গাজীপুরের টঙ্গীতে টাম্পাকো প্যাকেজিং কারখানায় ব্রয়লার বিস্ফোরণের দুর্ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয় নিযুক্ত কারখানা পরিদর্শক এবং তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তাদের পরস্পর দোষারোপ এর কর্মকান্ড দেখে অবাক হয়েই এই লেখার অবতারনা। আমাদের দেশে রানা প্লাজা, নিমতলী ট্রাজেডি, তাজরিন ঘটনা বা গুলশানে জঙ্গী হামলা থেকে শুরু করে লঞ্চ বা বাস দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি হওয়ার পর শুরু হয় নানান তদন্ত কমিশন, বিশেষজ্ঞ মতামত, পারস্পরিক দোষারোপের খেলা। কিন্তু দোষ আসলেই কার? আসুন একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করি।
শুরু করি অনেক আগে দেখা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “ইত্যাদি”র একটি কৌতুকের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। একজন রোগী গেলেন ডাক্তারের কাছে, উনার সারা শরীরে ব্যাথা, যেখানে আঙ্গুল ছোঁয়ান ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠেন। ডাক্তার অবাক হলে এ আবার কেমন রোগ। এবার ডাক্তার সাহেব রোগীর শরীরের যেখানেই আঙ্গুল দিয়ে চাপ দেন, রোগী ব্যাথা পান না। শেষে উনি রোগী যে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়েছিল, সেই আঙ্গুলে চাপ দিতেই “উরি বাবারে, মরে গেলাম রে” বলে দে লাফ। আসল সমস্যা হল আঙ্গুলেই ব্যাথা।
উন্নত বিশ্বে শুধুমাত্র Problem Identification এর জন্য আলাদা Expertise Team আছে, আছে সংস্থা। বলা হয়ে থাকে, Problem Identification হল সমস্যা সমাধানের ষাট শতাংশ কাজ। নিখুঁতভাবে সঠিক সমস্যা চিহ্নিত করা গেলে, সমাধান খুবই সহজ। ম্যানেজমেন্ট সাইন্স স্টাডি করার সৌভাগ্যের কারনে অনেক কেস স্টাডি পড়েছিলাম এসব নিয়ে। নিচে দুটি উল্লেখ করছি মূল থিমটা বুঝার জন্য।
প্রথমটা হল এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এ। তখনো সেটা বিশ্বের উচ্চতম ভবন। তো সেই ভবনে আগত বেশীরভাগ দর্শনার্থী অভিযোগ বক্সে যে অভিযোগ জমা দিতে লাগল তা হল এটার লিফট তথা এলিভেটর এর শ্লথ গতি। কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের শরণাপন্ন হল এবং এলিভেটরের গতি প্রায় চল্লিশ শতাংশ বৃদ্ধি করা হল। কিন্তু লাভ হল না কোন, অভিযোগ রয়েই গেল। মজার ব্যাপার তখনকার সময়ে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন এলিভেটর লিফট। কর্তৃপক্ষ অবশেষে শরনাপন্ন হল Problem Identification Expertise Team এর। তারা সকল কিছু বিবেচনা করে যা সমস্যা চিহ্নিত করল তা হল, একশত তলার বেশী উঁচু এই ভবনে গ্রাউন্ড ফ্লোর হতে কেউ যদি ৫০ তলায়ও ওঠে, তবে অনেকটা সময় তাকে লিফটে কাটাতে হয়, কেননা বিভিন্ন ফ্লোরে এটা থামে। সমাধান? অনেক ভেবে সহজ সমাধান, লিফটের দেয়াল মিররযুক্ত করে দেয়া। কারন, হিউম্যান সাইকোলজি! মানুষ এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এ আসে নানান কাজে, আর এসকল কাজে যে অফিসে যাচ্ছে, সেখানে ঢোকার আগে সবাই একটু নিজেকে দেখে নিতে চায়, সাজসজ্জা বেশভূষা ঠিকঠাক আছে কি না। আর তা ছাড়া আয়না দেখলে একবারের জন্য নিজেকে দেখে নেয় না এমন মানুষ মেলা ভার। সেই থেকেই কিন্তু লিফটের দেয়ালগুলো মিরর কোটেড হয়ে থাকে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে সত্তর শতাংশ অভিযোগ কমে এসেছিল। খরচ? সেই লিফটের গতি বৃদ্ধিতে খরচ হওয়া মোট অর্থের এক শতাংশও না...
আমাদের দেশে আসলে সমস্যা কি? এটা আগে আইডেন্টিফাই করা উচিত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সমস্যা একটাই, মূলে। সেটা হল দায়িত্ব সচেতনতার অভাব এবং দায়ভার কাঁধে নেয়ার অনিচ্ছা এবং নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট সাইন্সের মূল একটা বাক্য হল, “Authority should be delegated, responsibility should not”। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে এর উল্টোটাই দেখছি প্রতিটি ক্ষেত্রে।
এবার আসুন করণীয় সম্পর্কে আরেকটি কেস স্টাডি’র কিয়দংশ জেনে নেই।
বিখ্যাত এক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি (সঙ্গত কারনে নাম উল্লেখ করলাম না)। তাদের তখনকার সময়ে সদ্য নামানো বহুল আলোচিত গাড়ীটি মাস ছয়েকের মধ্যেই গণহারে রিপেয়ার এন্ড মেইনটেনেন্স এর জন্য ফেরত আসতে লাগলো এবং সমস্যা সব কয়টার একই, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ী অল্পক্ষণেই ভেতরের বাতাস গরম হতে থাকে, শীতাতপ যন্ত্র ঠিকমত কাজ করে না। অনেক গবেষণা করেও যখন কিছু ধরা গেল না, তারা আশ্রয় নিল একটি চমৎকার ম্যানেজমেন্ট সাইন্স টেকনিকের, নাম “Process Reengineering”। আমি আমার সুদীর্ঘ টিউশনি লাইফে ম্যাথ পড়াতাম, তখন স্টুডেন্টদের এই টেকনিক আয়ত্ত করাতাম। কোন একটা অংক শেষের দিকে এসে যদি দেখা যায় মিলছে না, তবে এখানে ওখানে ভুল না খুঁজে একেবারে শুরু থেকে লাইন বাই লাইন চেক করে আসা প্রথমবারেই। এতে সময় বাঁচে এবং সমাধানও সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ার একটি সাইন্টিফিক প্রসেস হল এই ম্যানেজমেন্ট টেকনিক “Process Reengineering”। তো যেখানে ছিলাম, সেই “Process Reengineering” এপ্লাই করে আবিষ্কৃত হল, গাড়ীর পুরো বডি জুড়ে শতাধিক স্ক্রু ব্যবহার করা হয়েছিল নানান অংশ সমন্বয় করতে। আর সেই স্ক্রু লাগানোর জন্য যে ছিদ্র করা হয়েছিল, তা করা হয়েছিল একটি অটোমেটেড ড্রিলিং মেশিন দিয়ে। আর সেই ড্রিলিং মেশিনের পুরুত্ব আর স্ক্রুর পুরুত্ব একছিল না। অনেকদিন ব্যবহারে ড্রিলিং মেশিনে সেই ত্রুটি হয়েছিল, যা ধরা পরে নাই। ধরা পড়ল যখন পুরো গাড়ী তৈরীর প্রক্রিয়াটি রিভিউ করা হল এই “Process Reengineering” প্রক্রিয়ায়। অবশ্য এর মাঝে কোম্পানিটির ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক অনেক টাকা।
গতকাল মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল একটা ভাল কথা বলেছেন, অনেকটা এরকম, “আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না আনলে, দুই লেন – চার লেন – উড়াল সেতু – মেট্রো রেল কোন কিছু দিয়েই যানজট আর দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। আসলেই তাই, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একে অপরকে দোষারোপ আর কমিটি গঠন, গোলটেবিল বৈঠক, বিশেষজ্ঞ মতামত এসব দিয়ে কি হবে? দরকার শুধু দুটো জিনিষঃ
১) দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির দায় স্বীকার করা।
২) কি কারনে দুর্ঘটনা’র কারনটি Exist করছিল তা এক্সপার্ট হেল্প নিয়ে রিপোর্ট আকারে জমা দেয়া।
আমি আর পদত্যাগ বা দোষীর শাস্তি এসব নিয়ে বললাম না, কারন কে বলবে, “রাজা তুই ন্যাংটা!”?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৫০