নাস্তিকের সাথে আড্ডা
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশের নামকরা বাংলা ব্লগ সামহয়্যার ইন ব্লগে আমার প্রোফাইল ফেরিফাইড হয়। লিখালিখির সুযোগ পাই। ব্লগিং জীবনের শুরু থেকেই নাস্তিকদের সাথে একথা-সেকথায় লেগে যেত। তারা যুক্তি দিত ঈশ্বর নেই, আর আস্তিক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল স্রষ্টা আছে সেটা প্রমান করা। বাস্তবে যে দুই একজন নাস্তিকের মোকাবিলা করতে হয় নি তা নয়।
আজ থেকে দুই বছর পূর্বে এমনি এক নাস্তিকের সাথে পরিচয় হয়েছি। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে তার মত বিদ্যানের সাথে যুদ্ধ করা অসম্ভব ছিল। তবুও হাল ছাড়ে কে। নাম প্রকাশ করব না শুধু কি হয়েছিল সেদিন তা স্বরন করব।
তিনি শুরু করেছিলেন এভাবে দেখ মৃদুল, আমি মনে করি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ, আই মিন আল কোরয়ান, সেটা কোন ঐশী গ্রন্থ নয়। এটা মুহাম্মদের নিজের লেখা একটি বই।মুহাম্মদ করেছে কি, এটাকে জাষ্ট স্রষ্টার বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।
এইটুকু বলে তিনি আমার দিকে তাকালো। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমার রিএ্যাকশান কি হয়।
আমরা কিছু বলার আগেই লোকটি আবার বললো, - 'হয়তো বলবে, মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানতো না। সে কিভাবে এরকম একটি গ্রন্থ লিখবে? ওয়েল! এটি খুবই লেইম লজিক। মুহাম্মদ লিখতে পড়তে না জানলে কি হবে, তার ফলোয়ারদের অনেকে লিখতে-পড়তে পারতো।উচ্চ শিক্ষিত ছিলো। তারা করেছে কাজটা। মুহাম্মদের ইশারায়।'
আমি একটু বদ মেজাজি হঠাত করে ক্ষেপে যাই যখন কেউ যুক্তিহীন কথা বলে। কিন্তু তার কথায় যুক্তি ছিল। আমিও চুপ করে শুনছিলাম কিছু বলছিলাম না।
তিনি ভদ্রতা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে নিলেন কিছু মনে না করলে আমি একটি সিগারেট ধরাতে পারি?
আমি আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।
Thank You... বলে একটি বেনসন জ্বলিয়ে ফুকতে লাগল।
আমি আসতে করে বললাম, আপনি খুবই লজিক্যাল কথা বলেছেন। কোরয়ান মুহাম্মদ সাঃ এর নিজের বানানো হতেও পারে। কারন, কোরয়ান যে ফেরেস্তা নিয়ে আসতো বলে দাবি করা হয়, সেই জিব্রাঈল আঃ কে মুহাম্মদ সাঃ ছাড়া কেউই কোনদিন দেখেনি।
লোকটা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো- এক্সাক্টলি, মাই সান।
আমি তাকে বললাম তাহলে, কোরয়ানকে আমরা টেষ্ট করতে পারি, কি বলেন?
তিনি হ্যাসূচক জবাব দিতেইম আমি আমার ডায়েরির পাতা উল্টে সংগ্রহিত কিছু তথ্য বের করে প্রেজেন্ট করতে শুরু করলাম।
কোরয়ান মুহাম্মদ সাঃ এর বানানো কি না, তা বুঝতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মুহাম্মদ সাঃ স্রষ্টার কোন দূত নন।তিনি খুবই সাধারন, অশিক্ষিত একজন প্রাচীন মানুষ।'
তিনি বললেন সত্যিকার অর্থেই মুহাম্মদ অসাধারণ কোন লোক ছিলো না। স্রষ্টার দূত তো পুরোটাই ভূয়া।
মেজাজ চরম গরম হয়ে গেলেও চুপ থেকে বললাম তাহলে এটাই ধরে নিই?
হুম- লোকটার সম্মতি জানালো।
উনাকে ঈউসুফ আঃ এর ইতিহাস দেখালাম ইন্টারনেট থেকে- হজরত ঈউসুফ আঃ এর জন্ম হয়েছিলো বর্তমান ফিলিস্তিনে। ঈউসুফ আঃ ছিলেন হজরত ঈয়াকুব আঃ এর কনিষ্ঠতম পুত্র। ঈয়াকুব আঃ এর কাছে ঈউসুফ আঃ ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয়।কিন্তু, ঈয়াকুব আঃ এর এই ভালোবাসা ঈউসুফ আঃ এর জন্য কাল হলো। তার ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ঈউসুফ আঃ কে কূপে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর, কিছু বণিকদল কূপ থেকে ঈউসুফ আঃ কে উদ্ধার করে তাকে মিশরে নিয়ে আসে। তিনি মিশরের রাজ পরিবারে বড় হন।ইতিহাস মতে, এটি ঘটে- খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের আমেনহোটেপের রাজত্বকালের আরো তিন'শ বছর পূর্বে। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম এই বিষয়ে আপনার কোন দ্বিমত আছে কি না?
তিনি বললেন না কিন্তু, এগুলো দিয়ে তুমি কি বোঝাতে চাও?
উনাকে আরো দেখালাম, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপের আগে যেসকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছে, তাদের সবাইকেই রাজা বলে ডাকা হতো। কিন্তু, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপের পরে যেসকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছিলো, তাদের সবাইকে ফেরাঊন বলে ডাকা হতো।
ঈউসুফ আঃ মিশরকে শাসন করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের চতুর্থ আমেনহোটেপের আগে।আর, মূসা আঃ মিশরে জন্মলাভ করেছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপের কমপক্ষে আরো দু'শো বছর পরে।অর্থাৎ, মূসা আঃ যখন মিশরে জন্মগ্রহন করেন, তখন মিশরের শাসকদের আর 'রাজা' বলা হতো না, ফেরাঊন' বলা হতো।
- হুম, তো?
আমি বললাম কিন্তু, কোরানে ঈউসুফ আঃ এবং মূসা আঃ দুইজনের কথাই আছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, কোরয়ান ঈউসুফ আঃ এর বেলায় শাসকদের ক্ষেত্রে রাজা শব্দ ব্যবহার করলেও, একই দেশের, মূসা আঃ এর সময়কার শাসকদের বেলায় ব্যবহার করেছে ফিরাঊন শব্দটি। তাকে জিজ্ঞেস করলাম , মরুভূমির বালুতে উট চরানো বালক মুহাম্মদ সাঃ ইতিহাসের এই পাঠ কোথায় পেলেন? তিনি কিভাবে জানতেন যে, ঈউসুফ আঃ এর সময়ের শাসকদের 'রাজা' বলা হতো, মূসা আঃ সময়কার শাসকদের 'ফেরাঊন? এবং, ঠিক সেই মতো শব্দ ব্যবহার করে তাদের পরিচয় দেওয়া হলো?
জবাবে তিনি হো হো হো করে হেসে বললো- মূসা আর ঈউসুফের কাহিনী তো বাইবেলেও ছিলো। মুহাম্মদ সেখান থেকে কপি করেছে, সিম্পল।
আমি তাকে আর একটা তথ্য দেউয়ার সুযোগ পেলাম, বললাম, বাইবেল এই জায়গায় চরম একটি ভুল করেছে। বাইবেল ঈউসুফ আঃ এবং মূসা আঃ দুজনের সময়কার শাসকদের জন্যই 'ফেরাঊন' শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ঐতিহাসিক ভুল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেণ্ট থেকে প্রমান দেখাতে পারি।
লোকটা কিছুই বললো না। চুপ করে ছিল। সম্ভবত, উনার প্রমান দরকার ছিল না।
হেসে হেসেই বললাম ভুল বাইবেল করেছে, সে ভুল অশিক্ষিত আরবের বালক মুহাম্মদ সাঃ এসে ঠিক করে দিলো, তা কিভাবে সম্ভব, যদি না তিনি কোন প্রেরিত দূত না হোন, আর, কোরয়ান কোন ঐশি গ্রন্থ না হয়?
লোকটি চুপ করে আছে। এরমধ্যেই তিনটি সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে। নতুন আরেকটি ধরাতে ধরাতে বললো- হুম, কিছুটা যৌক্তিক। মনে হল খুবি দোটানায় পরে আছে।
উনাকে আরেকটা ব্যাপার জানালাম ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টিয়ে।
কোরানে একটি সূরা আছে, সূরা আল ফাজর নামে। এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতটি এরকম-তোমরা কি লক্ষ্য করো নি, তোমাদের পালনকর্তা ইরাম গোত্রের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? এই সূরা ফাজরে মূলত আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আদ জাতির আলাপের মধ্যে হঠাৎ করে 'ইরাম' নামে একটি শব্দ চলে এলো, যা কেউই জানতো না এটা আসলে কি। কেউ কেউ বললো, এটা আদ জাতির কোন বীর পালোয়ানের নাম, কেউ কেউ বললো, এই ইরাম হতে পারে আদ জাতির শারীরিক কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য, কারন, এই সূরায় আদ জাতির শক্তিমত্তা নিয়েও আয়াত আছে। আসলে এই 'ইরাম' আসলে কি, সেটার সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারেনি তখন। এমনকি, গোটা পৃথিবীর কোন ইতিহাসে 'ইরাম' নিয়ে কিছুই বলা ছিলো না।
কিন্তু, ১৯৭৩ সালে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সিরিয়ায় মাটির নিচে একটি শহরের সন্ধান পায়।এই শহরটি ছিলো আদ জাতিদের শহর। সেই শহরে পাওয়া যায়, সুপ্রাচীন উঁচু উঁচু দালান। এমনকি, এই শহরে আবিষ্কার হয় তখনকার একটি লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় তারা যেসকল শহরের সাথে বাণিজ্য করতো, সেসব শহরের নাম উল্লেখ ছিলো।আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই- সেই তালিকায় 'ইরাম' নামের একটি শহরের নামও পাওয়া যায়, যেটা আদ জাতিদেরই একটি শহর ছিলো। শহরটি ছিলো একটি পাহাড়ের মধ্যে। এতেও ছিলো সুউচ্চ দালান।
চিন্তা করুন, যে 'ইরাম' শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা এর পূর্বে তাফসিরকারকরাও করতে পারেনি। কেউ এটাকে বীরের নাম, কেউ এটাকে আদ জাতির শারিরীক বৈশিষ্ট্যের নাম বলে ব্যাখ্যা করেছে,
১৯৭৩ সালের আগে যে 'ইরাম' শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিলো না, কোন ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদই এই শহর সম্পর্কে কিছুই জানতো না, প্রায় ৪৩ শত বছর আগের আদ জাতিদের সেই শহরের নাম কিভাবে কোরয়ান উল্লেখ করলো? যেটা আমরা জেনেছি ১৯৭৩ সালে, সেটা মুহাম্মদ সাঃ কিভাবে আরবের মরুভূমিতে বসে ১৪০০ বছর আগে জানলো?
তিনি তো অশিক্ষিত ছিলেন।কোনদিন ইতিহাস বা ভূগোল পড়েন নি। কিভাবে জানলেন?
আমি খেয়াল করলাম, লোকটার চেহারা থেকে আত্মবিশ্বাসি ভাবটা সরে যেতে শুরু করেছে। হাটুর বয়সি ছেলের কাছ থেকে তিনি এতোটা শক খাবেন, হয়তো আশা করেন নি।
আমার আরেকটা প্রিয় আয়াতের উদাহরন দিলাম।
কুরয়ানে আর রহমান নামে একটি সূরা আছে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা আছে-
'হে জ্বীন ও মানুষ! তোমরা যদি আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে পারো, তবে করো। যদিও তোমরা তা পারবেনা প্রবল শক্তি ছাড়া'
মজার ব্যাপার হলো, এই আয়াতটি মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে। ভাবা যায়, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরবের লোক, যাদের কাছে যানবাহন বলতে কেবল ছিলো উট আর গাধা, ঠিক সেই সময়ে বসে মুহাম্মদ সাঃ মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে কথা বলছে।
সে যাহোক, আয়াতটিতে বলা হলো- 'যদি পারো আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে, তবে করো'
এটি একটি কন্ডিশনাল বাক্য। এই বাক্যে শর্ত দেওয়ার জন্য If (যদি) ব্যবহার করা হয়েছে।
তাকে দেখালাম আরবিতে 'যদি' শব্দের জন্য দুটি শব্দ আছে। একটি হলো 'লাও', অন্যটি হলো 'ইন'।
দুটোর অর্থই 'যদি।' কিন্তু, এই দুটোর মধ্যে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। পার্থক্যটি হলো- আরবিতে শর্তবাচক বাক্যে 'লাও' তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন সেই শর্ত কোনভাবেই পূরণ সম্ভব হবে না। কিন্তু, শর্তবাচক বাক্যে 'যদি' শব্দের জন্য যখন 'ইন' ব্যবহার করা হয়, তখন নিশ্চয় এই শর্তটা পূরণ সম্ভব।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার, কোরানে সূরা আর রহমানের ৩৩ নম্বর আয়াতটিতে 'লাও' ব্যবহার না করে 'ইন' ব্যবহার করা হয়েছে। মানে, কোন একদিন জ্বীন এবং মানুষেরা মহাকাশ ভ্রমণে সফল হবেই।আজকে কি মানুষ মহাকাশ জয় করেনি? মানুষ চাঁদে যায়নি? মঙ্গলে যাচ্ছে না?
১৪০০ বছর আগে যখন মানুষের ধারনা ছিলো একটি ষাঁড় তার দুই শিংয়ের মধ্যে পৃথিবীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তখন কোরয়ান ঘোষণা করছে, মহাকাশ ভ্রমণের কথা। সাথে বলেও দিচ্ছে, একদিন তা আমরা পারবো। আরবের নিরক্ষর মুহাম্মদ সাঃ কিভাবে এই কথা বলতে পারে?'
ভদ্রলোকের চেহারা থেকে আমি নাস্তিক আমি একেবারে নির্ভুল টাইপ ভাবটা একেবারে উধাও হয়ে গেলো। এখন তাকে যুদ্ধাহত এক ক্লান্ত সৈনিকের মতোন দেখাচ্ছে।
উনি হাল ছাড়তে রাজি নয় কিন্তু ঝুইতেও হয়ত আর কিছু নেই তাই সব ভুলে বাচ্চাদের মত এক কথা বলেছিলেন যে মুহাম্মাদ নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এমন করেছিল।
এটার জবাব দেউয়ার জন্য আর ইন্টারনেট বা উচ্চ জ্ঞানের দরকার ছিল না নিজেই তাকে বললাম-
যদি বলেন, মুহাম্মদ সাঃ নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই কিতাব লিখেছে, আপনাকে বলতে হয়, এই কিতাবের জন্যই মুহাম্মদ সাঃ কে বরণ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা। এই কিতাবের বাণী প্রচার করতে গিয়েই তিনি স্বদেশ ছাড়া হয়েছিলেন।তাকে বলা হয়েছিলো, তিনি যা প্রচার করছেন তা থেকে বিরত হলে তাকে মক্কার রাজত্ব দেওয়া হবে। তিনি তা গ্রহন করেন নি।
শেষে বললাম নিজের ভালো তো পাগলও বুঝে। মুহাম্মদ সাঃ বুঝলো না কেনো?
উনি আর কিছু বললেন না বললেন কাজ আছে এই ব্যাপার নিয়ে পরে আরেক দিন আলাপ করা যাবে। বলে উঠে গেলেন। আমি শুধু পেছন থেকে তাকে জিজ্ঞেস করলান আংকেল আলোচনা কি অসমাপ্ত হয়ে গেল?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৭