আজ ওদের সবার মন খারাপ
============================
১.
ছোট থেকে পড়ালেখা আর পড়ালেখা, এরপর ক্যারিয়ার গড়তে ছুটে চলা। প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম সারিতে রইলো মেধা তালিকায়। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের আসন নিশ্চিত করে সফলতার সাথে সমাপ্ত করলো শিক্ষাজীবন। এরপর বছর খানেকের কয়েক ডজন পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানীতে মোটা অঙ্কের বেতনে চোখ ধাঁধানো ক্যারিয়ারের শুরু। ঢাকা শহরে দুই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, সুন্দরী বউ, ফুটফুটে দুই সন্তান নিয়ে জীবনের মধ্য বয়সে এসে আবিস্কার করলো, কি যেন নেই, নেই মনে শান্তি। কি যেন পাওয়া হয় নাই জীবনের এই ছুটে চলায়। তখনই একদিন এক বন্ধুর মারফত পরিচয় এই স্বপ্নময় ঘোরলাগা এক ভুবনের সাথে। অজানা কিছু মানুষ নিজেদের মনের কথা লিখে যায় অন্তঃজালের এক অজানা প্লাটফর্মে। কেউ গল্প, কেউ কবিতা, কেউবা ভ্রমণ গল্প। রম্য, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে রান্নার রেসিপি অথবা ভাব গম্ভীর ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজনীতি কোন কিছুই বাদ যায় না। সেই জগতে একসময় বুঁদ হয়ে যায় কর্পোরেট জগতের সফলতার চূড়া ছোঁয়া সেই মানুষটি। অহংকার করার মত শিক্ষা জীবন বা কর্ম জীবন থেকে শুরু করে সংসার জীবন যে মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে নাই মানুষটিকে; হুট করে এই ভার্চুয়াল জগতের মানুষগুলো আর এদের লেখা-মন্তব্যে, আলোচনা-সমালোচনার মাঝে খুঁজে পেল সেই সুখ, সেই প্রশান্তি, যা মন তথা হৃদয়কে দিতে পারে নাই তার বর্ণাঢ্য শিক্ষা-কর্ম-সংসার জীবন। ভালই কেটে যাচ্ছিল জীবনের এই গোছানো সময়গুলো; সারাদিনের কর্মব্যস্ত কর্পোরেট লাইফ শেষে বাসায় ফিরে রাতে একান্তে ঘন্টা খানেক সময় কাটাতো এই ভার্চুয়াল জগতে। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে কেন যেন সেই জগতে প্রবেশের দ্বার বন্ধ হয়ে আছে। হাজারো চেষ্টা করেও ঢুকতে পারছে না। অবশেষে জানতে পারলো, বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ কমিউনিটি ব্লগিং সাইটটি সরকারী একটা ভুল সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রশান্তির শেষ ঠিকানাটি কিনা এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে...
============================
২.
আগে সারাদিন কাটতো কলেজ-টিভি-বন্ধুদের আড্ডা’র মাঝে। যে কাজটি সদ্য টিনএইজ পার করা ছেলেটির জীবনে কোথাও স্থান ছিল না গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়ার ব্যাপারটি। পাঠ্যসূচীর বাইরে এই জীবনে ছেলেটি কখনো কোন বই পড়েছে বলে মনে করতে পারে না। বাসায় ফিরে ক্যাবল টেলিভিশনে নানান চ্যানেলে ঘোরাঘুরি অথবা ইন্টারনেটে ফেসবুক, ভাইবার বা হোয়াটসআপ এ আড্ডাবাজি। এসবের মাঝে ভালোই কাটছিল জীবন। হুট করে একদিন ফেসবুক এর গ্রুপ চ্যাটে এক বন্ধু একটি গল্পের লিঙ্ক দিল, হাস্যরসে ভরপুর চমৎকার এক ছোট গল্প ছিল তা। পড়ে এতোই ভাল লাগলো যে, সেই বন্ধু হতে খোঁজ করলো এর লেখক কে? আর সেই সূত্র ধরে প্রথম পরিচয় ব্লগ জগতে, তাও বাংলা ভাষার প্রধানতম ব্লগ। সারাদিনে কত রকমের লেখা যে আসে এখানে! জীবনে কখনো পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোন কিছু না পড়া ছেলেটা এখন প্রায় সারাটা অবসর সময়ই পড়ে থাকে ল্যাপটপ নিয়ে। একের পর এক লেখা পড়ে আর মুগ্ধ হয়, সেই মুগ্ধতা কবে যে গল্প হতে ছড়িয়ে গেছে প্রবন্ধ, কাব্য বা সমসাময়িক বিশ্লেষণী লেখায় নিজেই জানে না। যাই পড়ে, তাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে টেনে নিয়ে যায় আরও গভীরে। এর সাথে হুট করে একদিন দেখলো এখানে পাঠক মন্তব্যও জানাচ্ছে। আর কি মজাদার সেই মন্তব্য-প্রতি মন্তব্যের খেলা। পরীক্ষার জন্য কিছুদিন ব্লগে ঢুঁ মারা বন্ধ রেখেছিল। পরীক্ষা শেষে ব্লগে ঢুকতে গিয়ে আবিস্কার করলো এই ব্লগ সাইটটি নাকি বন্ধ হয়ে গেছে! সেই বন্ধুকে নক করে জানলো এখনো বন্ধ হয় নাই, কিন্তু বন্ধ করে দিবে। কারণ, এটি নাকি একটি পর্ণো সাইট! শুনে তার মনে হল হাসবে নাকি কাঁদবে? পর্ণোগ্রাফী সাইট কাকে বলে, ওদের বন্ধু রতন এর কাছে গেলে ভাল মত শিখিয়ে দিতে পারতো যারা এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদেরকে। খুব অস্থির লাগছে, ছুটির এই সময়গুলো যে এখন আর কাটে না। বন্ধুদের আড্ডা, টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়ার চ্যাট কোন কিছুই আর আকর্ষন করে না। মাথার ভেতর ঘুরপয়াক খায় সেই স্বপ্নের ভুবন...
============================
৩.
স্কুলে পড়াকালীন জাতীয় দৈনিকে যখন মেয়েটির একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল, তখন থেকে স্বপ্ন দেখে একদিন লেখক হবে। স্কুল কলেজ পেড়িয়ে ভার্সিটি এসে ফের সেই স্বপ্ন মাথাচারা দিয়ে ওঠে। প্রায়শই গল্প, কবিতা লিখে পাঠায় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক বরাবর। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি লেখাও ছাপা হয় নাই। লেখালেখির ভুতটা তবুও মাথা থেকে নামছিল না, রাতের পর রাত তরুনী লিখে যায় জীবনের কাব্য, মানুষের গল্প। সব বন্দী ছিল তার লেখার ডায়েরীর পাতায় পাতায়। হুট করেই একদিন এক বান্ধবীর কাছ থেকে খবর পেল ব্লগিং এর। সাথে সাথে বেশ কিছু ব্লগ সাইটে ঘোরাঘুরি করলো কিছুদিন এবং এক সাথে তিনটি ব্লগে একাউন্ট খুলে ফেলল। সময়ের সাথে সাথে ব্লগ নিয়ে দেশের মানুষের মাঝে কিছু ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হল, সরকারও কিছু ব্লগ সাইট বন্ধ করে দিল। কিন্তু দেশের প্রথম এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাংলা ব্লগ সাইটটি ঠিকই পথ চলছিল আপন মহিমায়। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে অজ্ঞাত কোন এক কারনে এই ব্লগটিও নাকি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়েটি এখনো লিখে যায় সেই আগের ডায়েরীতেই, সাথে হয়ত চোখের কোণে জমে দু’এক ফোঁটা অশ্রুজল। তবে সে জানে, ফের সে ফিরে যাবে সামু নামের সেই ব্লগ আঙ্গিনায়, আবার তার গল্প কবিতায় সরব হবে সামু পরিবার। কতশত অচেনা কিন্তু তবুও যেন খুব চেনা ব্লগারেরা মন্তব্য প্রতিমন্তব্যে পোস্টমর্টেম করবে তার সাহিত্য কর্মগুলোর...
============================
৪.
রিহ্যাবিটেশন থেকে ফিরে ছেলেটি আর ঘর হতে তেমন বের হয় না। এই নিয়ে গত চার বছরে তিনবার তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গেছে তার পরিবার। প্রতিবারই সে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনো নেশার জগতে পা বাড়াবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পুরানো বন্ধুদের সাথে মিশে কিভাবে যেন ফের ডুবে যায় নেশার জগতে। এবার সেই ভয়ে সে আর ঘর হতে বাইরে পা বাড়ায় না। এরই মাঝে তার ছোট বোন তাকে একদিন এসে ল্যাপটপে একটা লেখা পড়তে দিল, যার শিরোনাম ছিল “মাদক থেকে মুক্তি – নিজের মানসিক শক্তি সবচেয়ে বড় উপায়”। লেখাটি পড়ে দুদিন অদ্ভুত এক ভাবনার জগতে বসে রইলো। মানুষ এভাবেও ভাবতে পারে? এভাবেও কেউ কাউকে লেখার মাধ্যমে ভাবাতে পারে? তারপর দিনই সেই ব্লগে একটি একাউন্ট খুলে ফেলল। এখন সারাদিন সে প্রায় প্রতিটি লেখাই পড়ে, মন্তব্য করে, অন্যের মন্তব্য দেখে। মাঝে মাঝে ব্লগেই চলে জমজমাট আড্ডা। এভাবে কোন ফাঁকে প্রায় ছয় মাস পার করে দিয়েছে ছেলেটি নিজেই জানে না। এখন আর বাইরে বের হতে ভয় পায় না। পুরাতন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, কিন্তু নেশার কথা আর মনে পড়ে না। কেউ মনে করিয়ে দিলেও সে হেসে বলে, “যা ফেলে দিয়েছি, তার আর কুড়িয়ে নিতে চাই না”। ভালই যাচ্ছিল দিনগুলো, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থাকা ছেলেটি গত কিছুদিন হল ফের মন মরা হয়ে ঘরে বসে থাকে। অসহ্য একাকীত্ব ভর করেছে, সেই ব্লগ সাইট নাকি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। হায় হায়, তার কি হবে? সে যে এই স্বপ্নের জগতের নেশায় বুঁদ হয়ে পরাজিত করেছিল মাদকের ভয়াল নেশা। তবে কি আবার ছেলেটি সেই ভয়াল নেশার মাঝে আশ্রয় খুঁজবে তার একাকীত্ব ঘুচাতে।
============================
৫.
দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সরকারী কর্ম জীবন এর সমাপ্তি হয়েছে বছর খানেক আগে। রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার আগের কিছুদিন খুব ভাবনায় ছিলেন, তার সময় কাটবে কিভাব? ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করেছেন, সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে প্রবাসে সেটেল্ড। কিন্তু সরকারী উচ্চ পদে চাকুরী করার কারনে বিপত্নীক ভদ্রলোক দেশেই রয়ে গেছেন। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে কর্মজীবন শেষে হুট করেই নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়েছে প্রথম কয়েকদিন। কিন্তু কিভাবে যেন এই ব্লগ এর খোঁজ পেয়ে গেলেন একদিন। নানান মানুষ নানান বিষয় নিয়ে লিখছে, পড়ছে, মন্তব্য করছে, প্রতি মন্তব্য হচ্ছে। কিছুদিন পাঠক হয়ে কাটানোর পর তার মনে হল এই দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতায় ঠাসা নিজের জীবনের নানান কাহিনী লিখবেন ব্লগের পাতায়। কিন্তু যেহেতু সরকারী চাকুরী করেছেন দীর্ঘদিন উচ্চপদে, তাই নিজ নামে একাউন্ট ওপেন না করে, ছদ্মনামে লিখতে লাগলেন। ভালই সাড়া পাচ্ছিলেন, নিজেও লেখালেখি করে মজা পাচ্ছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা প্রাতঃভ্রমণ শেষে নাস্তার পর বসে যেতেন ল্যাপটপ নিয়ে, দুপুর অবধি চলতো নানান পাঠকের লেখাগুলো পড়া। এরপর ফের সন্ধ্যের পর বসতেন নিজের লেখা নিয়ে, পোস্ট করতেন, আগের পোস্টগুলোতে করা মন্তব্যের জবাব দিতেন। এই করে রাত দশটা নাগাদ রাতের খাবার শেষে ঘুমানোর আয়োজন। মোটামুটি এরকম এক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। গত কিছুদিন যাবত এই ব্লগ বিটিআরসি নাকি বন্ধ করে দিয়েছে বলে শুনছেন। কি দোষ? একবার শুনলেন, পর্নোগ্রাফীর অভিযোগে, আবার শুনলেন রাষ্ট্রর কল্যাণ পরিপন্থী লেখালেখির জন্য। নিজের সরকারী কর্ম জীবনের কারনে সহজেই বুঝতে পারছেন, কাদের ইশারায় এসব হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো লেখার জন্যও ঢুকতে পারছেন না সেই স্বপ্নিল ভুবনটাতে। মাঝে মাঝে মনে হয় বিটিআরসি’তে গিয়ে বড় কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেন, কোন অভিযোগ বা যুক্তিতে এরকম সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন, তা জিজ্ঞাসা করবেন। জানেন কোন লাভ নেই, তারপরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়। কিন্তু নিজেকে দমন করে রেখেছেন, কারণ সরকারী চাকুরী করলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছু সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে হয়। তবে তিনি অপেক্ষা করছেন, অতি শীঘ্রই এই ভুল সিদ্ধান্তটি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারবে, তুলে নিবে এই আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, তিনি ফিরে পাবেন শেষ বয়সে পাওয়া এই নতুন জীবনসঙ্গীকে...
============================
৬.
কলেজ না পেরুতেই বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিলেন প্রবাসীর সাথে। স্বামীর সাথে সেই থেকে নিজ দেশ, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে দেশের বাইরে ঘুরে ঘুরে জীবন কাটাচ্ছিলেন বছরে চললিশের মহিলাটি। প্রবাসের এই জীবনে আশেপাশে কোন বাঙ্গালী পরিবার নেই, দু’চারজন ভারতীয় আছে; তারাও হয় মাদ্রাজী অথবা গুজরাটি। একজন আছে পাঞ্জাবী। কিন্তু বাঙ্গালীর দেখা নেই এই তল্লাটে। এর মাঝে বছর পাঁচেক আগে দেশে রাজাকারদের বিচার ইস্যুতে “ব্লগ” এবং “ব্লগার” শব্দ দুটির সাথে পরিচয়। পত্রপত্রিকা হতে জানলেন বাংলা ব্লগ জগত সম্পর্কে। এরপর থেকে এই ব্লগ হয়ে আছে তার সারাদিনময় ছায়া সঙ্গী হয়ে। ঘরের টুকটাক রান্নাবান্না, ঘর গুছানো, বাচ্চাকে স্কুলে আনা নেয়ার ফাঁকে ফাঁকে এবং অবসর সময়ে; তার সঙ্গী এই বাংলা ব্লগটি। সামু তার নাম, তার একান্ত ছায়াসঙ্গী, জীবনসঙ্গীর চাইতে কোন অংশে কম নয়। যদিও সে কখনো লেখালেখি করে না, এমন কি তার কোন একাউন্ট নেই এই ব্লগে। কিন্তু গত ছয় বছর ধরে সে প্রতি দিন ঘুরে বেড়ান এই ব্লগ সাইটে। নানান লেখকদের নানান বিষয়ে লেখা পড়েন, পড়েন তাদের মন্তব্য, মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে যায় লেখকদের মাঝে, এর মাঝখানে আছে মডু বলে কোন এক দল। এরা অবস্থা বেশী হলে লেখককে সাময়িক নিষিদ্ধ করে রাখেন, মাঝে মাঝে তো এক্কেবারে ব্যান করে দেন। মজা লাগে এসব তার। এই প্রবাসে বসেও যেন সারা দেশের সব খবর, অগ্রগতি, জীবনাচার, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম সব বিষয়ে খোঁজ পাওয়া যায়। মহিলাটি মাঝে মাঝে ভাবে, আচ্ছে এই যে এত এত লেখক, এরা কি তার কথা কখনো জানবে? গত ছয় বছরে কত লেখক আসলো, চলে গেল, কিন্তু অজ্ঞাত অখ্যাত এক পাঠক হিসেবে সে কিন্তু রয়েই গেছে। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে সে জানছে, দেশে নাকি এই ব্লগকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদিও তার কোন সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু দেশের লেখকেরা লিখতে পারছে না। তারা না লিখলে সে পড়বে কাদের লেখা। আহারে প্রতিটি লেখকের জন্য তার খুব মায়া হচ্ছে, আল্লাহ্ তুমি সরকারকে সুবুদ্ধি দাও, এই সুন্দর লেখালেখির জগতটা যেন বন্ধ না করে দেয়।
============================
৭.
এবারে বইমেলায় চারটা বই বের হয়েছিল তার, দুটি উপন্যাস, একটি কবিতা সংকলন আর একটি প্রবন্ধ। এর মধ্যে তিনটি বই এর প্রথম সংস্করণ নাকি এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। মেলা এখনো শেষ হতে কয়েকদিন বাকী; প্রকাশক তাকে জানিয়েছে দু’এক দিনের মধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণ চলে আসবে বাজারে। ভাবতেও অবাক লাগে, খুব বেশী দিন নয়, দশ বছর আগে, ভার্সিটিতে পড়াকালীন বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেয়ে ব্লগে একাউন্ট খোলা, সেখান থেকে গল্প লিখতে লিখতে গত চার বছর ধরে সে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। প্রতি বছর বইমেলায় একাধিক বই বেরুচ্ছে। প্রকাশকেরা তার কাছে বই চেয়ে চেয়ে ফিরে যায়। নিজের কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে লেখা রেডি করতে হয়, তাই তিন চারটার বেশী বই দেয়া সম্ভব না এক বছরে। ভাবতে অবাক লাগে, এক সময় লেখালেখি করেই সারাদিন কেটে যেত। পড়ালেখার সময়টুকু বাদ দিলে সারাদিনই তো ব্লগে। দিনে দু তিনটা লেখাও পোস্ট করেছে। আর সেই লেখালেখির জেরেই আজ তার লেখাগুলো এত শানিত হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে শুনতে পাচ্ছে, সেই ব্লগ নাকি বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। যদিও বেশ কয়েক বছর আর ব্লগে যাওয়া হয় না। এখন টুকটাক যা লেখা প্রকাশ করে ফেসবুকে, তার ফলোয়ার লাখের ঘরে এখন। তাই আর ব্লগে যাওয়া হয় না, এমনকি তার একাউন্ট এর পাসওয়ার্ড পর্যন্ত ভুলে গেছে। কিন্তু নিউজটি পড়ার পর থেকে বুকের ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে, যেমনটা পুরাতন প্রেমিকার মৃত্যু খবর পেলে মানুষের খারাপ লাগে, অনেকটা সেরকম। এই ব্লগে লিখে লিখেই আজ তার মত কতগুলো তরুন তরুনী লেখক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। সব হারিয়ে এই প্ল্যাটফর্মটাই ছিল লেখক গড়ে তোলার তীর্থ হিসেবে। তাও যদি সরকার একটি ভুল সিদ্ধান্তে বন্ধ করে দেয়, তাহলে আর রইবে টা কি? ল্যাপটপ ওপেন করে লিখতে বসলো, তার লেখা সরকার পর্যন্ত পৌঁছবে কি না জানে না। তবুও আত্মার যে ঋণ এই প্লাটফর্মটার কাছে, তার কিছুটা দায় থেকেই যায়...
============================
৮.
মফস্বলের ছেলে, শহরে পড়তে এসে খুব বিপদে পড়েছে। শহুরে জীবনে খাপ খাওয়াতে পারে না। তাই তো দুই বছর কেটে গেল কলেজ জীবনের, আজও তার তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই। ক্লাস, টিউশন, নিজের পড়া এর বাইরে তার জীবনে একটাই অবসর জগত, তা হল ব্লগ জীবন। ব্লগ যেন তার কাছে এক তৃতীয় ভুবন, যার সাথে তার বাকী দুই ভুবন, সেই ফেলে আসা মফস্বল আর এই শহুরে জীবন; কোনটারই মিল নাই। বছর খানেক নীরব পাঠক হিসেবে কাটিয়ে দিয়ে এক বছর হল সে নিজের নামে একটা একাউন্ট খুলেছে। যদিও লিখে খুব কম, কিন্তু পড়ে খুব বেশী। আর পড়ার পর তার সুচিন্তিত মতামত জানাতে ভুল করে না। প্রথম দিকে কিছুটা জড়াতা থাকতো, কিন্তু সবাই খুব পজেটিভলি তাকে গ্রহণ করেছিল। ফলে খুব শীঘ্রই সবার সাথে খুব ভাব হয়ে গেল, যেন বহুদিনের পরিচিত মানুষগুলো। মাঝখানে মাস খানেক রোজার ছুটিতে বাড়ী গিয়েছিলাম, বাসায় গিয়ে নেট কানেকশন ছিল না, ফলে ব্লগে ঢুঁ মারতে পারে নাই। মূলত সে হোস্টেলে তার রুমমেটের ল্যাপটপ হতে লেখালেখি করে। মজার ব্যাপার মাসখানেক পর হোস্টেলে ফিরে যেদিন ব্লগে লগইন করলো, দেখে তাকে সবাই খুব খোঁজ করছে। এক আপু তো পুরো একটা পোস্ট লিখে ফেলেছে তাকে নিয়ে, সে গেল কোথায় হারিয়ে? এই হল পোস্টের মূল বক্তব্য। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তার মন ভাল নেই। কারণ, ব্লগটা নাকি সরকার বন্ধ করে দিবে। আহারে প্রিয় মানুষগুলোকে কিভাবে সে খুঁজে পাবে?
============================
৯.
প্রবাসে এসেছিল ছেলেটি পড়াশুনা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মানুষভাবে এক, আর হয় আরেক। বছরখানেক চেষ্টা করেছিল পড়াটা এগিয়ে নিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়ে উঠে নাই। এখন দুটি জব করে, একটি লিগ্যাল, আরেকটি ইলিগ্যাল। কারন, দশ লাখ টাকা খরচ করে এসেছে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। তাই যে কোন উপায়ে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ উঠিয়ে মাস শেষে কমপক্ষে হাজার বিশেক টাকা দেশে পাঠাতেই যে হয় তাকে। ইলিগ্যাল যে জবটি করে, সেটি খুব আরামের। একটা বিশাল এপার্টমেন্ট এর সিকিউরিটি হিসেবে। পুরোটা সময় একটা চেয়ারে বসে থাকা হয় মূলত। এই সময়টা সে পার করে দেয় ইউটিউবে নানান ভিডিও দেখে। এভাবেই একদিন কোন একটা ভিডিও থেকে খোঁজ পেল “সামহোয়্যারইন ব্লগ” এর। হাজার হাজার লেখার জীবন্ত এক জগত। পাঠক লেখা পড়ে জানিয়ে দিচ্ছে তার মতামত, লেখক সেগুলোর উত্তর দিচ্ছে। এই লেখা পড়ে কিভাবে যে সময় কেটে যায়। জবের ছয় ঘন্টায় খুব বেশী লেখা পড়তে পারে না। সারাদিনে যা লেখা পোস্ট হয়, তার অর্ধেক পড়তে পড়তে সময় বের হয়ে যায়। তাই এখন সে আগে নির্বাচিত আর অনুসারিত লেখকদের লেখা পড়ে নেয়। এরপর বাকী লেখা হতে যে কয়টা পারা যায়। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে ব্লগে দেখছে খুব লেখালেখি হচ্ছে; সরকার নাকি এই ব্লগ বন্ধ করে দিবে। শুনে খুব কষ্ট হল। সে মনে প্রানে চায়, দেশের সরকার যেন এরকমটা না করে। কোন সমস্যা থাকলে সরকার ব্লগের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান এর পথ বের করতেই পারে। আহারে! এই ইউরোপীয়দের মত আমরা কবে হতে পারবো? এখানেও সে দেখেছে প্রচুর ব্লগ আছে, ইংরেজীতে। সবাই কি স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা পর্যন্ত করছে কঠোরভাবে, কিন্তু কোন বাঁধা নিষেধ নেই এসবে। আমাদের দেশেও এমনটা হবে খুব শীঘ্রই, এই আশায় ছেলেটি বুক বাঁধে।
============================
১০.
ডিভোর্সের পর এতটা হেসেছে কি কখনো? মনে করতে পারছে না বছর ত্রিশের মেয়েটি। গত দেড় বছরে সে এত হাসে নাই। একটি লেখা সেই হাসির খোরাক, একটি রম্য লেখা, সেটা তো হাঁসিয়েছেই; এর সাথে সেই লেখার মন্তব্য প্রতিমন্তব্য পড়ে হাসতে হাসতে নিজের খাটেই সে গড়িয়ে পড়ছে। গত কিছুদিন ধরে এই ব্লগ নামক এক জগতে নিজেকে হারিয়ে দিয়েছে; ফলে অনেক দুঃখস্মৃতি ভুলে থাকতে পারছে। কিন্তু কথা বলে, অভাগা যেদিকে যায়, সেদিকেই নদী শুকিয়ে যায়। সেও তো এক অভাগী। নইলে মাত্র মাসখানেক হল সে এই জগতের খোঁজ পেয়েছিল; কিন্তু গতকাল একটা লেখায় দেখলো এই ব্লগও নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে ব্লগের কোন দোষ নেই, দোষ তার। সে এখানে এসেছে বলেই এই সর্বনাশ হয়েছে। আসলে সে একটা পোড়ামুখি, সর্বনাশী...
============================
হ্যাঁ, আজ ওদের সবার মন খারাপ। কারণ, প্রিয় সামু বন্ধ হয়ে যাবে, সরকারে একটি ভুল সিদ্ধান্তে। ওদের মত আরও হাজারো ব্লগার, পাঠকের এই প্রিয় আঙ্গিনা হারিয়ে ফেলার শংকায় আজ সবার মন খারাপ। মাননীয় সরকার বাহাদুর, করজোড় করে মিনতি করছি, এমন ভুলটি করবেন না। আমাদের শেষ ঠিকানাটি কেড়ে নিবেন না প্লিজ... ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৩৮