কেরালা, স্থানীয়রা একে বলে, “গডস ওউন কান্ট্রি”। গত বছরের অক্টোবর মাসে যখন কাশ্মীর-সিমলা-মানালি ট্রিপের জন্য ইন্ডিয়ান ভিসা নিলাম, তখনই প্ল্যান ছিল ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেরালা ট্রিপ দিব। আর সেই ভাবনা থেকেই সেই সময়ই কেরালা ইভেন্ট ডিক্লেয়ার করি। কিন্তু মজার ব্যাপার ভিসা পাওয়ার পর আমি পাসপোর্টে আর চেয়ে দেখি নাই, আমার ভিসাখানি কি দিয়াছে । যাই হোক, কাশ্মীর-সিমলা-মানালি রুটে ১৬ দিনের ভ্রমণ শেষে যখন দিল্লী এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন করি, তখন আবিষ্কৃত হল আমার ভিসা “সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা”!!! নিজেকে বেকুব মনে হল, ভিসা পেলাম মাসখানেক আগে, এরপর দুই সপ্তাহ ভারতে বেড়ালাম, একবারও চোখে পড়ে নাই আমার সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা... এহেন দুঃসংবাদ শোনার পর প্লেনে বসেই ভাবা শুরু করলাম, কেরালা ট্রিপের কি হবে?
যাই হোক, দেশে ফিরে আবার ভিসার জন্য আবেদন করলাম, এবার পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে সাথে সাথে দেখলাম ভিসা কি দিল? ওমা!!! এবারও সিঙ্গেল এন্ট্রি... অথচ আমার কত প্ল্যান, কই কই যাব, মাল্টিপল ভিসা নিয়ে। কি আর করা, ভিসা তো হল, এখন ট্যুর মেম্বার যোগাড় করা। প্রতিবারই আমায় এই ঝামেলায় পড়তে হয় কেন? আগের ট্যুরের ভ্রমণ সঙ্গী মিতা রায় এবারও আগে থেকেই রাজী ছিল। কিন্তু দুইজনে তো টিম হবে না, কমপক্ষে চারজন দরকার। এখন খোঁজ কর চারজনের। কিন্তু এর মাঝখানে মিতা জানালো তার অফিসের ইয়ার এন্ডিং, ব্যক্তিগত নানান ঝামেলার কারনে ট্যুরের পূর্ব শিডিউল অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সে যেতে পারবে না। কি করা, চারজনের জায়গায় দুইজন থেকে এখন আমি একা হয়ে যাব? নাহ, একা ভ্রমণ করলে আমার প্ল্যান মত ঘোরাঘুরি করা সম্ভব না। তাই মিতার সুবিধা অনুযায়ী ট্যুর পিছিয়ে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে করা হল। এর ফাঁকে খোঁজ চলল দুইজন ভ্রমণ সঙ্গী’র।
জানুয়ারির শেষের দিকে মিতা রায় জানাল, তার অফিসের এক কলিগ, এই ট্যুরে যেতে আগ্রহী, এরপর নিয়মিত সেখানে নক করে যাওয়া। এভাবে উনি রাজী হলেন। কিন্তু আরও একজন চাই, নইলে জনপ্রতি খরচ প্রায় ত্রিশ শতাংশ বেড়ে যাবে। এমনিতেই লম্বা ট্যুর, বাজেট অনেক বেশী, তার উপর আরেকজন না পেলে ট্যুর ক্যান্সেল করতে হবে। এদিকে এক বন্ধু, ভারতের ভিসা ছিল একবছরের, ভিসা শেষ হতে চলল, সে ফোণ দিল, বলল, কলকাতা থেকে চল ঘুরে আসি। এবার তার পেছনে আঠার মত লেগে থাকা। দীর্ঘ একমাসের সাধনায়, ভদ্রলোককে অনেকটা জোর করে রাজী করালাম। এই মুহুর্তে টাকা নাই তার হাতে, তাকে লোণ এর ব্যবস্থা করে দিলাম, তবুও বাবা তুই চল আমাদের সাথে।
এবার দল ফাইনাল, এর মাঝেই আমার ট্যুর প্ল্যান ফাইনাল করা হয়েছে। কেরালা লোকাল এজেন্ট এর সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ মিস লিলা’র সাথে শ’দুয়েক মেইল চালাচালি’র পর আমাদের শিডিউল ফাইনাল হল কেরালা ট্যুরের। প্ল্যান অনেকটা এরকমঃ আমরা ঢাকা থেকে শ্যামলী পরিবহণের ট্রানজিট বাসে রাতে রওনা হব কলকাতার উদ্দেশ্যে, পরদিন কলকাতা পৌঁছে সেখান থেকে স্পাইস জেট এর ইকোনমি ক্লাসে সরাসরি সেদিনই কেরালা’র কোচিন গিয়ে পৌঁছব রাতের বেলা। (বিলাসিতা নয়, চতুর্থ ভ্রমণসঙ্গী খুঁজে বের করে হাতে সময় ছিল সপ্তাহখানেক, তখন কোচিন এর কোন ট্রেন টিকেট পাওয়া যায় নাই। একটা উপায় ছিল, নন এসি ট্রেনে দীর্ঘ তিন দিনের যাত্রা, দুইবারে, কলকাতা-চেন্নাই এবং তারপর চেন্নাই-কোচিন। ফলে মিস লিলা’র পরামর্শে আর্থিক দন্ডি দিয়ে হলেও আমরা এয়ারে ট্রাভেল করতে বাধ্য হই। এছাড়া সময় আমাদের ট্যুর এর একটা বিশাল ফ্যাক্টর ছিল)।
কিন্তু পরবর্তীতে ফ্লাইট মিস করার রিস্ক এভয়ড করতে আমাদের ট্যুরে কলকাতায় একরাত থাকার সিদ্ধান্ত হল। ফলে ট্যুর শিডিউল হল এরকমঃ প্রথম রাত কলকাতা, দ্বিতীয় রাত কোচিন, তৃতীয় এবং চতুর্থ রাত মুন্নার, পঞ্চম রাত থিক্কাদি, ষষ্ঠ রাত কুমারোকাম, সপ্তম রাত আলিপ্পে, অষ্টম রাত কন্যাকুমারী (পথে কোভালাম বীচ দেখে যাওয়া), নবম রাত ফের কোচিন। এতটুকু ছিল কেরালা ট্যুরের প্রোগ্রাম শিডিউল। এরপর সিদ্ধান্ত হল কেরালা থেকে ট্রেনে করে চলে যাব গোয়া, নবম রাত ট্রেনে, দশম এবং একাদশ রাত গোয়া (গোয়ায় তিনদিন-দুই রাত) থেকে দ্বাদশতম রাতে বাসে করে গোয়া হতে মুম্বাই। ত্রয়োদশতম রাত মুম্বাই (মুম্বাই দুইদিন-একরাত) থেকে চতুর্দশতম রাতে মুম্বাই এয়ারপোর্ট হতে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পঞ্চদশতম রাতের মধ্যে ঢাকা ফেরা। আমাদের দুজন ভ্রমণ সঙ্গীর ছিল নীল পাসপোর্ট, ১৬ দিনের ছুটি নিয়ে জিও নেয়া। ফলে এই শিডিউল কোনভাবেই মিস করা যাবে না।
পরবর্তীতে এই শিডিউল মেইনটেইন করতে গিয়ে টানা চারদিন ভোররাত পাঁচটায় হোটেল হতে চেক আউট করতে হয়েছিল, সারা রাত মুম্বাই এয়ারপোর্টে কাটিয়ে সকাল ছয়টার ফ্লাইট ধরতে হয়েছিল। সামনের পর্বগুলোতে এসব গল্প করা যাবে। এরপর আর কি? সেই আগের মত বাস, ট্রেন আর প্লেনের টিকেট করার প্যারা; ঢাকা থেকে বুকিং মানি পাঠাতে সেই আগের মত দৌড়ঝাঁপ। তবে এবার এইখাতে খরচ কিছুটা কম হয়েছে, চারজনের প্রায় একলাখ রুপীর প্যাকেজে এডভান্স পাঠিয়েছিলাম মাত্র পাঁচ হাজার রুপী! আমার সমস্যার কথা শুনে মিস লিলা এই ফেভারটুকু করেছিলেন। নইলে নিয়মানুযায়ী আমাকে প্রায় ত্রিশ হাজার রুপি পাঠাতে হত, যেখানে মিনিমাম পনের হাজার টাকা গচ্চা যেত অহেতুক। যাই হোক, সকল কাহিনী শেষ করে, সকল টিকেট-হোটেল এর কাজ শেষ করে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম যাত্রার দিনের। অপেক্ষার পালা খুব খারাপ জিনিষ, খুব খারাপ, খুব... (চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৩৮