কয়েকদিনের অসহ্য গরমের পর গত দুইদিন ধরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে, চারিধারে এক শীতল অনুভব অনুভূত হচ্ছে। এই বৃষ্টির কল্যাণেই কি না জানি না, গত দুইদিন যাবত ঘুম ভাল হচ্ছে। কোন ঘুমের ঔষধের সাহায্য ছাড়াই চমৎকার ঘুম হচ্ছে। রাতে একটু আগে ঘুমিয়ে গেলেও বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠি, বেশ আরামে আছি। কিন্তু আমার আরাম যেন পছন্দ হল না মহারাণীর, তাই এই সাত সকালে তার ফোন, মোবাইলের কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। বেশ রোমান্টিক একটা রিংটোন ছিল, মহারাণীর বক্র কটাক্ষে বিরক্ত হয়ে সেটা পাল্টে এলার্ম টাইপের একটা রিংটোন সেট করেছিলাম। সেই কর্কশ শব্দে এই সাত সকালে মনে হল মোবাইলটা আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলি। কিন্তু মাত্রই কয়েকদিন আগে বড় আপা ইতালি থেকে এই সেটটা আমাকে পাঠিয়েছে, এতো দামী সেট, আছাড় দিতে পারছি না। এর চাইতে আগের সেটই ভাল ছিল, যখন তখন ইচ্ছা আছাড় দেয়া যেত, আছাড় দিয়ে মনটা একটু শান্ত হত।
রাজ্যের আলস্য নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম।
‘হ্যালো?’
‘কি, এখন মাত্র ঘুম থেকে উঠলে?’ মহারাণীর কণ্ঠ। কয়েকদিন আগে মহারাণীকে কথা দিয়েছি, রাতে আগে আগে শুয়ে পড়ব এবং সকালে খুব ভোরে উঠে হাঁটতে বের হব। আমার নাকি ভুঁড়ি বেড়ে যাচ্ছে।
‘না না, উঠেছি আগেই, একটু বিছানায় শুয়ে ছিলাম।’
‘শোন, তুমি আটটার মধ্যে সদরঘাটের পাশে আরেকটা ঘাট আছে, ওয়াইজঘাট, সেখানে চলে আসো’
‘ওয়াইজঘাট চিনি না, সদরঘাট চিনি। কিন্তু ঐসব ঘাটে তোমার কি কাজ?’
‘যা বলছি তা করবে, কি কাজ তা দিয়ে তোমার কোন কাজ নাই, বুঝছ?’
‘হু... বুঝছি। কিন্তু আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে আছে, যে কোন সময় আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে’
‘এতো কথা বল কেন? যা বলছি, ঠিক আটটার মধ্যে ওয়াইজঘাট... মনে থাকে যেন...’
আমাকে আর কোন কথা বলতে না দেয়ার সুযোগ দিয়ে লাইন কেটে দিল। মহারাণীকে নিয়ে আর পারলাম না। দিন দিন ওর পাগলামো বেড়েই চলেছে, সামনে আরও কত যে হ্যাপা সহ্য করতে হবে আল্লাহই মালুম। আমি দ্রুত খাট থেকে নেমে পড়লাম, হাতে আছে এক ঘণ্টারও কম সময়, এই সময়ের মধ্যে সেই সদরঘাট পৌঁছতে হবে। ভাগ্য ভাল সকালবেলা, তার উপর আজ কিসের যেন ছুটি, তাই রাস্তাঘাট ফাঁকাই আছে। কয়েকদিন পরপরই ছুটি থাকে ইদানীং, যদিও আমার এসবের কোন হিসেব নেয়ার দরকার পড়ে না। ইদানীং ভার্সিটি যাওয়া হয় না নিয়মিত। মহারাণীর ডাক আসলে সেদিন বাধ্যতামূলকভাবে যেতে হয়। একটা রিকশা নিয়ে আটটা বাজার দশ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম সদরঘাট। ওয়াইজঘাট খুঁজে পেতে আরও দশ মিনিট। কিন্তু ঘাটে গিয়ে কারো দেখা পেলাম না, এদিক সেদিক তাকিয়ে কোথাও মহারাণীর দেখা পেলাম না। দশ মিনিট খোঁজাখুঁজি করে যখন ভাবছি আবার বাসার দিকে ফিরে যাব কি না, তখন দেখি রাস্তার উপর রিকশা হতে মহারাণী নামছে। পড়নে ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের একটা শাড়ি, সাথে ম্যাচিং করা ফুলহাতা ব্লাউজ। মাথার দীঘল কালো কেশমালা মেলে দিয়েছে পিঠের উপর। বাতাসে কয়েকটি চুল এলোমেলো উড়ছে মৃদু ছন্দে। আমি মনে মনে গেয়ে উঠলাম,
দখিণা হাওয়া ঐ তোমার চুলে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় এলোমেলো করে
দুয়েকটি চুলে ঢেকে যায় তোমার একটি চোখ
আমি ভুলে যাই....
এতোটুকু গুণগুণ করে গেয়ে আমি থেমে যাই, কারণ এর পরের লাইনটা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। মহারাণী আমার, শুধুই আমার। আমার এই ভাবনার মাঝেই মহারাণী এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি, দেরীর কারণ কি? পরে ভাবলাম খাল কেটে কুমির আনার কোন কারণ নেই। কিন্তু মহারাণীর বেশভূষা দেখে নিজেকে কেমন বেমানান মনে হচ্ছিল। আমি তো ঘুম থেকে উঠে একটা সাধারণ ট্রাউজার আর টিশার্ট চাপিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু মহারাণীর সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে আমরা কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। আমি হালকা স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘এতো সাজসজ্জা? কোথায় যাচ্ছ?’
‘যাচ্ছ না, বল যাচ্ছি? তুমি আর আমি’ মহারাণী তার সেই হাসি হেসে বলল। যেই হাসি দেখলে বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা হয়।
‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘বিয়েতে’
‘বিয়ে? কার বিয়ে?’
‘আমাদের...’ মহারাণীর চোখে দুষ্টুমির ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
‘আমাদের বিয়ে মানে কি?’
‘আমরা আজ বিয়ে করতে যাচ্ছি’ দুষ্টুমিমাখা একটা হাসি দিয়ে বলল মহারাণী। আমার মনে হল কেউ যেন আমাকে মহাশূন্যে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, আমার কোন ওজন নেই, কোন অনুভূতি নেই। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। আমার বিহবল অবস্থা দেখেই বুঝি মহারাণীর দয়া হল। খিলখিল করে হেসে উঠলো...
‘ভয় পেয়ে গেলে, বিয়ের কথা শুনে মনে হল আকাশ থেকে পড়লে। থাক আজ বিয়ে বাদ, আজ ডেকেছি... নৌকা করে সারাদিন বুড়িগঙ্গায় ঘুরে বেড়াবো। অন্যসময় তো নোংরা পানিতে টেকা দায়, এই বর্ষায় যা একটু নদীটা নিজের রূপ ফিরে পায়... তাই না’ আমি অল্পসময়ের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। মহারাণীর স্পর্শের ঝাঁকুনিতে সম্বিৎ ফিরে পেলাম যেন। একটু পড়ে একটা নৌকা ভাড়া করা হল, নৌকার ছইয়ের নীচে সুন্দর পাটি পাতা আছে, বয়স্ক মাঝি নৌকা ছাড়তেই মহারাণী আয়েশ করে ছইয়ের ভেতর হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। আমি ভেতরে ঢুকতে নিতেই আমাকে ইশারায় নৌকার গুলইয়ের দিকে দেখাল। মানে! আমার ছইয়ের ভেতর প্রবেশ নিষেধ, নৌকার এক মাথায় বসে মাঝি ভাই বৈঠা বাইছে, অন্য মাথায় আমি একবার মহারাণীকে, একবার মাঝি ভাইকে, আর বাকী সময় চারিধারে দেখতে লাগলাম।
নৌকা ঘণ্টাখানেক চলার পর শুরু হল বৃষ্টি, কিন্তু সাথে তেমন বাতাস না থাকায় মাঝি নৌকা বাইতে লাগলো। আমি এই বৃষ্টির মাঝেও ছইয়ের ভেতর জায়গা পেলাম না, বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম।
... ... ...
দুইদিন পরের ঘটনা, দুপুরের দিকে মহারাণীর ফোন।
‘হ্যালো কোথায় তুমি?’
‘আমি তো গ্রামের বাড়িতে’ মিথ্যা বললাম। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে আমার একশ তিন ডিগ্রী জ্বর।
‘মানে? গ্রামের বাড়ি হুট করে?’
‘হঠাৎ বাসা থেকে ফোন এল, জরুরী কাজে চলে আসতে হল।’
‘অ... ঠিক আছে। ফিরবে কবে?’
‘দেখি, এখনো জানি না। আগামীকালও ফিরতে পারি আবার এক সপ্তাহ পরেও ফিরতে পারি। তুমি এখন কি কর?’
‘আমি সোবহানবাগ মসজিদের কাছে, পানির মাঝে আটকে আছি।’
‘মানে? কলাবাগান লেকে?’
‘আরে গাধা, না... বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে গেছে। আমি ছিলাম বাসে, পানির মাঝে এসে বাস নষ্ট হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে যেতেও পারছি না... রাস্তায় কোমর সমান পানি’
‘আহালে... আমার পাখীটা...’
‘এই ঢং করবা না, আমি পানিতে আটকে আছি, আর তুমি এখানে আহ্লাদি করতে আসছ?’
‘না না... আমি তো এমনি...’
‘চুপ, আর একটা কথা বলবা না। স্টুপিড কোথাকার...’ বলে মহারাণী লাইন কেটে দিল। আমি মনে মনে হাসলাম। আমারে বৃষ্টিতে ভিজায়া জ্বর বাঁধাইছো, এখন নিজেও একটু কষ্ট পাও... একটা কবিতা লিখার সাধ জাগল, হাতের কাছে কাগজ কলম টেনে নিলাম। কবিতার নাম, ‘পানি বন্দী মহারাণী!’
মহারাণী'র কেচ্ছা সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
অর্থহীন অভিমান (মহারাণীর কেচ্ছা - ০৪)
আহা রঙ, আহারে জীবন (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০৩)
ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে... (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০২)
মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৯