মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে... (মহারাণী’র কেচ্ছা০২)
মেলা জিনিষটা আমার একেবারেই অপছন্দের একটা বিষয়। বানিজ্য মেলা, বই মেলা, বৈশাখী মেলা, বস্ত্র মেলা, কম্পিউটার মেলা, লালন মেলা... কত যে মেলা!!! এইসব মেলা’র আয়োজন দেখলে আমার মনে হয় অহেতুক অর্থ আর সময়ের অপচয়। মানুষ এই দুটো নষ্ট করে মেলা’য় ঘুরে বেড়ায়। আমি ছোট বেলায় হয়ত মেলায় গিয়েছি, কিন্তু বড় হয়ে মেলায় যাওয়া হয় না। কিন্তু এবার খুব আগ্রহ নিয়ে আমি বইমেলার জন্য অপেক্ষায় আছি। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে, মহারাণী বইমেলা’য় ঘুরে ঘুরে বই কিনে সারা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। তার সাথে ফেব্রুয়ারি মাসে আছে অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি... আহ এগুলোর মাঝে আমি আর মহারাণী।
তো জানুয়ারি মাস খুব আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে কাটিয়ে দিলাম আগত সুখ সময়ের কথা ভেবে। কিন্তু বইমেলার প্রথম দিনই আমার স্বপ্নভঙ্গ হল, মহারাণী’কে বইমেলায় যাওয়ার কথা বলতেই সে কপালে ভাঁজ তুলে বলল, “বইমেলায় যাব বই কিনতে, তো তুমি সাথে যাবে কি কারণে? তুমি কি মাস্টার মশাই নাকি? হাতে সিলেবাস নিয়ে ঘুরবে?”
আমি ধাক্কা সামলে নিয়ে বললাম, ‘উহু, আমি তোমার কেনা বইগুলোর ব্যাগ বহন করব, বলতে পারো তোমার সেবক হিসেবে বইমেলায় তোমার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াবো’
‘বইয়ের ব্যাগ বহন করবে? মানে কুলিগিরি? তাহলে এক কাজ কর না কেন, কমলাপুর অথবা সদরঘাট চলে যাও, সেখানে গিয়ে মানুষের ব্যাগ বহন করে বেড়াও... তাতে কিছু পয়সা পাবে।’
মুখের অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন না এনে কথাগুলো বলল মহারাণী। আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, এটাকে সিরিয়াসলি নিব, নাকি ফান হিসেবে, নাকি মহারাণীর রাগ হিসেবে? আমাকে আরও অপদস্ত করতেই কিনা জানি না, মহারাণী আমায় বলল, ‘শোন আমি এখন বইমেলায় যাব, কিছু বই কিনতে হবে। খবরদার তুমি যেন পিছু পিছু না আস। আর হ্যাঁ, তুমি কখনোই বইমেলায় ঢুকবে না, এটা আমার অর্ডার।’
‘ওমা কেন? আমি বইমেলা’য় গেলে সমস্যা কি?’
‘সমস্যা আছে...’
‘ধুর, কি সমস্যা বলবা তো’
‘কেন, গত মাসে বানিজ্যমেলা’র কথা উঠতেই তুমি বলছ না... তুমি মেলা-টেলা একেবারেই পছন্দ কর না’
‘বলছি নাকি? হবে হয়ত’ আমি ধরা খেয়ে একটু অভিনয়ের আশ্রয় নিলাম। গতমাসে মহারাণী বানিজ্যমেলায় যেতে চাইলে আমি এই কথা বলে এড়িয়ে গেছি, ও তখন কিছু বলে নাই, কিন্তু মনে রেখেছে। এখন সেটা’র প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমি বসে বসে মহারাণীর চলে যাওয়া দেখলাম।
===========================================
হরতালের দিনে দোকানপাট তেমন খুলবে কিনা এই দ্বিধা নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম, বহুদিন তেমন শপিং করা হয় না। শেষ কবে ঘটা করে শপিং করতে বের হয়েছি বলতে পারবো না। আজ বের হতে হচ্ছে, তাও টানা তিনদিনের হরতাল মাথায় নিয়ে। তিনদিন পর পহেলা ফাল্গুন, মহারাণী অবশেষে আমায় বইমেলায় প্রবেশের প্রবেশাধিকার দিয়েছে, তবে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী, সাথে সাদা রঙের পায়জামা এবং কোলাপুরি চপ্পল থাকতে হবে পায়ে। কি মহা যন্ত্রণা!
বন্ধু সফিক’কে ফোন করে এগুলো প্রাপ্তির সম্ভাব্য জায়গা জেনে নিয়েছি। কাল রাতে টিউশনির টাকাটাও হাতে এসেছে, ঝামেলা করল মাঝখানে এই বেরসিক হরতাল। এখন এই টানা তিনদিন যদি কোন দোকান না খুলে তাহলে কি হবে? এই ভাবতে ভাবতে আমি নিউমার্কেটে’র দিকে রওনা হলাম একটা রিকশা নিয়ে। ওমা সব দোকানপাট খোলা, তবে প্রায় দোকানেই অর্ধেক সাটার নামানো, কিন্তু মার্কেটের ভেতরের দিকে সব দোকান পুরোই খোলা। আমি নিউমার্কেটে খোঁজ করে কোলাপুরি চপ্পল কিনে নিলাম। এবার যেতে হবে সায়েন্সল্যাব, পাঞ্জাবী আর পায়জামা’র জন্য।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সায়েন্সল্যাবে পাঞ্জাবী খুঁজে বেড়ালাম, কোথাও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী পাওয়া গেল না। কয়েক দোকানদার দেখলাম গেরুয়া রঙের নামই শোনে নাই!!! শেষে এক দোকানদার বুদ্ধি দিল মৌচাক চলে যেতে, সেখানে পেতে পারি। এভাবে আমি সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিকেলে পৌঁছলাম গুলিস্তান পীর ইয়েমেনি মার্কেটে। সেখানে এক দোকানদার আমায় ভাল বুদ্ধি দিল, বলল, ‘ভাই আপনি কোথাও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী খুঁজে পাবেন না। তারচেয়ে বরং ইসলামপুর থেকে গেরুয়া রঙের কাপড় কিনে পাঞ্জাবী বানিয়ে নেন’। আমারও মনে ধরল কথাটা, চলে গেলাম ইসলামপুর। খুঁজে পেতে পাওয়া গেল গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী'র কাপড়। প্রয়োজনীয় কাপড় কিনে নিয়ে এবার টেইলার্স খুঁজতে আবার রওনা দিলাম রমনা ভবন, গুলিস্তানে।
গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের সামনে দিয়ে হাঁটছি আর হাতের গেরুয়া রঙের কাপড়ের পিসের দিকে তাকিয়ে ভাবছি তিনদিন পরে বইমেলা চত্বরে এই কাপড়ের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে মহারাণীর সাথে ঘুরে বেড়ানো’র সম্ভাব্য স্মৃতিকথা। কিন্তু বিধিবাম। রমনা ভবন গিয়ে শুনি কোন টেইলার্সই এক সপ্তাহের আগে পাঞ্জাবী বানিয়ে দিতে পারবে না। আমি পড়লাম মহাসমুদ্রে, এখন আমার কি হবে। হাতে সময় তিনদিন, কীভাবে এই তিনদিনে পাঞ্জাবী বানাবো? একজনের পরামর্শে হাঁটা শুরু করলাম চকবাজারের দিকে, সেখানে নাকি বেশ কিছু পাঞ্জাবী বানানোর দোকান আছে।
মিনিট পাঁচেক হেঁটে বঙ্গবাজারের দিকে এগুতেই কোথা থেকে টপাটপ তিন চারটা ককটেল বোমা এসে রাস্তায় প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হতেই শুরু হল লোকজনের দৌড়াদৌড়ি। আমিও দিলাম ছুট, ছুটে গিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পাশের ফুটপাতে উঠতেই দেখি আমার গেরুয়া কাপড়ে গাঢ় লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ। হায় হায় একি? হঠাৎ করে বাম হাতের কুনইয়ে ব্যাথা অনুভব করলাম, চেয়ে দেখি সেখান থেকে চামড়া ছড়ে গিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। আমি ভেবে পেলাম না কেম্নে কি? আমার হাত কাটলো কীভাবে? আর কাটলোও যদি, তো রক্ত গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী’র গায়ে লাগল কীভাবে?
=========================================
আমি কখন, কীভাবে হাসপাতালে এলাম বলতে পারবো না। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যেতে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করি। চারদিকে চোখ মেলে দেখতে গিয়ে দেখি পাশে মহারাণী বসে আছে, তার চোখ লাল। কেঁদেছে নাকি মেয়েটা? উফ... নড়তে গিয়ে দেখি পায়ে ব্যাথা করছে, পায়ে রানের কাছে হাত দিয়ে বুঝলাম ব্যান্ডেজ করেছে। কীভাবে আমি এতো আঘাত পেলাম বুঝতে পারছি না। বোমা ফাটার পর দৌড় দিলাম, তারপর সেই রক্তে ভেজা গেরুয়া কাপড়... কিছুই বুঝতে পারলাম না।
‘এখন কেমন লাগছে? ব্যাথা করছে খুব?’ মহারাণী মায়া ভরা আদ্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘নাহ, তেমন কিছু না।’
‘তুমি এই হরতালের মধ্যে গুলিস্তান কি কাজে গেলে?’ মহারাণী কান্না কান্না সুরে বলল।
‘গেরুয়া পাঞ্জাবী... ’ বলতেই আমার মনে পড়ল আমার পাঞ্জাবীর কাপড় আর পহেলা ফাল্গুনে মহারাণীর সাথে বইমেলায় ঘুরে বেড়ানোর কথা। ছলছল চোখে মহারাণীর দিকে চেয়ে দেখতে দেখি বিরক্তি এবং গম্ভীর মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে।
‘আচ্ছা তোমার মাথায় কি এতটুকু ঘিলু নাই? তুমি ঠাট্টা আর সিরিয়াস কথা আলাদা করতে পারো না?’
‘বুঝি নাই, আমি আবার কি করলাম?’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্নটা মহারাণীর উদ্দেশ্যে করলাম।
‘আমি তোমায় গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী’র কথাটা এমনি এমনি বলেছি, আর তুমি সত্যি মনে করে ছুটলে গেরুয়া পাঞ্জাবী বানাতে। তুমি এতো কিছু বুঝো, আর এই ফাজলামোটুকু বুঝতে পারলে না’
মহারাণীর মায়াবী হরিণ চোখে মুক্তো’র দোলা দেখলাম ছলছল করছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে জানাল দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আহ, জীবনটা এতো সুন্দর কেন? কতক্ষণ বাহির পানে চেয়ে ছিলাম জানি না, মহারাণীর কোথায় সম্বিত ফিরে পেলাম, ‘তুমি যদি ঐ গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী পরে পহেলা ফাল্গুনে আমার সাথে দেখা করতে, তবে তোমার খবর ছিল। ইহজীবনে আমার আর দেখা পেতে না’
আহা রঙ, আহারে জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৩