বছর দুয়েক আগে কোন এক সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ছবি দেখি। দুই পাশে পাহাড়ের সারি রেখে নীলাকাশের নীচে গাঢ় নীলাভ সর্পিল নদী বয়ে চলেছে। ছবি দেখে তন্ময় হয়েছিলাম অনেকটা সময়। নদীর নাম “লোভা”, লোকেশন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা। বসে পড়লাম নেটে, সারাদিন গুগল মামাকে বিরক্ত করেও কোন লাভ হল না। না কোন তথ্য, না কোন বিবরন; শুধু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একটি নদী ইংরেজিতে লোভা নামে চিহ্নিত করা আছে। তখন থেকে প্ল্যান কবে যাব লোভা নদীতে নৌ-বিহারে? অবশেষে গেল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সৌভাগ্য হল লোভা নদী তথা লোভাছড়া ভ্রমণের। তবে ইতোমধ্যে লোভাছড়া’র নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে রিপোর্ট শুরু হয়েছে। আর এখনতো জাতীয় পত্রিকায়, টেলিভিশনে পর্যন্ত লোভাছড়া’র উপর রিপোর্ট হচ্ছে।সিলেট থেকে জাফলং-তামাবিল সড়কের সারিঘাটের কাছাকাছি এসে একটা রাস্তা বামদিকে গোয়াইনঘাটের দিকে গেছে যে পথে আছে আলোচিত পর্যটন কেন্দ্র “বিছানাকান্দি”, “পান্তুমাই”, “লক্ষনছড়া”। আর হাতের ডানদিকে সারি নদীর শাখা ধরে আপনি চলে যেতে পারবেন লালাখালের অপার সৌন্দর্যের ভুবনে। এই লালাখালস্থ চা বাগানের পেছন দিয়ে সংযোগ রয়েছে “লোভাছড়া চা বাগান” এর। তবে তার আগেই ডানের পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে কানাইঘাটের দিকে। এবড়ো-থেবড়ো, ভাঙ্গা এই সড়ক ধরে ঘণ্টা দেড়েক গেলে আপনি পৌঁছে যাবেন কানাইঘাটে। তবে এই যাত্রাপথে আপনি দেখতে পাবেন সীমান্তের সারি সারি পাহাড়ের সুন্দর পটে আঁকা ছবি যা হয়তো আপনাকে এই যাত্রা পথের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে সহায়তা করবে।
কানাইঘাট হতে নৌকা চলে সীমান্তবর্তী গ্রাম “মুলাদি” বাজার পর্যন্ত। জনপ্রতি ভাড়া ৫০ টাকা। অপূর্ব এই নৌভ্রমণ আপনি আজীবন মনে রাখবেন। তবে অবশ্যই বর্ষার মৌসুমে যেতে হবে আপনাকে। শুকনো মৌসুমে হলে হাঁটু পানিতে মাঝিদের ঠেলে ঠেলে নৌকা বয়ে যেতে দেখবেন। মুলাদি বাজার যাওয়ার পথেই পড়বে “লোভাছড়া চা বাগান”, মাঝিকে বললেই ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে আপনাকে নামিয়ে দেবে। এরপর হারিয়ে যান সবুজের গভীর মায়ায়।
কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের অর্ন্তভূক্ত এই সীমান্তবর্তী লোভাছড়া নদীর পাশেই ব্রিটিশ আমলে প্রায় ১৮৩৯ একর জমির উপর ইংরেজ মালিকানায় গড়ে ওঠে লোভাছড়া চা-বাগান। বাগানের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের একটি সুন্দর পিকনিক স্পট ও লালাখাল চা-বাগান অবস্থিত। পাহাড়ের কোল জুড়ে গাছপালার সবুজ বর্ণিল রঙয়ে আচ্ছাদিত হয়ে আছে লোভাছড়া চা-বাগান। বাগানের শুরু থেকে মাটির রাস্তা ধরে যতদূর এগুনো যায় চোখে পড়ে ছোট-বড় নানা ধরনের গাছপালা। চা-বাগানের মাঝে গাছগুলো সারি-সারিভাবে সাজানো। এই চা-বাগানের সৌন্দর্য্যের প্রতি মুগ্ধতা অন্যদিকে রয়েছে তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের প্রতি লালসা। লোভাছড়ার পাশ দিয়ে ভারত সীমান্তে হারিয়ে গেছে ‘নুনগাঙ’। ‘নুনগাঙ’ প্রায় নদীর মত হলেও এটি আসলে ঘোলা পানির একটি খাল যা লোভাছড়া নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। খালের উপর বেশ পুরনো তবে এখনো মজবুত স্টীলের তৈরী একটি ব্রীজ রয়েছে, যার উপরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তের পাহাড়ঘেরা আবছা ছবি চমৎকারভাবে ভেসে ওঠে। বাগানের সবচাইতে উঁচু বাংলো থেকে শীতের দিনে দেখা যাবে স্বচ্ছ জলের লোভাছড়া নদী। এই বাগানেই কিছুদিন ২০১২ সালে একটি ব্ল্যাক প্যানথার ধরা পড়ে, যেটি শুধুমাত্র আফ্রিকা মহাদেশে পাওয়া যায়। এছাড়াও খুব সকালে হরিণ, খরগোশ, আর বন মোরগ চোখে পড়ে। আর রাতের আঁধারে শোনা যায় বাঘের গর্জন। বলা চলে- লোভাছড়া চা-বাগান বন্যপ্রাণীদেরও অভয়াশ্রম। বাগান কর্তৃপক্ষের একটি বিশাল আকৃতির পোষা হাতি রয়েছে, যেটি সবসময় বাগানে অবাধ চলাফেরা করে। লোভাছড়ায় পর্যটকের জন্য থাকার কোন সু-ব্যবস্থা না থাকলেও বাগান মালিক কর্তৃপক্ষের জন্য রয়েছে ৪টি বাংলো। বাংলোগুলোর বাহ্যিক দৃশ্যগুলোও বেশ নান্দনিক। বাংলোর কাছাকাছি জায়গায় রয়েছে কয়েকটি কফি গাছ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর তান্ডবে এই বাগানের নিজস্ব ফ্যাক্টরী ধ্বংস হয়ে যায়। তাই এখানে গেলে কোন চা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি দেখা যাবে না।
।
সত্যিই অপূর্ব লোভাছড়ার পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকটা জৈন্তাপুরের জাফলং এর মত। এখানেও নদীতে প্রচুর পাথর দেখা যায়। এছাড়া আরো রয়েছে স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ঝর্না। ঝর্নার পানিতে ছোট ছোট সুন্দর মাছগুলোর খেলা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এই লোভাছড়ার যে দিকেই তাকানো যায় দেখা যায় শুধু সবুজ পাহাড়। বর্ষাকালে পাহাড়গুলো আরো সবুজ দেখায়। এখাকার যে কোন উঁচু পাহাড়ে উঠলে দূরের ঐ মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় খুব কাছে থেকে দেখা যায়। লোভাছড়ায় বাড়তি আকর্ষন হিসেবে খাসিয়া পুঞ্জি তো আছেই । এখানকার খাসিয়াদেরও আদি নিবাস ছিল খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। বহু বছর পুর্ব থেকে এদের লোভাছড়ায় বসবাস। লোভাছড়া থেকে ৫ কি. মি উত্তরে গভীর জঙ্গলের ভিতরে কয়েকটি বিশাল আকৃতি পাথর রয়েছে। এক একটি পাথরের উচ্চতা হবে প্রায় ৩০ ফুট। প্রতিটি পাথর গোলাকার। চওড়া হবে প্রায় ৫০ ফুট। যদিও এই তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে, আমি প্রথমদিন এই পাথরের খোঁজে স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে ব্যাপক অনুসন্ধান করেছি। যারা বনে বিভিন কাজে যাতায়াত করে তাদের ভাষ্য মতে এই উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশী নয়, এই পাথরগুলোর অবস্থান পাহাড়ের নিচে। লোভা নদী থেকে বারকি শ্রমিকরা প্রচুর পাথর উত্তোলন করে। সেই পাথর তোলার দৃশ্যও খুব সুন্দর। শহরের বানিজ্যিক এলাকায় বড় বড় ভবন এবং দেশের বড় বড় সড়কগুলোর বেশির ভাগই তৈরি এ লোভা নদীর পাথর দিয়ে। লোভাছড়া এলাকার জনসাধারন চাষাবাদ এবং পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এলাকার মানুষগুলো খুবই সহজ সরল। লোভাছড়ায় টিলার উপর একটি প্রচীন জমিদার বাড়ী রয়েছে। ১৯০৯ সালে একজন সমাজ সেবক ইংরেজ মেজর লোছড়ায় এসে জমিদারীর গোড়া পত্তন করেন। বর্তমানে তাঁর নাতী জেমস লিও ফাগুশন তাঁর দাদার সম্পত্তিগুলো দেখাশুনা করছেন। এক সময় এই এলাকা হিংস্র বণ্য প্রানীর অভয়ারণ্য ছিল।
সেদিন বেড়িয়ে দুদিন পর আবার ভ্রমণ বাংলাদেশের ৩২জনের দল নিয়ে আবার যাই লোভাছড়া। আসলে লোভাছড়া’র প্রেমে পড়ে গেছি। আসছে শীতে আবার যাবো লোভাছড়া, আর অবশ্যই আগামী বছর বর্ষায়। এই লোভাছড়া কেন্দ্র করে একটি প্রেমের গল্প আগামীতে লেখার ইচ্ছা আছে। তো? কবে যাচ্ছেন লোভাছড়া?
তথ্যসুত্রঃ
http://www.bdnationalnews.com/tourism/
http://www.sylhetview.com/
প্রথম ছবি চারটি সংগৃহীত। এর মধ্যে প্রথমটি সেই ছবি যা দেখে লোভাছড়া'র প্রেমে পড়েছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:২২