আগের পর্বঃ লোলেগাও এ কাঞ্চনজঙ্ঘা’র দেখা!!! (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ১১)
আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় প্রাধান্যে ছিলো রাংগপো, লাভা এবং লোলেগাও, অফবিট ডেস্টিনেশন হিসেবে। সাথে পপুলার হিসেবে মিরিক, দার্জিলিং, কালিম্পং। আগের দিন লাভার রাস্তা বন্ধ থাকায় আমরা রাংগপো হতে সরাসরি লোলেগাও চলে গিয়েছিলাম। পরদিন সকাল বেলায় নাস্তা শেষে লোলেগাও এর হোমস্টে হতে চেক আউট করে ইচ্ছে ছিলো লাভা হয়ে কালিম্পং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিন্তু লাভা’র রাস্তা তখনো বন্ধ, আগের দিনের ল্যান্ড স্লাইডের কারণে। তাই আমরা লোলেগাও হতে সরাসরি কালিম্পং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দেই, পরিকল্পনায় ছিলো পথে যেতে যেতে বেশ কিছু সাইটসিয়িং করে নেয়া।
পাহাড়ি বাঁক দিয়ে বর্ষা দিনে সবুজ প্রকৃতির ভেজা চাঁদরে মুড়ি দিয়ে তাকিয়ে থাকা রূপ দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়ে একসময় পৌঁছলাম একটা পাহাড়ি বাঁকের ছোট্ট জনপদে, প্রথম দ্রষ্টব্য কালিম্পং এর হনুমান মন্দির। কালিম্পং শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে দালাপচন রিসার্ভ ফরেস্ট এর সন্নিকটে এই মন্দিরটি অবস্থিত। এই জায়গাটি মূলত পশ্চিমবঙ্গের আরেক বিখ্যাত পর্যটন এলাকা ‘ডেলো ভ্যালী’তে পড়েছে। কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে মন্দির চত্বরে প্রবেশের মূখেই এখানকার পূজারী’র সাথে আমাদের দেখা হয়ে গেল। ঝিরিজিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে মূল চত্বরে উঠে গেলাম। ভারতের প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই হনুমান মন্দির চোখে পড়ে, একই স্ট্রাকচারাল সেটাপ মূলত।
বৃষ্টির কারণে বেশী সময় এখানে কাটানো গেল না। কিছু ছবি তুলে আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম, প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে ডেলো ভিউ পয়েন্ট এর কাছে থাকা বৌদ্ধ মন্দিরে থামা হলো। এখানে দেখা গেল বেশকিছু তরুন বৌদ্ধ ভিক্ষু অধ্যয়নরত, আমরা তাদের সাথে কথা বললাম, চললো কিছু ছবি তোলার পালা। এখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমাদের পরপর্তী গন্তব্য ছিলো কালিম্পং সায়েন্স সিটি।
অক্টোবর ২০০৮ এ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় কালিম্পং সায়েন্স সিটির। কালিম্পং শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে সাত একর জায়গা নিয়ে কালিম্পং এর সর্বোচ্চভূমি ডেলোর চূড়াস্থ এলাকায় এই সায়েন্স সিটির অবস্থান। এখান হতে চারিপাশের দৃশ্য সত্যই মনোমুগ্ধকর। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে সাড়ে পাঁচ হাজার ফিটের বেশী উচ্চতায় এটিকে তৈরী করা হয়েছে। ফলে এক ঢিলে দুই পাখী শিকার করতে পারে পর্যটকেরা। সায়েন্স সিটি ভ্রমণের সাথে ডেলো’র উঁচু বিন্দু হতে চারিধারের চমৎকার প্রকৃতি।
পাহাড়ি জনপদের মানুষের কাছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি’কে জনপ্রিয় এবং আগ্রহের বিষয়ে রূপান্তর করতে এই সায়েন্স সিটির পত্তন করা হয়। ভারত সরকারের জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘর কাউন্সিল এর উদ্যোগে এটি তৈরী করে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে “ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন – দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল” এর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কালিম্পং সাইন্স সিটির কার্যক্রম তিনটি ভাগে বিভক্ত করে পরিচালিত হয়ে থাকেঃ ইন্ডোর এক্টিভিটিস, ইন্ডোর এক্সিবিশন এবং আউটডোর এক্সিবিশন। ইন্ডোর এক্টিভিটিস এর একটি অংশে রয়েছে “তারমন্ডল” যেখানে রাতের আকাশে নানান তারা, গ্রহ, নক্ষত্রের সাথে পরিচয় করানো হয়। দারুন তথ্যসমৃদ্ধ লাইভ ডেমোনেস্ট্রেশন এর একটি শোতে পঁচিশ জন দর্শনার্থী উপভোগ করতে পারে এই শো টি। এখানে আরও রয়েছে একটি “চিলড্রেন এক্টিভিটি কর্ণার”। এখানে বাচ্চাদের বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী করতে রয়েছে বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয়, আলো, শব্দ প্রভৃতির নানান ধরণের শিশুতোষ সরঞ্জাম যা যে কোন শিশুকে বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে।
মূল ভবনে প্রবেশের পূর্বে বাহিরে রয়েছে আউটডোর এক্সিবিশন। সবুজ চত্বরে নানান বিজ্ঞান উপকরণ যেমন মেকানিক্স সাউন্ড, অপটিকস, রিফ্লেক্টর সাউন্ড, সিম্প্যাথেটিক সুইং, ক্যামের অবসকিউর, নিজের ভর মাপা, স্পাইডার ওয়েব সহ মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ক নানান উপকরণ। এছাড়া এখানে রয়েছে একটি মিনি ডাইনোসর পার্ক!!! ভয় পাবেন না যেন…
আউটডোর এক্সিবিশন হলের প্রবেশমুখে রয়েছে প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিকদের ভাস্কর্য দুই সারিতে, মাঝখান দিয়ে প্রবেশপথ। এটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। ভেতরে প্রবেশের পর ইন্ডোর এক্সিবিশন মূলত তিনটি অংশে বিভক্তঃ ফান সাইন্স গ্যালারী, ডিজিটাল গ্যালারী এবং ডিজিটাল করিডোর।
ফান সাইন্স গ্যালারীতে বিজ্ঞানের নানান মজাদার বিষয় নানানভাবে প্রদর্শীত হয়েছে; যেখানে রয়েছে পেন্ডুলাম, গ্রাভিটি, অপটিক্যাল ইলিউশন, রোলিং বল, ফান মিরর, রঙ্গীন ছায়া, ক্যালিয়ডোস্কপ সহ অনেক আয়োজন। ডিজিটাল গ্যালারী অংশে রয়েছে নানান কম্পিউটারাইজড সাইন্টেফিক গ্যাজেট এর প্রদর্শনী। আর ডিজিটাল করিডোর এ রয়েছে নিজের দেহের মজার লাল রঙের ডিজিটাল ছায়া… বাচ্চারা খুবই এনজয় করবে এই সাইন্স সিটিট নিশ্চিত।
সাইন্সসিটি ঢুঁ মেরে আমরা ডেলোর উচ্চভূমি হতে চারিদিকের সবুজ পাহাড়ের বুকে সাদা মেঘের কারুকাজ দেখে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। মন চাচ্ছিলো এখানেই থেকে যাই, কিন্তু আমাদের রাত্রির আবাস যে এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে “হোটেল মনার্চ” যা আমাদের জন্য অদ্ভুত সুন্দর কিছু স্মৃতির জন্য অপেক্ষা করছে। সেই গল্প হবে আগামী পর্বে।
ভ্রমণকালঃ জুলাই ২০১৬
এই ভ্রমণ সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
উদ্ভট যাত্রার আগের গল্প (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০১)
যাত্রা হল শুরু; রক্ষে করো গুরু (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০২)
দার্জিলিং মেইল এর যাত্রা শেষে মিরিকের পথে (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৩)
মিরিকের জলে কায়ার ছায়া (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৪)
কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা টাইগার হিল হতে বাতাসিয়া লুপ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৫)
ঘুম মনেস্ট্রি হয়ে রক গার্ডেন (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৬)
দার্জিলিং পিস প্যাগোডা ভ্রমণ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৭)
দার্জিলিং জু (পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিক্যাল পার্ক) ভ্রমণ - (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৮)
মাউন্টেনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট এবং অন্যান্য (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৯)
"লামাহাট্টা" হয়ে "রাংগপো" (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ১০)
লোলেগাও এ কাঞ্চনজঙ্ঘা’র দেখা!!! (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ১১)
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২২ দুপুর ১:২২