ছোট্ট পাসপোর্ট সাইজ ছবিতে যে ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে... মেয়েটি মারা গেছে। মেয়েটি মারা গেছে আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে। পানিতে ডুবে।
২০০২ সালে ১৭ জুলাই বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফেরার সময় মাত্র'ই চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া এই মেয়েটি তিনজন বখাটের ধাওয়া খেয়ে ভয়ে পালাতে গিয়ে পুকুরে পরে ঢুবে মারা যায়... ঈশ্বর তার ভাগ্যে পানিতে ঢুবে মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন, যেটা তিনজন পিশাচের হাতে ধর্ষিত হয়ে মরার চেয়ে নিঃসন্দেহে ভাল ছিলো।
এই তিনজনের'ই মৃত্যুদন্ড হয়েছিলো.... পরে আমাদের দেশের আদালত সেই মৃত্যুদন্ড খারিজ করে মাত্র ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় আসামীদের।
২০০১ সালে ঢাকার খিলগাঁওয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে সিমি.... বখাটেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা। দরিদ্র ঘরের মেয়ে সিমি বিয়ে বাড়িতে আলপনা এঁকে পড়াশোনার খরচ চালাতো... মাঝেমাঝে কাজ শেষ করে ফিরতে রাত হয়ে যেতো। আর প্রতিদিন ঘরে ফেরার পথেই চলতো অসহনীয় যন্ত্রণা।
মারা যাবার আগে সিমি চিরকুটে লিখে রেখেছিলো ছয় বখাটের নাম... তার মধ্যে একজন খিলগাঁও থানার দারোগা বাশার... সিমির বাবা এদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় পাঁচ জনের মাত্র একবছর করে সাজা হয়... একজনকে বেকসুর খালাসও দেওয়া হয়।
সিমির বাবা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন... সেই আপিলের শুনানি হয় ঠিক দশ বছর পর। এই দীর্ঘ দশ বছরে সিমির পরিবারকে ৬০ টি জি.ডি করতে হয়েছে... আসামীরা তাঁদের হুমকী দেয়, মামলা ডিসমিস না করলে বাড়িতে আগুন দেয়া হবে। পুলিশের কাছে এই খবর জানানো হলে পুলিশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রহসনমূলক জবাবে বলেছিলো, "আপনারা আগে আগুন নেভান... এরপর ট্রাকভর্তি পুলিশ আসবে।"
২০০৩ সালের পহেলা বৈশাখে বখাটেদের সীমাহীন লাঞ্চনা আর অপমান সহ্য করতে না পেরে সিলিং ফ্যানে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করে ফারজানা আফরিন রুমি।
২০০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বখাটেদের হাতে ধর্ষিত হবার পর পুরো সমাজ মুখ ফিরিয়ে নেয় মহিমার উপর থেকে... তাকে ঘোষণা করা হয় ভ্রষ্টা হিসেবে। এক ঘরে করা হয় মহিমাকে... মহিমা আর দেরী করে নি। আত্মহত্যা করে বিদায় দিয়েছিলো এই পৃথিবীকে।
২০০২ সালের ১৯ মার্চ স্কুলে যাবার সময় একদল বখাটে কিশোরী সেলিনা আক্তারকে তুলে নিয়ে গিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে.... সেলিনাও করেছিলো আত্মহত্যা।
পূর্ণিমা শীলকে নিয়ে আমি সম্পূর্ণ একটা লেখা লিখেছি আগে.... সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমাকে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ের পর হিন্দু হওয়ায় এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অপরাধে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা গণ ধর্ষণ করে। নবম শ্রেণীতে পড়া পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করতে এসেছিলো ১০-১২ জনের একটি দল... এতোটুকুন মেয়েটা এতোজনের অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না দেখে পূর্ণিমার মা কান্না করতে করতে বলেছিলেন, "বাবা'রা আমার মেয়েটা ছোট... মরে যাবে। তোমরা একজন একজন করে আসো।"
আওয়ামী লীগ সরকার এরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় এলো... বিচার হয় নি পূর্ণিমার ধর্ষণকারীদের... হবেও না।
পুলিশ ভ্যানে পুলিশের হাতে ধর্ষিত হওয়া ইয়াসমিনের কথা আমাদের অজানা নয়... ইয়াসমিন হত্যার বিচার চাইতে আসা মানুষের উপর গুলি চালিয়েছিলো বাংলাদেশ পুলিশ.... দলছুট ব্যান্ডের গাওয়া "আহ ইয়াসমিন...!" গানটা শুনেছে কি কেউ...??
আমরা যাদের পেপার পত্রিকা পড়া হতো, তাঁদের পেপারের কোণায় অবশ্য'ই একটি খবর কোন না কোন সময় চোখে পড়ার কথা... 'শাজনীন মামলা'। ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাজনীন।
১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল বাড়ির ঠিকাদার ও তার তিন বন্ধু মিলে শাজনীনকে ধর্ষণ করে হত্যা করে... শাজনীনকে মোট ২০ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিলো... ঘাড়ে বাটালী দিয়ে আঘাত করে করে ফেলা হয়েছিলো ৩ ইঞ্চি গর্ত। স্কলাসটিকা স্কুলের নবম শ্রেণীর মেয়ে ছিলো শাজনীন... বয়স মাত্র ১৫ বছর। আসামীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ হলেও কার্যকর হয় নি আজও।
যারা প্রথম আলো রাখেন, তারা দেখবেন... এখনো প্রতিবছর শাজনীনের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া চেয়ে মিলাদের সময়সূচি জানানো হয়.... কতোটা দুঃখ, কতোটা অসহায়তা মিশ্রিত কষ্ট থাকে সেই বিজ্ঞপ্তিতে... যারা পড়েন, তারা হয়তো বুঝেন।
এই সময়গুলোতে ফেসবুক ছিলো না... সহজলভ্য ছিলো না ডিশ টিভি কানেকশন। আজকে যার ঘরে টিভি নেই বা পত্রিকা যায় না... তার ঘরেও আছে মোবাইল ইন্টারনেট। এখন খবর আটকে থাকে না.. বিচার আগেও হয় নি... এখনও হবে না। বিচার কেড়ে নিতে হবে।
তনু'র হত্যার বিচার যদি না হয়, তৃষা, সিমি, রুমি, সেলিনা, মহিমা, শাজনীনরা ২০ কোটি বাঙালীকে অভিশাপ দিবে.... যে অভিশাপ শোনা যায় না... কিন্তু অভিশাপের পরিণাম বাঙালীকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে আরো সহস্র তনু'কে ধর্ষিত হয়ে... খুন হয়ে।