কয়েক ঘন্টার গল্প
==============
মিসেস আমজাদের যে হার্টের সমস্যা আছে।একথা সবাই জানত,তাই স্বামীর মৃত্যুসংবাদ ওনাকে কিভাবে দেয়া যায় এটা নিয়ে সবাই ভাবনার মাঝে পড়েগেল।
কথাটা তাঁকে বলার দায়িত্ব নিল তার বোন লায়লা, বয়সে ছোটজন। ব্যাপারটাকে খুব সন্তপর্ণে ধীরে ধীরে উন্মোচন করলেন ওনার কাছে।সেইসময় ওঁর স্বামীর কাছের একজন বন্ধু-ও কাছে ছিলেন।খবরটা সকালে উনিই পেয়েছিলেন আমজাদ সাহেবের। ট্যুরে যাবার সময় সড়ক দুর্ঘটনা।খবর পাবার পর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু সময় নিয়েছিলেন।
খবরটা শুনে মহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন,লায়লাকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে উঠছিলেন বারে বারে,স্বাভাবিক ব্যাপার।শোকের প্রাথমিক আবহ টা কেটে গেলে কান্নার শব্দ স্তিমিত হয়ে আসে।
এরপর উনি ওনার রুমের দিকে চলে গেলেন ধীরে ধীরে।কেউ সাথে গেল না।ওনার কিছুটা সময় একা থাকা দরকার।
হাট করে খোলা জানলা,তার ধারেই ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন। শরীরময় ছড়িয়ে যাওয়া যন্ত্রণা-হাহাকারের কষ্ট তার মনেপ্রাণে বিধে আছে সেটাকে অবদমিত করতে চাইছেন।
জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের খোলাজায়গায় চোখ গেল।
গাছের পাতায়-শাখায় ঘিরে আছে বসন্তের নতুন জীবন। আর,বাতাসে মনমাতানো বৃষ্টিভেজা ঘ্রাণ। রাস্তা থেকে ফেরিওলার হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। কেউ গান গাইছে,দূরে।কিন্তু সেই গানের সুর এখান পর্যন্ত ভেসে আসছে।কান পাতলেন।
মেঘের ফাঁক দিয়ে এখন নীলচে আকাশ উঁকি মারছে এদিক-সেদিক,জানলা দিয়ে দেখছেন উনি।
চেয়ারের মাথায় মাথা এলিয়ে দিলেন। ঘুমন্ত শিশু যেমন স্বপ্নের মাঝেও কেঁদে উঠে,সেরকম একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠছিল।গলার কাছে।
ওনার দৃষ্টি এখন আকাশের নীলচে রঙে নিবদ্ধ। সেখানে বেদনার বিধুরতা নেই,আছে কিছু একটা আবিষ্কারের উত্তেজনা। তিনি বুঝতে পারছেন,খুব সূক্ষভাবে তিনি অনুভব করতে পারছেন।
কিছু একটা আসছে,ধরা দিচ্ছে তার কাছে।এতকাল যার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।প্রতিক্ষণে ক্ষণে একটু একটু করে তার কাছে আসছে, তার বর্ণ,গন্ধ,উপস্থিতি সবই টের পাচ্ছেন।
উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়লেন। বুঝতে পারছেন এই অনুভূতি তাকে গ্রাস করতে চলছে।তাকে প্রাণপণে দূরে সরানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালালেন। ফিসফিসিয়ে তার মুখ দিয়ে একটি কথা বের হল। ঘনঘন নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তিনি বলতে লাগলেন – “মুক্তি,মুক্তি,মুক্তি” ,তার চোখের সেই শূণ্য,অসহায় দৃষ্টি এখন আর নেই। চকচক করছে তার চোখ। হার্টবিট বেড়ে গেল,আর শরীরের প্রতি অংশে তিনি অনুভব করতে লাগলেন এক উন্মাদনা।
এই আনন্দ কি ঠিক-না বেঠিক তার জানা দরকার নেই। এখন সবই তুচ্ছ।মৃত লোকটির মুখখানা,হাতখানা দেখে তিনি যে আরো একবার কাঁদবেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই,কিন্তু এই লোকটির সাথে দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক জীবন-প্রক্রিয়ার থেকে আজ তার মুক্তি।আর কেউ নেই ,এখন কেবল নিজের মত করে বাঁচা! হাহ!মানুষ কি ভাবে? তার নিজের ইচ্ছা ,ব্যক্তিগত ইচ্ছা সঙ্গীটির উপর চাপিয়ে দিয়ে জীবন পার করে দেয়! যুগ-যুগান্তরে এভাবেই সম্পর্কগুলো চলছে। এই ব্যাপারটি কি সূক্ষ্ণ অন্যায় নয়?
লোকটিকে হয়ত ভালোবেসেছিলেন,কিংবা কখনো কখনো বাসেন নি। এসবে কি এসে যায় এখন?হায়রে ভালোবাসা!এক রহস্যের নাম!নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে একাকার করে একে-অন্যের সাথে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়ার এইজায়গাতে ভালোবাসা কি ম্লান নয়?
মুক্তি আমার, দেহ আর মনের মুক্তি!-অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করেন।
লায়লা দরজার পাশে কান পেতে দাঁড়িয়ে,কিছুক্ষণ পর বলে উঠল-“আপা!দরজা খুলেন,এখন আর একা থাকা ঠিক হবেনা।আপনি অসুস্থ মানুষ”
“অসুবিধা নেই,তুই যা।এখন একা থাকতে ভালো লাগছে”
মিসেস আমজাদ এখন কেবলি ভাবছেন-সামনের দিন গুলোর কথা। কোন পিছুটান নেই,সম্পূর্ণ একাকী ।একা সময়গুলো সম্পূর্ণ-ই তার হবে। - জীবনটা যেন আরো বড় হয়;এভাবে কাটাতে চাই আরো কটা দিন- মনে মনে ভাবলেন। অথচ গতকালই মনে হয়েছিল-জীবন এত দীর্ঘ,ক্লান্তিকর কেন?
উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিলেন।ছোটবোন-এর বার বার অনুরোধের মুখে। তারপর ,বোনের শরীর জড়িয়ে ধরলেন ধীরে ধীরে নেমে এলেন নিচে।
কেউ যেন দরজা নাড়াচ্ছে। লায়লা দৌড়ে গিয়ে খুলে দিল।আমজাদ সাহেব!শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যান্ডেজ।বিধ্বস্ত চেহারা।
-একি,কাঁদছ কেন?
-আপা!
-আপা?কি হয়েছে ওর
-আর নেই...
আমজাদ সাহেবের ঐ বাসেই হয়েছিল দুর্ঘটনা।গুরুতর ক্ষতি হয়নি,অচেতন হয়ে পড়েছিলনে।বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িটির হতাহত হয়েছিল বেশি। দুর্ঘটনার পর পর কে বা কারা তাকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে দিয়ে যায়। সাথের ফোন-ব্যাগ ইত্যাদি জিনিসপত্র পাওয়া যায়নি। এই কয়েকটা ঘন্টায় কি থেকে কি হয়ে গেল!
ডাক্তার আসলে মিসেস আমজাদের মৃতদেহ চেক করলেন।হার্ট ফেইলিওর।তীব্র মানসিক উত্তেজনার চাপ সামলাতে পারেন নি।
(Kate Chopin এর দ্য স্টোরি অফ এন আওয়ার-গল্পের ছায়া অবলম্বনে)