কালাপাহাড়ের নাম পূর্ব্বভারত ও বাংলাদেশের অনেকেই জানেন ৷ ইনি এক দুর্ধশ মুসলমান সেনা ৷ ধর্মে প্রচন্ড গোঁড়া ছিলেন তিনি ৷ বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংশ করেছেন জীবনে ৷ বলতে গেলে হিন্দু মন্দির ধ্বংশ, হিন্দু মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষনই ছিল তার জীবনের ব্রত৷ ভারতীয় কলা ও স্থাপত্যের যে ক্ষতি তিনি করেছেন তার পূরণ হওয়া অসাধ্য৷ কিন্তু তিনি নিজে পূর্ব্বজীবনে হিন্দু ছিলেন সে খবর হয়ত অনেকেরই অজানা৷ কেন তার মনে হিন্দু বিদ্বেশ এলো এবং কেনই বা তিনি ধ্বংশের লীলা শুরু করলেন সেই নিয়েই এই প্রবন্ধ।
মধ্যযুগে ভারতের অনেকাংশেই মুসলমান শাসন ছিল৷ কেউ বা সম্রাট কেউ দেশীয় রাজা বাদশা আবার কেউ স্থানীয় জমিদার ৷ তেমনই একজন হলেন বাংলা ও বিহারের শাসনকর্তা সুলেমান কারনানী (কেউ আবার বলেন কারারানী) ৷ ইনি বাঙালী নন, নামটা সিন্ধী হলেও জাতিতে ইনি ছিলেন আফগান ৷ বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রচারে উৎসাহী ছিলেন ইনি ৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই বিশেষ করে কোনো যোগ্য লোক দেখলেই তাকে ধর্মান্তরিত করতেন ৷ সোজা আর বাঁকা দুই ধরনের রাস্তাই তার জানা ছিল ৷ অনেক যোগ্য মানুষ তার কাছে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজের পরিচয় পেয়েছে সমাজের কাছে, পেয়েছে প্রতিভার বিকাশ৷ আবার অন্য দিকে, অনেক মানুষকে ভয় দেখিয়ে জোর করে অথবা কৌশলে তাদের বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলমান বানিয়ে তাদেরই দিয়ে তাদের স্বজাতির বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অমানবিক ষড়যন্ত্র করিয়েছেন কারনানী৷ তবে আমার এই প্রবন্ধের নায়ক অথবা খলনায়ক কিন্তু ইনি নন ৷ বরং তারই এক সেনাপতিকে নিয়েই এই উপাখ্যান৷
রাজীব লোচন রায় উত্তরবঙ্গের এক বাঙালী বাহ্মণ পরিবারের সন্তান ৷ তিনি বিদ্যান ও বুদ্ধিমানও বটে ৷ তার কর্মজীবন শুরু কিভাবে হয়েছিল সেকথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না৷ পরে গৌড়ের সেনানীতে যোগ দেন ইনি৷ সৈন্য পরিচালনা ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীতা দেখান খুব শীঘ্রই৷ শাসক সুলেমান কারনানীর নজরে আসতে তাই বেশী সময় লাগেনি ৷ কারনানী এবার তার সেরা চালটা চাললেন ৷ রাজীবকে বললেন তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই ৷ এছাড়া তোমাকে আমার সেনাপতি করতে চাই ৷ তবে একটা শর্ত আছে৷ তোমাকে গৃহত্যাগ করতে হবে ও মুসলমান হতে হবে ৷ রাজীব লোচন লোভে পড়ে গেলেন ৷ একদিকে গৌড়ের সেনাপতির আসন ও সুন্দরী শাহাজাদী এবং অন্যদিকে তার পিতৃকুল ৷ শেষ পর্যন্ত তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে শাহাজাদীর পানি গ্রহণ করলেন ৷
প্রথম কয়েকদিন ভাল কাটার পর কিন্তু রাজীব তার কৃষ্টি সংস্কৃতি ও পরিবারের টান উপেক্ষা করতে পারলেন না ৷ তিনি হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন ৷ এরকম উদাহরণ ভারতের ইতিহাসে আরো অনেক আছে ৷ দক্ষিন ভারতের বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুক্ক মুসলমান হয়েও পরে হিন্দু ধর্মে ফিরে এসেছিলেন ৷ রাজীব গৌড়ের ব্রাহ্মণ সমাজে জানালেন সেকথা ৷ কিন্তু হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজ তখন জাত্যাভিমানে কলুসিত ৷ সমাজ তাকে গ্রহন করলো না ৷ রাজীব লোচন এবার বাঙালী ছেড়ে ওড়িয়া ব্রাহ্মণদের দ্বারস্থ হলেন ৷ ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দির হিন্দু সমাজে বিশেষ ভাবে আদৃত ৷ তিনি ঠিক করলেন পুরী গিয়ে শুদ্ধি (purifactory ceremony) অনুষ্ঠান সেরে হিন্দু সমাজে প্রত্যাবর্তন করবেন ৷ কেঊ কেঊ আবার বলেন যে, এই যাত্রায় নাকি তার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন ৷ তিনি নাকি তার বাবার ছলনাময় ধর্মান্তর নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন ৷ তবে এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না৷
ওড়িশায় পুরীতে পৌঁছে রাজীব আবার ধাক্কা খেলেন ৷ পুরীর সেবায়েতরা জানালেন যে, কোনো যবনের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই ৷ যবনরা বারবার মন্দির ধ্বংশ করেছে, নারীহরণ, বলাৎকার, লুন্ঠন থেকে দেবমুর্ত্তিকে খন্ড খন্ড করা কী করেনি তারা? এই জন্য জগন্নাথদেবের মন্দিরের দ্বার যবনদের কাছে বন্ধ৷ হতোদ্যম হয়ে গৌড়ে ফিরলেন রাজীব ৷
এরপর ব্রাহ্মণদের গোঁড়ামিকে শাস্তি দেবার জন্য উগ্র মুসলমান হয়ে ওঠেন তিনি ৷ গৌড়ের সেনার রাশ তার হাতে, স্বয়ং শাসক তার শ্বশুর তাই প্রতিশোধ নেবার অসুবিধা নেই তার ৷নতুন নাম নিলেন কালাপাহাড়। ধ্বংশের লীলা শুরু করে দিলেন পূর্ব্ব ভারতের দিকে দিকে ৷ ব্রাহ্মণদের ওপর বিদ্বেশের আগুনের দাবানলে আহুতি দিলো হিন্দু মন্দিরের কারুকার্য, ভাস্কর্য ও কলাকৃতি ৷ সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও গৌহাটির কামাখ্যা মন্দির, আর অবশ্যই ভারতীয় শিল্পকলা৷
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৫:০১