আমি ভদ্রলোকের দিকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইলাম। উনি কেন যে আইনি পেশায় না গিয়ে পুলিশে চাকুরী নিলেন, তা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম; যদিও দুটিই কাছাকাছি পেশা, মাইক্রোইকোনমিক্স এর সাপ্লিমেন্টারি গুডস এর মত। আমাকে কথার জালে পেঁচিয়ে ভদ্রলোক খুব মজা পাচ্ছেন মনে হয়। আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, জিডি করতে এসেছি, নাকি মামলা? নিখোঁজ নাকি পালিয়ে যাওয়ার কেস? আমি তাকে এতক্ষণ ধরে বুঝাতে চেষ্টা করছি, আর উনি আমাকে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে মজা নিচ্ছেন। সাধারণত আমার দেখা এতো ইন্টিলিজেন্ট পুলিশ আমি দেখি নাই। ভদ্রলোককে খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু থানার ভেতরে বসে সেই সাহস হচ্ছে না। আমার চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেই কি না, উনি আমাকে বললেন,
“এক কাজ করেন, আপনি একটা জেনারেল ডায়েরী করে রেখে যান; দেখেন আপনার ভাই এর হয়তো মেয়ে পছন্দ হয় নাই। তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। অথবা হয়তো তার কোন প্রেমিকার সাথে পালিয়ে গেছে। যদিও আপনার বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে না আপনার ভাই সেরকম কিছু করবে বলে…”
“আমার ভাই নয়, আমার বন্ধুর ভাই”
“আচ্ছা… ঐ একই কথা। যা পঞ্চাশ, তাই একশো। আপনি একটা লিখিত আবেদন জমা দেন”
“আবেদন! কি লিখতে হবে?” বলে আমি উনার কাছে কাগজ চাইতে বললেন, “কাগজ তো নেই, কাগজ কলম কিনে একটা এপ্লিকেশন লিখে জমা দিয়ে যান। আমরা আগামীকাল সকালে দেখবো কি করা যায়”।
আমার এতক্ষণের অবাক হওয়া বিরক্তিতে রূপ নিয়েছে। মেজাজ গরম হয়ে গেল, ব্যাটা এতক্ষণ আমাকে নিয়ে মজা করেছেন, থানায় বসে টাইম পাস, জাস্ট টাইম পাস। শীতের রাতে থানায় বসে বসে টাইমপাস করাটা খুব কঠিন কাজ বৈকি। থানা হতে বের হওয়ার মেইন গেটে এসে দাঁড়িয়ে নিয়ন আলোর নিশ্চুপ রাস্তায় একটা সিগারেট ধরালাম। কি করা যায়? এই যখন ভাবছি, তখন দেখি আমাদের এলাকার বন্ধু মিজান রিক্সা করে বড়বাজার এর দিকে যাচ্ছে।
“আরে জামাইন্ন্যা, কি হইলো কিছু? মামুর ব্যাটারা কি কইলো?” আমাকে দেখে আমার পাশে রিকশা থামিয়ে মিজান জিজ্ঞাসা করলো।
“না, কোন কিছুই হয়নি। আমারে কয়, কাগজ কলম কিন্না আইনা এপ্লিকেশন লেইখা যাইতে, কাইলকা খোঁজ করবো।“
“কি কস হালায়। মাম্মার হলুদ হইবো কেম্বে আইজকা? চল আমার লগে, বাজার থেইক্যা মালপানি কিন্না, ভালা কইরা সার্চ অপারেশন করুম, হালা মাম্মায় যে চিপাতেই পলায়া থাকুক না, হালারে খুইজ্জা বাইর করুম।“
“না, আমি মহল্লায় যাই, তুই আয় কাম সাইরা” – বলে আমি এলাকার দিকে পা বাড়ালাম। আমার বন্ধু সুজনের বড় ভাই রাজন, আমাদের থেকে বছর পাঁচেকের বড়, এলাকায় সবাই তাকে “মাম্মা” বলেই ডাকি। কিছুটা মাথায় সমস্যা আছে, তাই সবাই তার সাথে ছোটবেলা থেকেই মজা নেয়। আর সে ও তাতে কিছু মনে করে না। “পাগলা মাম্মা” বলে ডাক দিলেই চমৎকার করে একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে আসবে। খেলা পাগল মানুষ, আমার প্রথম স্টেডিয়াম গিয়ে খেলা দেখা এই মাম্মা, তথা রাজন মাম্মার সাথেই। আজ তার গায়ে হলুদ, কিন্তু সন্ধ্যের পর থেকে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজন-সুজনের ফুফাতো বোন মিতালি। ছোটবেলায় ওদের ফুফা-ফুফু এক্সিডেন্ট এ মারা গেলে মিতালি আর মিথুন, দুই ভাইবোন মামার বাসায় মামা-মামী’র কাছে চলে আসে। ওদের বাসাতেই বড় হয়েছে ওরা দুজন, মিথুন বড়, আমাদের সমবয়সী, মিতালি আমাদের থেকে বছরে তিনেক এর ছোট হবে। রাজন মাম্মার আম্মা মিতালি’কে আপন মেয়ের মত ভালবাসা আদর যত্নে বড় করেছেন। তাই নিজের কাছ ছাড়া করতে চান না বলেই, বড় ছেলে রাজন এর সাথে বিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিতে চান। যদিও এলাকার লোকজন এ নিয়ে নানান কথাবার্তা বলছে। কারন, রাজন ভাইকে এলাকার মানুষ পাগলা রাজন নামেই চেনে। এমন ছেলের সাথে মিতালি’র বিয়ে; সবাই মনে করছে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করেই মিতালি’র বিয়ে দেয়া হচ্ছে। মেয়েটা’র আগে পিছে কেউ নেই বলেই, আপন মামা-মামী এমন সর্বনাশ করতে পারছেন বলে এলাকার মুরুব্বী মহলে গত কয়েকদিন ধরেই এসব আলোচনা চলছে।
এলাকায় এসে আমি বাসায় না গিয়ে, সুজনদের বাসায় ঢুকে পড়লাম। এখনো সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। সবাই ধরে নিয়েছে হয়তো রাজন ভাই আশেপাশেই এলাকায় কোথাও আছে। এটা তার পুরোনো অভ্যেস। নীচতলা দিয়ে ছাঁদের সিড়ির দিকে যাওয়ার সময় বাসার ভেতর থেকে মেয়ে-মহিলা-বাচ্চকাচ্চ’দের হুল্লোড় কানে এলো। ছাদে হাই ভলিউমে স্পিকারে চটুল হিন্দি গান বাজছে। আমি সোজা ছাদে উঠে গেলাম। সকাল থেকে সব বন্ধুরা মিলে স্টেজ সাজিয়েছি, এখনো তেমন লোক ভীড় করে নাই স্টেজের কাছে। আমি স্টেজের কাছে এগিয়ে যেতে দেখি ছাঁদের এককোনে মিথুন বসে আছে। গত কয়েকদিন ধরে দেখছি, ও কেমন চুপচাপ। আমি ওর পাশে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম।
“কিরে মিথুইন্যা, একা একা এই চিপায় বয়া কি করস?”
“কিছুনা, কি খবর? রাজন ভাইরে পাইছোস?”
“আরে না, থানায়ও চক্কর দিয়া আইলাম”
“থানায়? ক্যারে, থানায় ক্যা” মিথুন খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো। আর তার অবাক হওয়া দেখে আমি আরো বেশী অবাক হলাম।
“আরে, জহির ভাই কইলো, একজন গিয়া থানা আর হাসপাতালে খোঁজখবর লইতে, তাই আমি থানায় আর সামাদ হাসপাতাল গেলাম”
“ধুর, দেখ গিয়া, রাজন ভাই কোন চিপায় হান্দায়া আছে”
“এইটাও ঠিক, মাম্মা হালায় কহন কুন চিপায় থাকে, কওন যায় না। আচ্ছা মিথুন, তরে একটা কথা জিগাই”
“কি কথা”
“এই যে মিতালি’রে রাজন মাম্মার লগে বিয়া দিতাছে, তুই এইটাতে কি রাজী আছিলি?”
“আমার রাজী থাকা দিয়া কি হইবো?”
“মিতালি কি রাজী এই বিয়াতে?”
“জানি না, মিতালি’রে গিয়া জিগায়া আয়” – একটু রাগত স্বরে মিথুন বলল। আমি লক্ষ্য করলাম ওর চোখটা লালবর্ণ ধারণ করে আছে, আর তার মাঝে চিকচিক করছে কষ্ট করে আটকে রাখা অশ্রুবিন্দু। আমি আর কথা না বাড়িয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েরা সবাই মিতালি’কে নিয়ে ছাদে চলে এসেছে। কথা ছিল প্রথমে হলুদ দেয়া হবে রাজন মাম্মা’কে, তারপর মিতালি’কে। রাজন মাম্মা লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার কারনে, প্রোগ্রাম এ চেঞ্জ, প্রথমে হলুদ দেয়া হবে মিতালি’কে। হলুদ জমিনে সবুজ পাড় এর শাড়ীতে মিতালি’কে দেখে অপ্সরাদের মত লাগছে। আমি ভালো করে লক্ষ্য করলাম স্টেজে সদ্য বসা মিতালি’কে। বন্ধুর ছোট বোন হওয়ায় আগে তেমন করে দেখা হয় নাই এই মেয়েকে। আজ এই হলুদ সন্ধ্যার আয়োজনে কণের সাজে স্টেজে বসে থাকা মিতালি’কে দেখে মনে হচ্ছে, এই মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়েদের একজন, এর তো রাজন মাম্মার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা না, উচিতও না। মেয়েটি খুব ভাল একটা পাত্র ডিজার্ভ করে। কেন জানি না, মিথুন এর মত আমারো চোখ ভারী হয়ে এল, আমি দ্রুত সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম।
রাজন ভাইদের বাসা হতে গলির মুখে বড় রাস্তার চৌমাথায় এসে দেখি ময়না মিয়ার চায়ের দোকানে পোলাপান গল্প করছে। এককাপ চা হাতে নিয়ে সিগারেট ধরাতে যাবো, দেখি ইলিয়াস ভাই এসে হাজির। প্রতি এলাকায় দু’একজন মানুষ আছে যারা কোন কাজকর্ম সারাজীবনে করে না, এলাকার নানান মানুষের নানান গালগল্প করে তাদের জীবন কেটে যায়, ইলিয়াস ভাই সেরকম একজন। বয়সে আমার বাবাদের বয়সী হলেও এলাকার ছেলে-বুড়ো সবাই তাকে “ইলিয়াস ভাই” বলেই ডাকে। আমাকে দেখতে পেয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
“কিরে, রাজন পাগলা নাকি হাওয়া?”
“হ, বিকাল থেকা কুনু খবর নাইক্যা”
“কি হুনলাম, পাগলা নাকি কুন মাইয়া রে লিয়া পলায়া গেছে গা”
“ধুর ইলিয়াস ভাই, কি যে কন না আপনে! রাজন মাম্মা কুন মাইয়া রে লিয়া পলাইবো? হের লগে মাথা খারাপ ছাড়া কুনু মাইয়া পলাইবো?”
“এইটা ভালা কইছোত। আচ্ছা, মিতালি নাকি বিয়াতে রাজী আছিলো না, ওর মামু নাকি জোরজবস্তি বিয়া করাইতাছে পাগলার লগে”
“কি জানি, মিতালি’রে গিয়া জিগান গিয়া” আমার কিছুক্ষণ আগে দেখা মিথুন এর চেহারার কথা মনে পড়লো। আমি চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে রাজন ভাইদের বাড়ীর দিকে পা বাড়ালাম। সামাদ হাসপাতাল থেকে কোন খোঁজ নিয়ে আসে আল্লাহ্ই জানে। রাজন ভাইদের বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, কোন খারাপ সংবাদ নিয়ে যেন সামাদটা না আবার সরাসরি বিয়ে বাড়ীতে ঢুকে হুট করে বলে দেয়। কেন যেন মনে কু ডাকছে। মাম্মা রাজনকে ঘিরে আশৈশব গড়ে ওঠা নানান টক-মিষ্টি-ঝাল স্মৃতির টুকরোগুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। রাজন ভাই ছোটবেলা থেকেই একটু চুপচাপ, বোকাসোকা ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার বুদ্ধি যে কম, তার কান্ডকারখানার মাঝে পাগলামি সবার চোখে পড়তে লাগলো। উনিও হয়তো একধরণের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, কিন্তু তখন মানুষ এত বুঝতো কোথায়। নানান ডাক্তার-কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক-পানিপড়া-তাবিজকবজ শেষে রাজন ভাইয়ের বাবা-মা হাল ছেড়ে দিলো। রাজন ভাই ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত স্কুলে গিয়ে সেটাও বন্ধ করে দিল। সারাদিন ঘুরেফিরে কাটায়, মাঝে কিছুদিন তার বাবার সাথে দোকানে গেল, একদিন দোকানের ক্যাশ হতে টাকা চুরির জন্য বাসায় এনে আচ্ছামত ধোলাই দেয়া হলো তাকে। এরপর থেকে সেই পাঠও চুকিয়ে দিব্যি সুখেই ছিল রাজন ভাই। হুট করে এই বিয়ের আয়োজন এবং তার লাপাত্তা হওয়া কিছুই মিলছে না।
সামাদ কে দেখলাম গলির মুখ হতে এইদিকে আসতে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে জানালো, সেরকম কোন খবর মেলে নাই হাসপাতালে গিয়ে। তবে হাসপাতাল থেকে বলেছে একটা ছবি দিয়ে যেতে আর ফোন নাম্বার। আমার মনে পড়লো থানার ডিউটি অফিসার এর কথা, ঐ ব্যাটা আমার কাছে ছবি, ফোন নম্বর এসব কিছুই চায় নাই… আশ্চর্য, ভুল জায়গায় বেচারা চাকরী করতে চলে এসেছে।
“দোস্ত, তুই মিথুনরে দেখছোত?”
“হ, কিছুক্ষণ আগে ছাঁদে গেছিলাম, সেইখানে বইস্যা আছে চুপচাপ”
“দোস্ত আমার মনে একটা খেয়াল আইছে” কেমন রহস্য করে সামাদ আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
“কি খেয়াল?” আমি হালকা স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম।
“শুনলাম মিতালি-মিথুন কেউই রাজী আছিলো না বিয়াতে। মিথুন নাকি তিন চাইর দিন আগে বাসায় খুব চিল্লাচিল্লি করছে। আমার দোস্ত কেন জানি মনে হইতাছে। মিথুন রাজন ভাইরে গায়েব কইরা দেয় নাইক্কা তো” সামাদ কেমন গোয়েন্দাদের মত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।“
“ধুর শালা, সারাদিন ক্রাইম নাটক, সিনেমা দেইখা তর মাথা পুরাই গেছে…” সামাদের দিকে গটগট করে তাকিয়ে আমি গলির শেষ মাথায় রান্নাবান্নার আয়োজন যেখানটায় চলছে সেখানে চলে গেলাম। বাবুর্চি মাক্ষী মিয়া, ডেকচির ঢাকনার উপর গরম কয়লা দিচ্ছে। বিরিয়ানি রান্না শেষ, চারিদিকে বিরিয়ানির গন্ধে নেশা ধরে যাচ্ছে, এর মাঝেই একটি দৃশ্য মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, মিথুন রক্তমাখা চাকু হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে রাজন ভাই রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবী-লুঙ্গী পরিহিত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। আমার মাথাটাও সামাদের মত গেছে বুঝি। নিজের উপর বিরক্ত হলাম।
“ভাই প্রোগ্রাম কি খাওয়া দাওয়া’র পর শুরু হইবে” ব্যান্ড পার্টির লম্বা চুলওায়ালা ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল। আমি তাকে খেয়ালই করিনি। গলির এই শেষ মাথায় আধো অন্ধকারে সে সিগারেট ফুঁকছিলো, সুজনের জেদাজেদিতে রাজন ভাই এর বাবা পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজী হয়েছেন রাতের গানবাজনার আয়োজন এর জন্য, যার পুরো দায়িত্ব নিয়েছে মিজাইন্যা। ও আবার এই লাইনের চালু মাল। কোথা থেকে যেন ধরে নিয়ে আসছে এই চেংড়া পুলাপানের ব্যান্ড দলটিকে।
“হ, খাওনের পরই আপনাগো গান শুরু করবেন”
“ভাই, শুনলাম জামাই নাকি পলাইছে বিয়ার ভয়ে?”
“ধুর মিয়া পলাইবো ক্যা?”
“এইটাও ঠিক, এত্ত সুন্দর বউ রাইখ্যা পলাইবো কুন পাগলে?”
এই ব্যাটার কথা শুনে মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল, মনে মনে কইশ্যা কয়টা খারাপ খারাপ গালি দিয়ে আমি রাজন ভাইদের বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়লাম। সিঁড়ি দিয়ে ছাঁদের দিকে উঠতে যাবো এমন সময় রাজন ভাইয়ের আম্মার ডাক দিলেন,
“বাবা জামান, একটু এইহানে আয় তো”
“হ খালাম্মা, কন” আমি উনার দিকে এগিয়ে গেলাম।
“রাজনরে পাইছোত? তুই নাকি থানায় গেছিলি?”
“না খালাম্মা, মহল্লার কয়েকজন কইছিলো, তাই আমি সামাদ গেলাম একটু…”
“এই পাগলাটারে লিয়া আমি আর পারি না। এইসব থানা ফানা বাদ দিয়া তুই এক কাম কর। জামতলার মরা শশ্মান এর পাশের পুকুর পাড়ে একটু দেখতো বাপ”
‘ঠিক আছে খালাম্মা” বলে ছাঁদের দিকে গেলাম। মিথুনরে সাথে নিয়ে যাই। ছাঁদে দিয়ে দেখলাম, স্টেজের কাছে জটলা করে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম ভীড় ঠেলে, দেখি মিতালি কাঁদছে। চোখের কাজল ভিজে লেপ্টে গেছে। সবাই তাকে নানান কথা বলে বুঝাচ্ছে। সুজনের বড় খালা তাকে ধমকাচ্ছে। ঘটনা কিছুই বুঝা গেল না। মিথুন সেই আগের জায়গাতেই বসে আছে। তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
“ঐ মিথুইন্যা, বিয়াই শালা, হইছেটা কি রে?”
“জামান যা তো, বিতলামি করিস না”
“বিতলামি করলাম নি? তুই তো এহন থেইক্যা আমাগো বিয়াই। তুইও হালা বিয়াই, সুজনও বিয়াই। রাজন ভাই দুলাভাই, মিতালি হইলো ভাবি।“ বলে আমি নিজের মস্করায় নিজেই জোরে হেসে উঠলাম। স্টেজের জটলার মুখ এদিকে ঘুরে তাকালো, সেই জটলার মাঝে দেখি রাজন ভাই এর বড় খালা গটমট করে তাকিয়ে আছেন, চোখ দিয়ে আমাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিবেন যেন। আমি মিথুনকে জোর করে ধরে সাথে নিয়ে নীচে নামলাম। উদ্দেশ্য ওকে সাথে নিয়েই জামতলার দিকটা একটু খোঁজ করে আসি। রাজন ভাই এর এই এক আজব স্বভাব। নানান সময়ে তাকে নানান জায়গায় বসে থাকতে দেখা যেত। একবার তো মাঝরাতে তাকে তার বাবা রেলস্টেশন এর প্ল্যাটফর্ম এ বসা অবস্থায় উদ্ধার করলেন। আজ না জানি কোথায় গিয়ে বসে আছে।
আমি মিথুন কে নিয়ে বড় রাস্তার চৌমাথা’র দিকে হাঁটছি, গলির বাঁক ঘুরতে দেখি রাজন ভাই সাদা লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরিহিত অবস্থায় রিকশা হতে নেমে ভাড়া দিচ্ছেন। আমি আর মিথুন দ্রুত এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। আমাদের দেখতে পেয়ে রাজন ভাই আমার দিকে এগিয়ে এলেন
“ অই জামাইন্যা, আরামবাগ তো তগো মোহামেডানেরে ভইরা দিছে। চাইর গোলে হারছে আইজকা তগো দল”
আমি আর মিথুন অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরালাম খুশীতে ডগমগ রাজন ভাইয়ের দিকে। খেলা পাগল আবাহনীর পাড় ভক্ত তার গায়ে হলুদের দিন সন্ধ্যের পর থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন চিরশত্রু মোহামেডান এর খেলা দেখতে! আমি এগিয়ে গিয়ে রাজন ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম, উনি বিরক্ত হয়ে আমার হাতের বাঁধন হতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে আমি তাকে আরো কষে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম, “চলো মাম্মা, বাসায় চলো। আজ মাম্মার গায়ে হলুদ…”
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:২৩