মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
এই টিউশনিটা মাস দুয়েক হল বন্ধু মুহিব যোগাড় করে দিয়েছে। পেমেন্টটা ভালই দেয়, সাথে নাশতাটাও মন্দ দেয় না। মাঝে দু’তিন দিন বৃষ্টিতে স্টুডেন্টদের প্রাইভেট কারে করে মেসে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই, স্টুডেন্টের মা’কে নিয়ে। এই ভদ্রমহিলা মহা যন্ত্রণাদায়ক ক্যারেকটার। সারাক্ষণ নজরদারি, খবরদারী বা খুঁতখুঁতে যেটাই বলি না কেন, এই মহিলা প্রায় প্রতিদিন করে যাচ্ছেন। তার ছেলেকে কতক্ষণ পড়ালাম, কি পড়ালাম, কিভাবে পড়ালাম... হেন বিষয় নেই যা নিয়ে উনার প্রতিদিন ময়নাতদন্তে নামতে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় মুখের উপর বলি, “ম্যাম, আপনি যখন এতো কিছু বুঝেন, ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্বটাও আপনি নেন না কেন? হাতে তো মনে হয় সময়ও ম্যালা আছে...”।
কিন্তু মনের সব কথা মুখে বলা যায় না। মাস শেষ হলে মোটা একটা অঙ্ক হাতে আসে, মাসে ১২/১৩ দিন দু’ঘণ্টা কষ্ট করে এই অত্যাচার সহ্য করাটা টাকার অঙ্কের কাছে নস্যি; বিশেষ করে আমার মত লাইসেন্সধারী বেকারের জন্য। আজও তার ব্যাতিক্রম হয় নাই, বাসায় ঢুঁকে বসতে না বসতেই ভদ্রমহিলা এসে হাজির। “আরে স্যার, আপনি যে গতদিন দ্রুত চলে গেলেন? হোমওয়ার্কগুলো তো ঠিক মত দেখেনও নাই। আপনার স্টুডেন্ট যে ফাঁকিবাজ, তাকে একটু স্পেশাল কেয়ার না করলে যে আরও ফাঁকিবাজ হয়ে যাবে। বুঝেনইতো এখনকার এই বয়সের বাচ্চাগুলো যা ফাঁকিবাজ...”। আমি মনে মনে কিছু কটু কথা বলে মুখে একটা বোকা বোকা হাসি ধরে রেখে চোয়াল ঝুলিয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইলাম। শালার টিউশনি!
যাই হোক মাতৃ জননী মঞ্চ হতে প্রস্থান করতে উনার ছেলেকে নিয়ে আমি মঞ্চে নেমে পড়লাম। আজ হাতে বিশেষ কোন কাজ নেই, নেই কোন তাড়া। তাই মনে মনে ঠিক করলাম আজ ‘ইসপার কি উসপার’ হয়ে যাক। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার আগে ছুটি দেয়া নেই, পারলে চার ঘণ্টা পড়াবো। গৃহিণী সদয় হলে রাতের ডিনারটাও করে যাবো । মাতৃজননী এসে তার ছেলেকে উদ্ধার না করলে আজ ছেলেকে বুঝাবো পড়ানো কাকে বলে, শেষে যেন মা এসে বলে, “মাস্টারমশাই এবার ক্ষান্ত দেন”। এইসব ভেবে ভেবে যখন মনটা একটু একটু করে প্রফুল্ল হচ্ছে তখনই বেরসিক মোবাইলটা কর্কশ কণ্ঠে বেজে উঠলো। স্ক্রিনে দেখি মহারাণীর নাম্বার, উফ...! দুরুদুরু বুকে ফোন ধরলাম, এখন যেন না বলে বসে উমুক জায়গায় চলে আসো, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম...
মহারাণীর অভ্যাসটাই এমন, আমি থাকি পশ্চিম নাখালপাড়ার এক মেসে। সে হুট করে ফোন দিয়ে বলবে, “তোমায় পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, মৌচাক মার্কেটে চলে আসো”।আরে বাবা আমিতো মানুষ! নাকি আমার ডানা আছে? ফুড়ুৎ করে উড়ে উড়ে চলে আসবো... কিন্তু ওকে এই কথা বলার সুযোগ পেলে তো? কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই হুট করে লাইন কেটে দিবে, কল ব্যাক করলেও রিসিভ করবে না। মহা প্যারা’রে ভাই, কিন্তু এই প্যারাই কেন যেন আমি খুব ভালো পাই...
ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে মহারাণী ফিসফিস করে কিছু বলছে... আমি না পেরে বললাম,
“কি বলছো, কিছু বুঝা যায় না তো... একটু জোরে বল...”
“কেন? কানে কম শোনা’র রোগ আবার কবে থেকে হল? তুমি বিশ মিনিটের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালের ইমারজেন্সি গেটে চলে আসো” কথাগুলো চাপা স্বরে কটমট করে বলেই লাইন কেটে দিল। কি যন্ত্রণা!
টিউশনি বাঁচাতে হলে আজ কোনমতেই দুই ঘণ্টার আগে বের হওয়া যাবে না। আমি স্টুডেন্টকে একটা অঙ্ক করতে দিয়ে চিন্তার জগতে ডুব দিলাম। মহারাণী চাপা গলায় কথা বলছিল, মনে হয় হাসপাতাল থেকে। তবে কি মহারাণীর কিছু হল? নাহ, ওর কণ্ঠে তেমন কিছুতো ছিল না। তবে? ও বলল, ইমারজেন্সি গেটে চলে আসতে... কেউ কি সিরিয়াস অবস্থায় হাসপাতালে... আমি কিছুই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না।
প্রথমে ভাবলাম গৃহকর্ত্রীকেই ডেকে বলি, আমার ইমারজেন্সি ঢাকা মেডিক্যাল যেতে হবে, এক আত্মীয় অসুস্থ। কিন্তু পরমুহূর্তে ডিসিশন চেঞ্জ করে স্টুডেন্টকে একগাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে উঠে পড়লাম, আর বলে দিলাম আগামীদিন পড়াতে আসবো। যদিও শিডিউল তার পরের দিন। কিন্তু একদিন অতিরিক্ত পড়িয়ে দিয়ে আজ আর গতদিনের নষ্ট সময় (গৃহকর্ত্রী’র দৃষ্টিতে) পুষিয়ে দেব। আমার ছাত্রটি কি যেন বলছিল, কাল অন্য টিচারের পড়া আছে না কি যেন...; আমি রাতে ফোন দিয়ে টাইম ঠিক করে নিবো... এই বলে বেরিয়ে পড়লাম সেখান হতে।
এখন এই ধানমণ্ডি সাত নম্বর হতে যেতে হবে ঢাকা মেডিক্যালের ইমারজেন্সি গেটে। মিরপুর রোড পুরোটা জ্যামে স্থবির হয়ে আছে, কি করবো ভেবে পেলাম না প্রথম কয়েক মিনিট। হাটতে হাটতে সিটি কলেজ পর্যন্ত এসে রিকশা নেয়ার চিন্তা বাদ দিলাম, কারন ঢাকা কলেজ ঘেঁষে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার হয়ে রিকশা চলাচলের রাস্তাও প্যাক হয়ে স্ট্যাচু অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। অগ্যতা এলিফেণ্ট রোড ধরে কাঁটাবনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দ্রুত পা চালিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যে শাহবাগ চলে এলাম। এখান থেকে রিকশা পাওয়া আরেক যন্ত্রণা, আর পেলেও ভাড়া শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। যাই হোক চল্লিশ টাকা ভাড়ায়! রিকশা নিয়ে ছুটলাম ঢাকা মেডিক্যালের ইমারজেন্সি গেটের দিকে। রিকশায় বসে ট্রাই করতে লাগলাম মহারাণীর মোবাইলে, রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। এক অজানা অশুভ আশঙ্কায় আমার মন ভীত হয়ে গেল।
কোনমতে ইমারজেন্সি গেটে নেমে ভাড়া চুকিয়ে ইতিউতি খুঁজে দেখলাম, কোথাও মহারাণীর দেখা পেলাম না। টিকেট কাউণ্টারে মহারাণীর নাম বলে জানলাম, এই নামের কেউ আজকে হাসপাতালে এসেছে কি না। সেখানেও খোঁজ না পেয়ে, ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ করেই দেখি ময়ূরকণ্ঠী নীল জামা গায়ে সাদা ওড়না মাথায় জড়িয়ে মহারাণী হেঁটে আসছে। আমায় দেখে হাসি মুখে হাত নাড়লো। আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ঘটনা কি? সে ইশারায় বলল, বাইরে গিয়ে বলবে। অগ্যতা তার সাথে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।
হাসপাতাল হতে বের হতেই একটা রিকশা ডেকে সে উঠে পড়লো, আমাকেও টেনে রিকশায় তুললো। আমি মহা বিরক্ত হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
“এতো আরজেন্সি দিয়ে ডেকে আনলে, কি হয়েছ? কেউ কি অসুস্থ?”
“অসুস্থ? না’তো। আমি ঢাকা মেডিক্যালে এসেছিলাম আমার এক কাজিনের সাথে দেখা করতে। আরে তোমাকে বলেছি না, আমার ঐ কাজিনটা, যেটা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে পাশ করেছে, ও এখানে আউটডোর ডিউটি ডাক্তার হিসেবে জয়েন করেছে। ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম”
“তো আমাকে এমন তাড়া দিয়ে ডেকে আনার কি দরকার পড়লো?” আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম।
“মানে? তুমি আমার সাথে এইভাবে কথা বলছো কেন?” মহারাণী চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো।
“কিভাবে কথা বললাম? আরে বাবা, আমি টিউশনি ফেলে ছুটতে ছুটতে আসলাম, কারণটা জানতে চাইবো না?”
“এই রিকশা থামাও।” বলতেই রিকশাওয়ালা ব্রেক করলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে মহারাণী বলে উঠলো, “নামো রিকশা হতে, নামো বলছি...”
“আরে কি যন্ত্রণা! কি হয়েছে খুলে বলবে তো...”
“কিচ্ছু হয় নাই, তুমি রিকশা হতে নামবে কি না বল? নাকি আমি চিৎকার করে লোক জড়ো করবো?” এই কথা শুনেই আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। এই মেয়ের মাথায় ছিট আছে, সত্যি সত্যি সে এমন কাণ্ড করে বসবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
আমি রিকশার হুড ধরে জিজ্ঞাসা করলাম “কেন ডেকেছিলে একবার তো বল?”
“কেন ডেকেছি জেনে তোমার কি লাভ? যাও তুমি তোমার টিউশনি নিয়ে থাকো। আর ভুলেও আমায় ফোন দেয়ার চেষ্টা করবে না, খবরদার... স্টুপিড কোথাকার। এই যে চাচা, হাঁ করে কথা গিলতে হবে না, রিকশা চালানো শুরু করেন...”
আমি বোকার মত শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথার দুই
পাশের রগগুলো রাগে দপদপ করছে। মোবাইল বের করে ফোন দিলাম মহারাণীর মোবাইলে। সে রিসিভ করতে আমি বললাম, “তুমি কি পেয়েছো আমাকে? যখন তোমার যা মন চায়, তাই করবা? ভাল্লাগে না আমার এসব”
“এই তোমারে বলছি না ফোন করবা না? আর তুমি আমার সাথে এতো উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস পাও কোথা থেকে। ভাবছিলাম তোমায় নিয়ে অনেকদিন রিকশায় ঘোরা হয় না, আজ সারা সন্ধ্যা দু’জনে রিকশায় ঘুরে বেড়াবো, তারপর... থাক এগুলো এখন আর বলে লাভ নাই। শোনো, আজকের পর থেকে আমায় যদি ফোন করছো... আমি তোমার নাম্বার ব্লক করে দিব... না না, সোজা থানায় কমপ্লেইন করবো, বুঝছো” বলেই লাইন কেটে দিল।
আমি আবার ট্রাই করে দেখি মোবাইল সুইচড অফ! রাগে মোবাইলকে মারলাম এক আছাড়, আমার বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা সেই হাতুড়ি সেট, শালার কচ্ছপের আয়ু। রাস্তা হতে তুলে ব্যাটারি ভরে অন করতেই ফের সচল হয়ে গেল। মনে মনে এই অবস্থায়ও হাসি পেল। আমার আর মোবাইলের একই অবস্থা। মহারাণীর মেজাজ ঠাণ্ডা হলে সে কেম্নে কেম্নে জানি আমার ব্যাটারি ঠিক করে আবার সুইচ অন করে দিবে, আমি সব ভুলে তার মায়াবী চোখের সাগরে ডুব সাঁতার কাটায় মগ্ন হয়ে যাবো। হায়রে... ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে...
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৩০