গেল বছর মানে ২০১৩ সালে বৈশাখ উদযাপনে খাগড়াছড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে সেবার যাওয়া হয় নাই। এইবার তেমন টানা ছুটি ছিল না। তারপরও ২০১৪ এর বৈশাখ উদযাপন করেছি খাগড়াছড়ির ‘পানখাইয়া পাড়া’ নামক গ্রামে যা একটি মারমা অধ্যুষিত এলাকা। আর এই এলাকার প্রতি আমাদের ট্যুর লিডার আবু বকর ভাইয়ের এক অজানা প্রেমানুভুতি নিয়েই আজকের লেখা।
ঘটনা শুরুর পহেলা বৈশাখের সপ্তাহখানেক আগে। ভ্রমণবন্ধু রনিউল ইসলাম রনি অনলাইন চ্যাট এ জানতে চাইলো এবার পহেলা বৈশাখে কোথাও যাচ্ছি কি না? আমার তেমন কোন প্ল্যানই ছিল না এবার কোথাও যাওয়ার। সে জানালো তারা ১৩ তারিখ রাতে ৪/৫ জন কলিগ এন্ড ফ্রেন্ড মিলে খাগড়াছড়ি যাচ্ছে জাস্ট ফর ওয়ান ডে। অর্থাৎ ১৩ তারিখ রাতে যেয়ে ১৪ তারিখ রাতের গাড়ীতেই আবার ঢাকা ব্যাক করা কারণ সবার ১৫ তারিখ অফিস খোলা। আমায় সে জিজ্ঞাসা করলো আমি যাবো কি না? আমি সানন্দে বললাম, ‘নিলে তো যেতাম’। এই থেকে শুরু, রনি আর আমার মিলিত সিদ্ধান্তে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ থেকে একটা ইভেন্ট দেয়া হল এবং স্বল্প সময়ে ১৭/১৮ জনের দল তৈরি হয়ে গেল। আর এই ভ্রমণের টিম লিডার এন্ড এরেঞ্জার হিসেবে বেঁছে নিলাম ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ এর কার্যকরী কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ‘ইকো ট্রাভেলার্স’এর অন্যতম ওউনার আবু বকর ভাইকে। যে কোন ট্যুর এরেঞ্জমেণ্টে উনার জুড়ি মেলা ভার।
তো যাই হোক, ঈগল পরিবহণের রাত বারোটার গাড়ীতে আমাদের টিকেট কাটা হল খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। সেই গাড়ী ছাড়লো রাত দেড়টায়। গাড়ীতে উঠে সবাই হইচই আর গান ভাজতে ভাজতে সময়টুকু উপভোগ্য করে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু পরের দিন টানা দৌড়ের উপর থেকে আবার ঢাকায় ফেরার ধকল মনে করে একটু ঘুমিয়ে নিলাম সবাই। ভোর বেলা যখন আমাদের বাস পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করলো আমারা সবাই একে একে সোজা হয়ে বসে জানালা দিয়ে পাহাড়ের সকাল বলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। বেলা সাতটা নাগাদ আমাদের বাস আমাদেরকে নামিয়ে দিল খাগড়াছড়ি’র পর্যটন মোটেলে, যেখানে আমাদের জন্য রুম বুক করা ছিল। আমরা লাগেজ রেখে সবাই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
এই ফাঁকে রনি আমাদের জন্য নিউজ নিয়ে এল যে, জেলা পরিষদের আয়োজনে একটা র্যালি বের হবে বেলা আটটায়। আমরা দ্রুত রেডি হয়ে যেন সেই র্যালি'তে যোগ দেই সেজন্য রনি সবাইকে তাড়া দিল। ঘটনা শুরু সেখান থেকে। আবুবকর ভাই বলল মূল বৈশাখ বরণ অনুষ্ঠান হবে ‘পান খাইয়া পাড়া’য়। উনি সেখানে তার পূর্ব পরিচিত স্থানীয় এক মারমা বন্ধুকে দিয়ে সব এরেঞ্জমেণ্ট করে রেখেছেন। তারা সেখানে আমাদের বরণ করে নিতে অপেক্ষা করছে। আমিতো নাম শুনেই মজা পেলাম... ‘পান খাইয়া পাড়া”!!!
কোন ফাঁকে রনি সাতজনকে নিয়ে সেই জেলা পরিষদের র্যালি'তে বের হয়ে গেল আমরা টের পেলাম না। ফলে দল দু’ভাগ হয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য। আমরা খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্তর এলাকার এক রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে নিতে ঢুকলাম, নাশতা করছি এমন সময় কানে এল জোরালো বাদ্য সাথে মানুষের কোলাহল। রেস্টুরেন্ট এর বারান্দা দিয়ে দেখি জেলা পরিষদের সেই র্যালি। আমার দোতলা হতে ছবি তুলতে লাগলাম সেই র্যালির। হঠাৎ দেখি রনি আর তার ছয় সাঙ্গপাঙ্গ নাচতে নাচতে র্যালির সাথে আসছে। আমাদের ডাকাডাকিতে তারা র্যালি ছেড়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লো। রনি’র সে কি উচ্ছাস, জটিল র্যালি! আমরা বাকীরা মিস করলাম, কারণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ‘পান খাইয়া পাড়া’!
যাই হোক নাশতা শেষে আমরা সবাই গেলাম পান খাইয়া পাড়ায়। আবু বকর ভাইয়ের সেই বন্ধু যিনি খাগড়াছড়ি’র বিখ্যাত ‘সিস্টেম রেস্টুরেন্ট’ এর মালিক তিনি তার রেস্টুরেন্ট এর গেটে আমাদের জন্য তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাদের দেখে খুব ভালো লাগলো, কি বর্ণিল পোশাক আর সজ্জা নিয়ে হাসি মুখে আমাদের বরণ করে নিলেন। এরপর আমাদের তারা নিয়ে গেলেন সেখানকার এক মাঠে যেখানে বৈশাখ বরণের মূল উৎসব ‘সাংগ্রাই’ এর কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। পার্বত্য এলাকার মারমা উপজাতিদের মূল বৈশাখ বরণ উৎসব এই ‘সাংগ্রাই’।
মূল মঞ্চ সুন্দর করে সাজানো এবং তার পাশেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘পানি খেলা’র মণ্ডপ। সেখানে কড়া রোদে আমরা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পর শুরু হল তাদের অনুষ্ঠান। এই দুই ঘণ্টায় আমরা খাগড়াছড়ি শহরটা ঘুরে দেখতে পারতাম, কিন্তু আবু বকর ভাইয়ের ‘পান খাইয়া পাড়া’র প্রতি অতি ভালোবাসার জন্য আমরা রোদে পুড়ে দুই ঘণ্টা সেখানে রইলাম। মারমা জনগোষ্ঠীর প্রধান এবং স্থানীয় এমপি, জেলা প্রশাসকদের শুভেচ্ছা ভাষণ শেষে মূল ‘সাংগ্রাই’ র্যালি শুরু হল। পুরো শহর এই র্যালি প্রদিক্ষন করবে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এইফাঁকে আলুটিলা এবং দুটি ঝর্না ঘুরে দেখে আসি। আলুটিলা পৌছতেই শুনি ঐদিকে নাকি মূল আকর্ষণ ‘পানি খেলা’ শুরু হয়ে গেছে। অগত্যা ঝর্না দেখা তখনকার মত বাদ দিয়ে আমরা ছুটলাম আবার সেই পান খাইয়া পাড়া!
আমরা সেখানে পৌঁছে দেখি সেখানে মূল মঞ্চে কনসার্ট চলছে স্থানীয় এবং বিখ্যাত মারমা শিল্পীদের নিয়ে। পাশের ‘পানি খেলা’র মণ্ডপে চলছে বিখ্যাত পানি খেলা। মারমা ছেলে এবং মেয়েরা দুই পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রিয় মানুষের উপর পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। বাইরে চলছে তখন তুমুল নাচ, মারমা জনগোষ্ঠীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই গানের তালে তালে নাচছে এবং সেই সাথে চলছে পানি দিয়ে সবাই সবাইকে ভিজিয়ে দেয়া। কিছুক্ষণ খুব ভালই লাগলো, কিন্তু একসময় বিরক্ত লাগা শুরু করল। গ্রুপ লিডার আবু বকর ভাইকে ভিড়ের মাঝ হতে খুঁজে বের করে বললাম, ‘চলেন ঝর্না দেখতে যাই’। এই যাচ্ছি, সেই যাচ্ছি করে সময় পার হতে লাগলো। ঘণ্টাখানেক পরে আমি কপট রাগ প্রকাশ করলে উনি বলেন, ‘আমরা কি ঝর্না দেখতে এসেছি? আমরা এসেছি ‘সাংগ্রাই’ দেখতে’। আমি বললাম, ‘তো চলেন পুরো শহরে জুড়ে কি হচ্ছে ঘুরে ঘুরে দেখি’। উনার উত্তর, ‘সব এই পান খাইয়া পাড়াতেই হচ্ছে।
উফ! কি আর করা?
হায়রে আমার ‘পান খাইয়া পাড়া’!
এরপর দুপুরবেলা আমরা লাঞ্চ করে হোটেলে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে সবাই আবার বের হলাম। এবার ঝর্না দেখতে যাই... কিন্তু আবু বকর ভাই এবার নতুন যুক্তি দিলেন যে, এখন কোন ঝর্নায় পানি নাই। তাই সেখানে গিয়ে সময় নষ্ট না করে আমরা উৎসব দেখি। কি আর করা? দলনেতার কথাই মেনে নেয়া। তো চলেন দেখি... ওমা! অটোরিকশা ঠিক করা হল ‘পান খাইয়া পাড়া’র! আবার...
এবার ওখানে কি আছে? গিয়ে দেখি মেয়েরা দল বেঁধে ‘সাতচারা’ টাইপের একটা খেলা খেলছে আর তাই ঘিরে বিশাল জটলা। প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম, এটা কি দেখার একটা জিনিশ? যাই হোক কিছুক্ষণ সেখানে ছবি তুলে তারা দিলাম তাকে... ভাই এবার মাফ করেন। আর কত পান খাওয়াবেন? চলেন অন্য কোথাও যাই। এবার আমরা পানখাইয়া পাড়া ছেড়ে ‘নিউজিল্যান্ড পাড়া’য় হাঁটতে বের হলাম। এমন নামকরনের কারণ ছোট ছোট পাহাড়ের সীমানা রেখে বিশাল সমতল তৃণভূমি যেখানে অনেক গরু ঘাস খাচ্ছে আপনমনে, অনেকটা টেলিভিশনে দেখা নিউজিল্যান্ড ডেইরীর বিজ্ঞাপনের সেই গো’চড়ানো মাঠের মত। সেই পাড়া দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে আমরা পৌঁছলাম আমাদের হোটেলে। আবু বকর ভাইকে খ্যাপানোর জন্য বললাম, ‘আবু বকর ভাই ঐ পাড়ায় কি আমাদের হবু ভাবী আছে?’। মনে মনে বললাম, ‘চলেন আরকেবার ঘুরে আসি পান খাইয়া পাড়া’। মনে মনে বললাম, কারণ, মুখে বলা মাত্রই যদি আবার উনি নিয়ে যান সেই ‘পান খাইয়া পাড়া’য়!!!
(আমার ছোট্ট ক্যামেরায় তোলা পান খাইয়া পাড়া’র সেই বিখ্যাত সাংগ্রাই উৎসবের কিছু ছবি দেখুন নীচে)