আমি মাঝে মাঝে ভাবি, কোন শালায় এই মোবাইল ফোন আবিস্কার করল। একটা কথা বলার যন্ত্র কেন সারাক্ষণ ভূতের মত ঘাড়ে চেপে বসে থেকে ছায়াসঙ্গীর মত ঘুরে বেড়াবে। কি ঘুমে, কি জাগরণে; আহারে কিংবা বাহারে, পাবলিক প্লেসে কিংবা একান্ত সময়ে এই বেরসিক যখন তখন বেজে উঠে জানান দেয় যেন, “আমি আছি বড় ভাই, তোমার সাথেই আছি”। তার উপর উৎপাত এই স্মার্টফোনগুলো, অশীতিপর বৃদ্ধের মত যখন তখন অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই যেমন মহারাণীর দেয়া স্মার্টফোনটি গতকাল রাত হতে অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গেছে। ব্যাটাকে কোন মতেই ঘুম থেকে জাগাতে পারলাম না।
মোবাইল যখন ছিল না, সেই ল্যান্ড ফোনের যুগই বুঝি ভাল ছিল। ল্যান্ডফোনে কেউ ফোন করে কাউকে চাইলে অতি সহজেই বলে দেয়া যেত, ‘উনি তো বাসায় নেই, কখন ফিরবেন বলে যান নাই’। তখন পাশে বসে থাকা উনি মুচকি হাসছেন। আর এখন সারাক্ষণ মোবাইল ফোনকে অন রাখতে হয়ে, সময়ে সময়ে মনে করে চার্জ দিতে হয়, যেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অসুস্থ কোন রোগী, এই মোবাইলটা। কোন কারণে যদি, মোবাইল কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে সেই সময়েই বুঝি সবার কল করার হিড়িক পড়ে যায়। যে মানুষটি হয়ত বছরে একদিন কোন খবর নেয় না, সেও কোন কাজে কল করে মোবাইল বন্ধ পেলে নাকি টেনশনে পড়ে যায়। তার উপর যদি মহারাণী কল করে মোবাইল বন্ধ পায়! ও মোর খোদারে, তুমি মোরে রক্ষা কর।
আমি ঘুম থেকে উঠে মোড়ের দোকানে এককাপ চা আর একটা অলটাইম ব্রেড গলধকরন করে ছুটলাম ইস্টার্ন প্লাজা’র দিকে। অতিদ্রুত মোবাইলটা ঠিক করা দরকার, গতকাল রাতে মহারাণীর সাথে কথা বলার মাঝখানে মোবাইলটা অফ হয়ে গেল। আজ পহেলা ফাল্গুন, রাস্তায় বাসন্তী রঙের ছড়াছড়ি। আগে শুধু মেয়েদের দেখা যেত বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে মাথায় গাঁদা ফুলের মালা গুঁজে সারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ দেখি গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী পড়ে, হাতে কবজিতে গাঁদা ফুলের মালা পেঁচিয়ে ছেলে ছোকরা’র দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসব নাকি কাঁদব? মহারাণী চাচ্ছিল আমিও আজ এরকম বেশভূষায় ওর সাথে ঘুরে বেড়াই। গতবছর এই গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবীর চক্করে কি বিপদেই না পড়ছিলাম আরেকটু হলে... নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের ( আহা রঙ, আহারে জীবন (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০৩) দ্রষ্টব্য)। তাই এবার আমি সাফ না করে দিলাম, এইসব আল্গুন-ফাল্গুন উৎসবে আমি নাই। এটা বলতেই শুরু হলে মহারাণীর কথার গুলিবর্ষণ। আর সেই গুলিবর্ষণের তেজেই কি না কে জানে আমার স্মার্ট ফোন ভেরি আনস্মার্টলি বন্ধ হয়ে গেছে। মহারাণীর মেজাজ নিশ্চয়ই সেইরকম গরম ছিল, এখনো আছে কি না বলতে পারছি না। মনে হয় নাহ, মহারাণীর মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে বিপদ আরও বেশী থাকে; সে মনের মাঝে রাগটা সযত্নে পুষে রাখে, সময় সুযোগ মত সেই রাগের ঝাল মেটায় আমার উপর।
শাহবাগ হতে কাঁটাবনের দিকে যেতে যেতে দেখি মহারাণী সদলবলে আজিজ সুপার মার্কেট হতে বের হচ্ছে। বাসন্তী রঙের শাড়ি, কপালে ইয়া বড় একটা লাল টিপ, মাথায় গাঁদা ফুলের মালা। দূর থেকে দেখেই আমার বুকের বাম পাশটায় একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হল। রাস্তার এপার থেকে আমি হাত নাড়লাম, মহারাণী দেখেও না দেখার ভান করে সবার সাথে শাহবাগের দিকে হাঁটা ধরল। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে আমি তাদের দলের কাছে চলে এলাম। মহারাণী ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
‘হায়... গতকাল রাতে মোবাইলটা হুট করে বন্ধ হয়ে গেল’ আমি মহারাণী’র পাশে গিয়ে বললাম।
‘এক্সকিউজ মি! আমি কি আপনাকে চিনি?’
‘মানে কি?’
‘মানে কি মানে? রাস্তাঘাটে মেয়ে মানুষ দেখলেই ফ্লার্ট করতে মন চায়?’ মহারাণী রাগী রাগী কণ্ঠে বলল।
‘মহারাণী, বেশী বেশী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু’ আমি একটু জোরে বলে উঠলাম।
‘এই যে মিস্টার, আপনি কেন আমাকে বিরক্ত করছেন?’
‘বললাম তো, মোবাইল হুট করে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যাচ্ছি ইস্টার্ন প্লাজা, সেটটা ঠিক করাতে।’
‘তো যান না, আমাকে কেন বিরক্ত করছেন? আমি এতো সস্তা দরের মেয়ে নই, রাস্তাঘাটে যে কারো সাথে কথা বলব।’ চোখমুখ গরম করে মহারাণী আমাকে কথাগুলো বলে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা শুরু করল।
‘মহারাণী, শোন...’ আমি কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে একটা ছেলে আমার শার্টের কলার চেপে ধরল।
‘এই ব্যাটা, রাস্তাঘাটে মেয়েছেলে দেখলেই টিজিং শুরু হয়ে যায়।’ আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল ছেলেটি, সাথে আরও চার-পাঁচ’জন ছেলেপেলে রয়েছে, কেমন মাস্তান মাস্তান চেহারা। নির্ঘাত ঝামেলা পাকাবে এবার।
‘দেখুন ভাই, উনি আমার পূর্ব পরিচিতা। বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞাসা করে দেখুন উনাকে’
‘সেই কখন থেকে মহিলাকে বিরক্ত করছিস, সবই তো দেখলাম। উনি তোকে চেনেন না, আর তুই বলিস মহারাণী? আজ তোকে মহারাজা বানাবো, এই গলিতে ঢোক’ বলে আমাকে টেনে হিঁচড়ে আজিজ সুপার মার্কেটের পাশের গলিতে নিয়ে যেতে থাকল।
‘এই যে শুনুন...’ পেছন থেকে মহারাণী’র কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
‘উনি আমার পরিচিত, বন্ধু মানুষ। রাগ করে বলেছিলাম যে, চিনি না, ছেড়ে দিন উনাকে। আর রাস্তাঘাটে মাস্তানি করে বেড়াচ্ছেন? আপনাদের কাছে কি আমি বলেছি, আমাকে সাহায্য করুন? গায়ে পড়ে এসে ঝগড়া করতে মজা লাগে বুঝি’ মহারাণী অনেকটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে একটানা কথাগুলো বলল। ওর সাথে আরও পাঁচ-সাতটি ছেলেমেয়েও দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার কলার ছেড়ে দিতেই আমি গলি থেকে বাহিরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
‘আরে যান যান, রাস্তাঘাটে নাটক করে বেড়ালে মানুষ কেম্নে বুঝবে সত্য না মিথ্যা।’ কথাগুলো মহারাণীকে উদ্দেশ্য করে বলা। পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো, ‘যে না চেহারা, নাম রাখছে পেয়ারা। আইছে আমার মহারাণী... শালার পুত’। সাথের ছেলেপেলে সব হো হো করে সজোরে হেঁসে উঠলো।
আমি গলি থেকে বের হয়ে সোজা উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম। মোবাইল ঠিক করানোর কথা আর মাথায় রইল না। মেজাজ ভীষণ চটে গেছে, এখন অতিদ্রুত রুমে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে আমি কখনোই পড়ি নাই। মহারাণী’র বাড়াবাড়ি রকমের ঢঙ্গের কারণে আজ অনেক কিছুই হতে পারতো। এতোগুলো মানুষের সামনে হেনস্তা হয়ে আমার মাথা হেট হয়ে গেল। মাথা নিচু করে আমি হাঁটতে লাগলাম। শাহবাগ হয়ে চারুকলার লাগোয়া ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি, দেখি লাল-হলুদ কাঁচের চুড়িতে ভরা একটা শঙ্খের ন্যায় একটা হাত আমার হাত ধরল। মুখ তুলে দেখি মহারাণী, আমার হাত ধরে মাথা নিচু করে হাঁটছে। আমার মাথা কাজ করছে না, খুব ইচ্ছে হল কষে একটা চড় লাগাই, কিন্তু মহারাণীর মুখের দিকে তাকাতেই সব রাগ যেন উবে গেল। করুণ চোখে যেন বলছে, ‘প্লিজ, সরি, সরি, সরি’। আমি কিছু না বলে হাঁটতে লাগলাম।
‘বাববাহ, অনেক রাগ?’
‘জানি না।’ আমি বিরক্তমাখা কণ্ঠে বললাম।
‘প্লিজ, মাফ করে দাও’
‘ঢং করবে না প্লিজ, ভাললাগছে না।’ আমি সত্যি বিরক্ত হচ্ছিলাম।
‘বিশ্বাস কর, আমি টের পাই নাই যে, ছেলেগুলো আমাদের ফলো করছে।’
‘আমারই ভুল হয়েছে, রাস্তা পার হয়ে তোমার সাথে দেখা করতে যাওয়া।’ বলে আমি হনহন করে হাঁটা শুরু করলাম। মহারাণী দৌড়ে আমার রাস্তা আটকে বলল, ‘দাঁড়াও বলছি, নাহলে কিন্তু আবার সিনক্রেয়েট করে গণধোলাই খাওয়াব...’ হাসি হাসি মুখে কথাটা বলেই মহারাণী বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে। জিহবা কামড় দিয়ে বলল, ‘সরি, এই যে কানে ধরে বলছি, সরি... সরি... সরি!!!’ সত্যি সত্যি মহারাণী দুইহাতে কান ধরল।
‘ঢং বন্ধ কর, যেখানে যাচ্ছিলে বন্ধুদের নিয়ে সেখানে যাও। আমার কিছু ভাল লাগছে না।’
‘আমাকেও না?’ মুখ গম্ভীর করে মহারাণী জিজ্ঞাসা করল।
‘আমি কি তা বলেছি?’
‘আচ্ছা কালকের প্ল্যান কি?’
‘কোন প্ল্যান নাই?’
‘বিশ্ব ভালবাসা দিবসে কোন প্ল্যান থাকবে না?’ মহারাণী আমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে।
‘না, আমি কোন দিবসে বিশ্বাসী না।’
‘তবে কি রাত্রিতে বিশ্বাসী?’
‘কোন কিছুতেই বিশ্বাসী না, সর, আমায় যেতে দাও, বাসায় যাব।’
‘কালকে তোমার জন্য স্পেশাল গিফট থাকবে, ভেবে দেখ, প্ল্যান করে ফেল।’ মহারাণীর চেহারায় দুষ্ট হাসি খেলা করছে।
‘কোন গিফট লাগবে না, আমি যার তার কাছ থেকে গিফট নেই না।’ আমি গম্ভীর স্বরে বললাম।
'ভেবে বল, যা চাইবে, তাই পাইবে টাইপ অফার...' মহারাণী'র চোখেমুখে ফাজলামি খেলা করছে।
'এতো ভাবাভাবি'র সময় নাই।'
‘চাইলে, লিটনের ফ্ল্যাটেও বেড়াতে নিয়ে যেতে পার।’ মহারাণী কপট গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল।
‘কোন লিটন?...’ বলেই আমি বুঝলাম মহারাণী কি বলেছে। ফাজিল মেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে আবার। রাগবো না কাঁদবো? খোদা কেন আমি এই মেয়ের প্রেমে পড়েছি, শুধু প্রেমে পড়িনি, উথাল পাথাল প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।
‘আমি কোন লিটন’কে চিনি না।’
‘থাক চিনতে হবে না। শোন আজকের মধ্যে মোবাইলটা ঠিক করাও। আর কাল ঠিক দশটায় বইমেলার নজরুল চত্বরে থাকবে।’
‘না থাকব না।’ আমি কপট অভিমান দেখিয়ে বললাম।
‘হইছে, আর রাগ দেখাতে হবে না। রাগটাও ঠিক মত দেখাতে শিখলে না’
‘তুমি শিখিয়ে দিলেই তো পার।’
‘আর কত শেখাবো? মাসে কয়বার রাগ করি, তা দেখেও কিছু শিখলা না।’
‘আচ্ছা আমি যাই...’
‘কোথায়?’
‘মোবাইলটা ঠিক করতে দিয়ে আসি।’
‘আচ্ছা যাও...’ বলে মহারাণী কেমন ঘোরলাগা মায়াময় চাহনি নিয়ে আমার দিকে চাইলো। সেই চাহনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে হয়। আমি হাঁটা শুরু করলাম। পেছন হতে মহারাণী বলে উঠল, ‘অ্যাই লেবু...’। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও কোন লেবুওয়ালা নেই। নিমিষেই বুঝলাম, ফাজিল মেয়ে মজা করছে, সাথে মনের ভালবাসা জানিয়ে দিল। মহারাণী'র এই বাসন্তী ভালবাসায় হৃদয়টা অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেল।, হুট করেই মন ভাল হয়ে গেল। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়ায় আগুণ লেগেছে, তার ওপারে নীল আকাশ। আর বুকের মাঝে মহারাণী।
মহারাণী'র কেচ্ছা সিরিজের আগের গল্পসকলঃ
মহারাণী'র স্মার্টফোন (মহারাণী'র কেচ্ছা - ০৬)
মহারাণী'র বৃষ্টি বিলাস... অতঃপর পানিবন্দী মহারাণী (মহারাণী'র কেচ্ছা - ০৫)
অর্থহীন অভিমান (মহারাণীর কেচ্ছা - ০৪)
আহা রঙ, আহারে জীবন (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০৩)
ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে... (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০২)
মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৫২