রদেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, “তার অপরাধ ক্ষমা করা হবে না।”
পাকিস্তানে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়েছে এবং সংবাদপত্রের ওপর পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সারা বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা থেকে একটি গুপ্ত রেডিওর বুলেটিন সম্প্রচার থেকে এবং সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে আসা লোকদের কাছ থেকে সেদিনের নাটকীয় ঘটনাবলির সংবাদ জানা গেছে।
ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে গুপ্ত রেডিওর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শেখ মুজিবের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আরও জানিয়েছে, ছয়টি শহরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে ঘিরে রেখেছে পূর্ব পাকিস্তানী সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী।
বিশ্বাসঘাতকদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে- প্রেসিডেন্ট
দিল্লি, মার্চ ২৬: পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের কাছে মনিটর করা গুপ্ত রেডিওর সম্প্রচার অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান গতরাতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ঢাকা থেকে প্রায় ৫৬ মাইল পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় গুপ্ত রেডিওর সম্প্রচার মনিটর করে এই সংবাদ প্রেস ট্রাষ্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) ছেপেছে। পিটিআই বলেছে শেখ মুজিব নিজে রেডিওতে এই ঘোষণা দেননি। ঘোষণা দিয়েছেন এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি।
সম্প্রচারে বলা হয়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এর পূর্ব পাকিস্তানী সৈনিক এবং পুলিশ বাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা সিলেট, যশোর, বরিশাল এবং খুলনা শহরে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। সম্প্রচারে আরও বলা হয় পাকিস্তানী সৈন্যরা শেখ মুজিবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই তিনি গোপন অবস্থানে চলে গেছেন বলে দাবি করা হয়েছে।
সম্প্রচার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে “শেষ শত্রু সৈন্য নির্মূল না করা পর্যন্ত” স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আহবান জানানো হয়েছে। সম্প্রচারে আরও বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের নির্দয় স্বৈরশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে “স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের” নির্দেশ মেনে চলতে হবে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আজ রাতে জাতির উদ্দেশ্যে সম্প্রচারিত এক ভাষণে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। গত ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তার দল পূর্ব পাকিস্তান থেকে অভাবনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। তিনি বলেন, শেখ মুজিব সরকারি কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে আঘাত করেছেন। তিনি বলেন, “তার এই অপরাধ ক্ষমা করা হবে না।” তিনি শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরও বলেন, সে এবং তার দল গত তিন সপ্তাহ ধরে আইনাসিদ্ধ কর্তৃপক্ষকে অগ্রাহ্য করেছে, পাকিস্তানের পতাকা অবমাননা করেছে এবং জাতির পিতার ফটোগ্রাফ সরিয়ে ফেলেছে। তারা একটা সমান্তরাল সরকার পরিচালনার চেষ্টা করেছে। তারা বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
তার কন্ঠে ক্রোধ ঝড়ে পড়ছিল। তিনি ঘোষণা করলেন, কোনো ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারকে পাকিস্তান ধ্বংস করতে এবং ১২০ মিলিয়ন মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। শেখ মুজিবের সাথে ঢাকায় সা¤প্রতিক আলোচনাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের ঘটনা থেকে শুধু একটা উপসংহারেই পৌঁছানো যায়: “শেখ মুজিব ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ ছিন্ন করতে চায়।” তিনি পাকিস্তানের অধিবাসীদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, তার লক্ষ্য আগের মতোই রয়েছে, সেটা হলো: “জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যখনই অবস্থার উন্নতি ঘটবে আমি এই লক্ষ্য পূরণের জন্য নতুন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
তিনি বলেন, পাকিস্তানে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকবে। প্রেসের ওপর পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হবে এবং ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে কার্ফিউ বলবৎ থাকবে। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গুপ্ত রেডিও’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে তীব্র লাড়ইয়ে ব্যাপক হতাহত হয়েছে। ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য কিছু অঞ্চলে ব্যাপক যুদ্ধ চলছে।
কলকাতা থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদ মতে, অন্তত ১০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরে অবতরণ করেছে। এনিয়ে প্রদেশটিতে সর্বমোট পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো ৭০,০০০। সংবাদ থেকে জানা যায়, সৈন্যরা কয়েকশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে এবং কৌশলগত অবস্থানগুলো দখল করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ওয়াশিংটনে জানিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকান দূতাবাসে আসা মর্কিনীরা জানিয়েছে যে সেনাবাহিনী এবং ট্যাংক ব্যবহার করা হচ্ছে।
গতকাল পাকিস্তানে অবস্থার অবনতি ঘটে যখন চট্টগ্রাম ও রংপুরে সৈনিকরা জনতার উপর বিক্ষপ্ত গুলিবর্ষণ করে ৩৫ জনকে হত্যা ও ১০০ জনকে আহত করে। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান আগামিকাল সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি সকল সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্টকে আহবান জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংকট দূর করতে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন বিলম্বিত আলোচনা চালাতে। কিন্তু “সেখানে তারা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।” পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা ভূট্টোও এই প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করেছে। তার বামপন্থী পিপলস পার্টি ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানেও গতকাল সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পাঞ্জাব প্রদেশের শিল্প শহর লালপুরে বামপন্থী আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে দিনব্যাপী সংঘর্ষের পর দশ ঘণ্টা সান্ধ্য আইন জারী করা হয়েছে। লাহোর থেকে চার মাইল দূরবর্তী এই টেক্সটাইল শহরে অন্তত ৩০ জন পুলিশ গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পিপলস পার্টির জঙ্গী সমর্থকগোষ্ঠী পিপলস গার্ড রাস্তায় মিছিল শুরু করলে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
-রয়টার্স, ইউপিআই ও এপি
দ্য টাইমস
২৭ মার্চ ১৯৭১
মুক্তযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
১. ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:২২ ০