আমার লেখার বিষয় একজন নারী, মৃত্যুর পরও যিনি "কেবলমাত্র" "একজনের মা"-ই থেকে যান.....]
...........................
ইদানীং আমার জগতের সকল প্রকার "অ্যামবিগিউয়াস" (শব্দটা ইংরেজি। অনেকে পছন্দ করেন না লেখার মধ্যে ইংরেজি শব্দ আসবে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই শব্দটা আমার খুব পছন্দ) বিষয়ের প্রতি আমার অভক্তি ধরে গেছে। প্রখর সূর্যের মত স্পষ্ট না হলে আমার সেই জিনিস আর দেখতে ইচ্ছা করে না। জঘন্য লাগে। (আহা আজকে যে আমার কি হয়েছে, কোন কথা রেখে ঢেকে ভদ্র করে বলতে পারছি না, শব্দ চয়ন বড়ই অসাবধানী হয়ে পড়ছে।)
তা যা বলছিলাম অস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থবোধক জিনিসগুলো ভালো লাগে না, মানে দেখতে ইচ্ছা করে না। এরকম একটা 'জিনিস' হইলেন মহামতি 'পেরেম' (প্রেম ভক্তরা মারতে আইসেন না। আমি 'প্রচলিত প্রেম' অর্থাৎ কিনা পেরেমের কথা বলতেছি।বিভিন্ন প্রকারের 'সত্যিকারের প্রেমের প্রতি আমার কোন রাগ নাই'।) কি রকমের পেরেমের উপর তাহলে রাগ?
এই ধরেন অস্পষ্ট অস্বচ্ছ এবং দ্ব্যর্থবোধক প্রেম। এর মধ্যে একটি অতীব প্রচলিত ধারা হল "যে প্রেম/ভালবাসার জন্য লাইফ স্যাক্রিফাইস করে দিতে হয় অথবা ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে দিতে হয়"। এবার মনে হয় শাজাহান সাজুর মায়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে চলেই এসেছি....
গতরাতেরই কথা, আমি অত্যন্ত তিক্ত মুডে বসে আছি। রাত হয়ে গেছে, সবাই শুয়ে টুয়ে পড়েছে বা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় মসজিদ থেকে মাইকিং শুরু হল, "একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ.... ডট ডট ডট এলাকা নিবাসী জনাব শাজাহান সাজুর মা মারা গেছেন। একটি শোক সংবাদ...." সংবাদ শুনেই আমার মামা অত্যন্ত কষ্ট পেলেন, কারণ 'এরকম' একটা সংবাদ এত রাতে ঘুমাতে যাবার আগেই শুনলেন বিষয়টা তার ভালো লাগল না। মৃত্যু জিনিসটা জীবিত মানুষেরা যতদূর সম্ভব ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। যাহোক, শুনেই মনে মনে ইন্নানিল্লাহ পড়লাম। জীবিত মানুষ হয়ে এর চেয়ে বেশি আর কি-ই বা তার জন্য করতে পারি!
শোক সংবাদ আরো কয়েকবার রিপিট হল। এই রিপিটেশানের সময় হঠাৎ করে একটা জিনিস খট করে কানে লাগল... অনভ্যস্ততার কারণে শোক সংবাদগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা হয় না এইবার শুনলাম..... বার বার বলছে, বলেই চলেছে "শাজাহান সাজুর মা, শাজাহান সাজুর মা..." ভদ্র মহিলার নাম একবারও উচ্চারণ করল না।
এক সময় মাইক নিঃশব্দ হয়ে গেল।
আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম।
কিছুদিন আগেও আমার এক ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে বলা চলে তর্কই হয়ে গেল অন লাইনে, অতি চালু বিষয়ক তর্ক, ছেলে মেয়ে বিষয়ক তর্ক। এই বিষয়ে কিছু বলা এবং লেখা খুব বিরক্তিকর, waste of time.....এসব প্রসঙ্গে কথা বললেই মানুষ বলে ওঠে 'ফেমিনিস্ট', কেউ কেউ বাংলা শব্দ ব্যবহার করে- "নারীবাদী"। তবু লিখছি।
আমার বেশি কিছু বলার নাই। খালি শাজাহান সাজুর মায়ের কথা মনে হচ্ছে...
শাজাহান সাজুর মা মারা গেছেন। আল্লাহ তাকে বেহেশতে নসীব করুন। কিন্তু আমার বার বার মনে হচ্ছে এই জীবনে তিনি 'শাজাহান সাজুর মা' ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারেননি। হয়ে উঠতে পারেননি কি হওয়ার চেষ্টাই কখনো করেননি নাকি চেষ্টা করেও পারেননি নাকি কেউ হতে দেয়নি- এটা আমার জানা নেই। উনি বেঁচে থাকলে হয়ত জিজ্ঞেস করা যেত (অবশ্য উনি বেঁচে থাকা অবস্থায় উনার অস্তিত্ব যে 'আছে' এটাই জানা ছিল না, জিজ্ঞেস করা হত কিনা কে জানে)। উনি কোন এক সময় শাজাহান সাজুর "নানার মেয়ে'' হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তারপর উনি শাজাহান সাজুর বাবাকে বিয়ে করেন, দুঃখিত আমার ধারণা তার সাথে "শাজাহান সাজুর বাবা"র "বিয়ে দেয়া হয় ", এবং তারপর এক সময় তিনি "শাজাহান সাজুর মা" হয়ে যান এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শাজাহান সাজুর মা-ই ছিলেন। আমরা অবশ্য তখন তাকে চিনতাম না, তার অস্তিত্বের কথাও জানতাম না, উনার মৃত্যুর পর জেনেছি।
অনেককাল আগে কোন একটা ইংরেজি দৈনিকে একটা কৌতুক দিয়েছিল, এক মোটাসোটা মহিলা চাইনিজ ফ্যান হাতে স্টেজে উঠছেন আর উপস্থাপিকা ঘোষণা দিচ্ছে, all through her life she's been a very successful woman. First, she's been the daughter of a successful businessman, then the wife of a successful businessman and after that the mother of a successful businessman. অর্থাৎ কিনা একজন শাজাহান সাজুর মা।
আমি ফেমিনিস্ট কিনা আমি জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি কখনো। তবে একটা জিনিস খুব খেয়াল করার চেষ্টা করি, আমাদের আশপাশের মেয়েদের মানসিকতা। মা থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব পর্যন্ত সবাই...। কেন যেন স্যাটিসফাইড হতে পারি না। অনেকে চট করে ছেলেদের দোষ দেন (যাদেরকে সাধারণত 'নারীবাদী' বলা হয়ে থাকে) তারা বলেন ছেলেরা মেয়েদের দাসী টাইপ বানিয়ে রাখতে চায়, বানিয়ে রাখে, এতে তাদেরকে rule করা সুবিধা। ছেলেরা মেয়েদের প্রতিমা বানিয়ে রাখতে চায়, যাতে পুজা করা এবং পুজা শেষে প্রতিমা বিসর্জন দু'টোই সহজ হয়ে যায়। সত্যি কথা স্বীকার করতে গেলে বলতে হয় আমি নিজেও জিনিসটা এভাবেই দেখে এসেছি এতদিন। এখন ইদানীং এসে মনে হচ্ছে, না ঐ যুক্তিটা সর্বাংশে সত্য না, আংশিক সত্য। ছেলেরা বানিয়ে রাখতে চায়, আর মেয়েরা তেমনই থেকে যায়, ব্যাপারটা এতটা সহজ না। মেয়েরা এতোটা সোজা চিজ না। তাদের পক্ষ থেকেও একটা নিরব সমর্থন আছে। ছিল। এবং হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে। মাগনা মাগনা পুজো পেতে কার না ভালো লাগে! তাছাড়া বিনা কষ্টে দিন পার হয়ে যায় যখন যাক না!
একটা কথা বলতে বসেছিলাম শুরুর দিকে, অ্যামবিগিউয়াস প্রেম বিষয়ক। আমি একটা জিনিস অহরহ আমার মা খালাদের মুখ থেকে শুনি,"ভালবাসার জন্য/সংসারের জন্য/ফ্যামিলির সম্মান রক্ষা করার জন্য/সন্তানদের জন্য নিজের লাইফ/ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে দিসি"। এই স্টেমেন্টটা প্রায়ই ছেলে মেয়েরা খারাপ রেজাল্ট করলে কিংবা অমুক আপার ছেলেটার মত মেডিক্যালে চান্স না পেলে বা ইনটলারেবল লেভেলের বেয়াদবি করলে ব্যবহার হয়। আর ব্যবহার হয় সংসারে অশান্তি সত্বেও স্বামী অহরহ অপমান করা সত্বেও মুখ বুঁজে পড়ে থাকলে যখন বলি, "শিক্ষিত একটা মেয়ে হয়ে কেন পড়ে আছেন? যান না আলাদা বাসা নেন, চাকরি করেন। নিজে চলেন।" আরো একটা বিষয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে, সেটা হল স্যাক্রিফাইস শব্দের ব্যবহার নিয়ে। যে মা এস.এস.সি.টাও পাশ করেননি, "ফ্যামিলির মুখ চেয়ে" বিয়ে করেছেন, "লোকে কি বলবে" এই ভেবে স্বামীর কথায় কখনো দ্বিমত করেননি, অপমান সহ্য করে সংসার করেছেন "সন্তানদের মুখ চেয়ে", সেই মহিলা যখন বলেন "স্যাক্রিফাইস করেছি" তখন আমার স্যাক্রিফাইস শব্দটাকে ড্রেনে ফেলে দিতে ইচ্ছা হয়। যে মানুষটার কোন চয়েস ছিল না বলেই চুপচাপ যন্ত্রণা সয়ে গেছে, সে মানুষটার স্যাক্রিফাইস শব্দটা ব্যবহার না করাই ভালো। স্যাক্রিফাইস বড় মহৎ জিনিস। সম্রাট বাবর তাঁর ছেলের জন্য "স্যাক্রিফাইস" করেছিলেন। কিন্তু একজন শৃঙ্খলিত মহিলা (সে মানসিক শৃঙ্খলই হোক বা সামাজিক) বাধ্য হয়ে মুখ বুঁজে অত্যাচার সয়ে যদি বলেন "আমি স্যাক্রিফাইস করেছি", তাহলে সেটা খুব বাজে শোনায়। নিরুপায় হয়ে কোনকিছু করা আর স্যাক্রিফাইস করার মধ্যে অনেক তফাত। কেন যেন এই স্যাক্রিফাইস বিষয়ক দার্শনিক থিওরীটা আমি উপযুক্ত মানুষগুলোর মুখের উপর বলতে পারি না, করুণা হয়। যে মহিলা ঐরকম "সাকসেসফুল" হতে চায় মন থেকেই, তার উপরে আমার কোন রাগ নেই। আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড "আমার জীবনের লক্ষ্য" রচনায় লিখেছিল, সে আদর্শ গৃহিণী হতে চায়। এটা নিয়ে অবশ্যই হাসার কিছু নাই। সে ওটা চয়েজ করেছে। কিন্তু কেউ যখন চায় আদর্শ গৃহিণী হব, অথচ হাসব্যান্ড মাস শেষে বেতনের টাকা চাইবে দেখে চাকরি করে, অথবা যার ওই শিক্ষাগত যোগ্যতাই নেই যে হাসব্যান্ডের আশ্রয় হারালে পথে পড়ে যাবে কিংবা যার কোন সমস্যাই নেই, একমাত্র সমস্যা এই যে সে মানসিকভাবে দাসী হয়ে পড়েছে - তার কখনো বলা উচিৎ না আমি স্যাক্রিফাইস করেছি। এদের জন্য করুণা হয়, কিন্তু তা-ই বলে এদের এত মহৎ আত্মত্যাগকে সম্মান করাটা আসলে সম্ভব না।
আমি জানি না ব্যক্তি শাজাহান সাজুর মা কেমন ছিলেন, তিনি কি আমার ঐ স্কুলমেটের মত "আদর্শ গৃহিণী" বা শাজাহান সাজুর "জননী" হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটা জিনিস জানি, জানি যে মেয়েরা অনেক সময়ই সেটাই করে যা করতে তার মন সায় দেয় না। কখনো কি এইসব মেয়েদের ইচ্ছে হয় না নিজে কিছু হতে?
হয়। কিন্তু কেমন যেন একটা স্বভাব মেয়েদের মধ্যে যাকে ভালবাসে তাকে লতার মত জড়িয়ে ধরে, নিজে কোমর শক্ত করে দাঁড়ায় না; কিংবা দাঁড়াতে চায় না। এটা কেন হয়েছে আমার জানা নেই। পৃথিবীর ইস্ট-ওয়েস্ট-নর্থ-সাউথ সব জায়গার মেয়েরাই বোধহয় এরকম অ্যাম্বিগিউয়াস ওয়েতে ভালবাসে। এমন না যে সে কখনোই চায় না আমি "কেবল আমি"ই হব, অন্যের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করাব না। কিন্তু কি মায়ায় তারা কখনো বাবা, কখনো ভাই, কখনো স্বামী, কখনো সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চায় এটা আমার জানা নেই।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই শাজাহান সাজুর মা হওয়া থেকে মেয়েদের বেরিয়ে আসা উচিৎ। সারা দুনিয়ার সব মেয়েদের। ভেবে দেখা উচিৎ সেই স্যাক্রিফাইস আসলেই স্যাক্রিফাইস কিনা যার কথা বার বার নিজের মুখে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়।
আমি আমার বান্ধবীকে দেখি, খাটো হবার কারণে তার দুঃখ, কারণ তার বয়ফ্রেন্ড তাকে বলেছে,"আমাদের ফ্যামিলি লম্বা পছন্দ করে।" সে গিয়ে কিরকমজানি একটা জুতা কিনে নিয়ে আসতে চায়, যেটা পায় দিয়ে ব্যায়াম করলে মানুষ লম্বা হয়। এতদিন কি ও খাটো ছিল না? কিন্তু কেন এখনই এসে ওর এই জুতা কেনার কথা মনে হল? কেন ও বলতে পারল না, তোমার ফ্যামিলি নাহয় পছন্দ করে না, তুমি তো কর, নাহলে আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড হলাম কি করে? কেন বার বার মায়েরা সন্তানদের বলে,"তোর জন্য লাইফ স্যাক্রিফাইস করে দিয়েছি, আর তুই এখন এইটা করলি!" কিংবা বলে,"তোমার তো কোন সিক্রেট থাকতে পারে না। তুমি আমার অংশ। আমার কাছে তোমার কোন সিক্রেট থাকা সম্ভব না। তুমি কোন ইনডিভিজুয়াল ব্যক্তি না।" কিংবা ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করে আনলে মা অযৌক্তিক ক্ষোভে ফুলতে থাকে।
হয়তবা নিজেকে অন্যের মাঝে বিলীন করে দিয়েই তারা ভাবে "ও-ও আমাতেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে"। কেন এটা মেয়েরা ভাবে আমি জানি না। এইরকম সিক এবং সংকীর্ণ ভালবাসা পৃথিবীর কোন প্রয়োজন আছে কিনা আমি জানি না। যে ভালবাসা আমাকে আমি হতে দেয় না, ধরে রাখে, সেই ভালবাসা আমার কতটুকু দরকার?
এদেরকে সবাই মৃত্যুর পরে প্রেইজ করে, "রত্নগর্ভা" ছিলেন, শোক সংবাদ হয় তিনি গুণগ্রাহী হেনো তেনো রেখে গেছেন, ছেলে মেয়ে রেখে গেছেন, কিন্তু তিনি কে ছিলেন, কি করেছিলেন, তাঁর কীর্তি কি এটা কেউ বলে না। বলার দরকার হয় না। কারণ কীর্তিবানদের জন্ম দেয়া ছাড়া তিনি নিজে কিছুই করেননি।
..........................................
আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমিও হয়ত শাজাহান সাজুর মা হয়ে যাব একদিন।
আমি জানি না।
শাজাহান সাজুর মা হওয়া অবশ্যই খুব ভালো কথা কিন্তু মহিলার নামটা জানতে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল।
এখনো হচ্ছে।
হয়তবা তারও একটা নাম ছিল.........
কিংবা হয়ত হতে পারত.........