ফেসবুক বন্ধ হয়ে যে দেশে এত বড় বিপর্যয় ডেকে আনছে তা কি আর আমার জানা ছিল? এই ফেস আর বুকের ব্যাপারে আমার কখনো কোন আগ্রহই ছিল না, সরাসরি মানুষের সাথে যোগাযোগ আর কথোপকথন, ভালোমন্দের খোঁজ খবর নেয়ার বিকল্প হিসেবে এই ফেস আর বুকের ব্যবহার আমার মোটেও পছন্দের নয়। কিন্তু মহারাণী‘র পাল্লায় পড়ে আমাকেও এই ফেসবুকে একাউণ্ট খুলতে হয়েছে, একাউণ্টের নাম মহারাণী সিলেক্ট করছে, “অকর্মণ্য”। চরম অপমানজনক এই নাম চেঞ্জ করতে গিয়ে শুনি মাস কয়েকের আগে নাকি পরিবর্তন করা সম্ভব না! তবুও বাঁচা, ফেসবুকে মহারাণী ছাড়া তেমন কোন পরিচিত কেউ ফ্রেন্ড নাই। আর আমি ফেসবুক ইউজও করি কম। মহারাণীর ছবি দেখা (মহারাণী জানে না ) আর মাঝে মাঝে মেসেজে হুকুম পাওয়া (মহারাণী'র) ছাড়া আর কোন ইউজ নাই। ওহ ভালো কথা, আমি এখন স্মার্ট হয়েছি, মানে স্মার্ট ফোন ইউজ করি; মহারাণী গিফট করছে। কিন্তু এই স্মার্টফোন আর ফেসবুক যে আমায় এমন ঝামেলায় ফেলবে তা কি আর আগে জানতাম?
ঘটনার শুরু দিন তিনেক আগে হলেও আমি অবগত হলাম আজ, এইমাত্র। সকাল সকাল মধুর ক্যান্টিনে ঢুকলাম আয়েশ করে চা খাব বলে। সবেমাত্র চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়েছি, অমনি অগ্নিমূর্তি বেশে মহারাণী সম্মুখে হাজির। আমি হাসিমুখে কিছুটা আহ্লাদী ঢঙ্গে বললাম,
“সুপ্রভাত রানী সাহেবা”
ব্যস, কম্ম সাবার। শুরু হল মহারাণী’র বাক্যবাণ। “রানী সাহেবা” বলে সম্বোধন করার অপরাধ হয়ে শেষ হল এই ফেসবুকে এসে। মহাভারত শেষে সারাংশ যা বোধগম্য হল তা হল, মহারাণী আমায় দিন তিনেক আগে জরুরী কাজে তলব করেছিলেন ফেসবুকে মেসেজ করে। আমি হাজিরা দিতে পারি নাই, আমার কোন দায়িত্বজ্ঞান নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং মহারাণী’র স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে আমার সাথে সম্পর্ক শেষ বলে রুল জারি। আমি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। মহারাণীর রাগের স্টক শেষ হওয়ার পর আমি বললাম,
‘আই অ্যাম সরি, কিন্তু আমি তোমার মেসেজ পাই নাই’
‘ওঃ তাই নাকি?’
‘বিশ্বাস না হলে চেক করে দেখ’ বলে স্মার্টফোনটা এগিয়ে দিলাম মহারাণীর দিকে। ও হাতে নিয়ে কি দেখল, কে জানে; কিন্তু আবারও ক্রোধ খেলা করল তার মুখে। আমার দিকে রাগত দৃষ্টি হেনে বলল,
‘তুমি জানো না, সরকার ফেসবুক বন্ধ করে রাখছে?’
আমি অবাক হলাম, আবার খুশীও হলাম, ঝামেলার এই ফেসবুক বন্ধ করে সরকার একটা কাজের কাজ করছে; আমাকেও যন্ত্রণার হাত থেকে বাচাইছে। আমি সব জানি এমন ভান করে বললাম,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তো। সেই কারণেই তোমার মেসেজ পাইনি, এটাই তোমাকে এতক্ষণ বলতে চাচ্ছিলাম’
‘ফেসবুক বন্ধের খবর রাখো, আর প্রক্সি দিয়া সবাই যে ফেবুতে নিয়মিত ঢুঁ মারছে সেই খবর রাখো না?’
‘প্রক্সি? না মানে...’ আমি বুঝার চেষ্টা করছি এই প্রক্সি ব্যাপারটা কি? এক্সামে প্রক্সি, ক্লাস এটেন্ডেন্সে প্রক্সি এসব শুনেছি, নিজেও অনেক দিয়েছি, বাট ফেসবুকের প্রক্সি দেয় কেম্নে ভেবে পাচ্ছি না।
‘আসলে হইছে কি জানপাখিটা...’
‘এই চুপ, জানপাখী? এই আমি কি পাখী? আমার ডানা আছে? গাছের ডালে বাসা? রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ে? তাই না? মেসেজের পর মেসেজ, প্রয়োজনের সময় উনার দেখা নাই, এখন আসছে ভালবাসার রস নিয়ে’
‘তুমি একটা কল করলেই তো পারতা...’
‘কেন কল করব? সারা দুনিয়া এখন চলে অনলাইন চ্যাটে, আর উনি আছেন সেই ফোনকলের যুগে’
যুগ কবে পাল্টে গেল বুঝলাম না? সপ্তাহখানেক আগেও মহারাণীর সাথে দীর্ঘক্ষণ মোবাইলে কথা হয়েছে। হঠাৎ করে কি হল কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে অনেক যুগ ঘুমিয়ে থাকার পর ঘুম থেকে উঠে দেখি যুগ পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে সমাজ সভ্যতা।
‘আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে, এখন বল কি বলার আছে?’
‘কিছু বলার নাই, তোমার সাথে বলাবলি শেষ। তুমি তোমার পথ ধর, আমি আমার পথ’
‘মানে কি? এইসব কোথাকার স্মার্টফোন, ফেসবুক, চ্যাট-ভ্যাট ঘোড়ার ডিমের কারনে সব শেষ!’
‘হ্যাঁ সব শেষ। কোন সমস্যা?’
‘বুঝছ, তোমার এসব আর ভাল্লাগে না। আমি আনস্মার্ট, আমার ফোনও আনস্মার্টই থাকবে, বুঝছ? ওকে, এই নাও তোমার স্মার্টফোন,
থাকো তোমার ফেসবুক আর চ্যাট নিয়ে। আসসালামুয়ালাইকুম, আল্লাহ হাফেজ' বলে জোরে টেবিলের উপর মহারাণী’র দেয়া স্মার্টফোনখানি আছড়ে ফেলে আমি মধুর ক্যান্টিন হতে বের হয়ে কার্জন হলের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। মাথা গরম হয়ে আছে, কপালের দুপাশের রগগুলো দপদপ করে লাফাচ্ছে। শহীদুল্লাহ হলের সামনের পুকুরের ঘাটে ঘণ্টাখানেক শুয়ে থাকতে হবে।
ঘণ্টাখানেক পর
মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে, মহারাণী’র সাথে এমন রাগ দেখিয়ে চলে আসা উচিত হয় নাই। ওকে সরি বলা দরকার, ওর রাগ ভাঙ্গাতে খবর আছে। ফোন দিব সেই উপায়ও নাই, আমার সিম তো ঐ স্মার্টফোনে। আর সিম থাকলেই বা কি? মহারাণী এখন কিছুতেই আমার ফোন ধরবে না। হঠাৎ মনে হল স্মার্টফোনটা থাকলে চ্যাটবক্সে মেসেজ দিয়ে সরি বলা যেত, ফেসবুকে মজার মজার সরি লেখা কার্টুন আছে, ইমোটিন না নিকোটিন কি জানি ছাই বলে... সেগুলো পাঠিয়ে রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করা যেত। কিন্তু স্মার্টফোন তো রাগ দেখিয়ে মহারাণী'কে ফেরত দিয়ে এসেছি; আছাড়ে ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে গেল কি না কে জানে? ভয়াবহ রকমে একটা স্মার্টফোনের প্রয়োজন অনুভব করতে লাগলাম সাথে মহারাণী’র সান্নিধ্য।
মহারাণী'র কেচ্ছা সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
মহারাণী'র বৃষ্টি বিলাস... অতঃপর পানিবন্দী মহারাণী (মহারাণী'র কেচ্ছা - ০৫)
অর্থহীন অভিমান (মহারাণীর কেচ্ছা - ০৪)
আহা রঙ, আহারে জীবন (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০৩)
ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে... (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০২)
মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৪