জরিনা বেগমের কেমন শীত শীত লাগছে। এই শীতের ধরনটা খুব অন্যরকম। ডিপফ্রিজ হতে খাবারের প্যাকেট বের করার সময় হিমশীতল ঠাণ্ডা বাতাস হাতের চামড়ায় যে রকম ঠাণ্ডা একটা পরশ বুলিয়ে দেয়, সারা শরীরে তেমন এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা অনুভূতি কাজ করছে। চোখের পাতা এতো ভারী হয়ে আছে যে, চোখ খুলে দেখতে পারছেন না তিনি কোথায় আছেন। বারবার মনে হচ্ছে তিনি মারা গেছেন, মৃত্যুর পর তাকে লাশ রাখার হিমাগারে রাখা হয়েছে। কিন্তু একটানা ঘ্যাচর ঘ্যাচর শব্দটা বড় চেনা চেনা লাগছে। আর এটা হিমাগার নয় তাও বুঝতে পারছেন, কেননা অনেকগুলো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন, খুব চেনা কণ্ঠস্বর, কিন্তু মনে করতে পারছেন না।
‘আম্মা, এই আম্মা চোখ খুলেন। আর কত ঘুমাবেন? সকাল গড়িয়ে যে দুপুর হয়ে এল’- নিকিতা তার মায়ের হাতটা ধরে জোরে ঝাকুনি দিল। গতকাল রাতে সবার সাথে একত্রে বসে রাতের খাবার খেলেন। মধ্যরাত পর্যন্ত নিকিতার সাথে গল্প করে শুতে গেলেন। নিকিতা গত তিনদিন হল মায়ের বাসায় বেড়াতে এসেছে। ছেলে-মেয়ের স্কুল ফাইনাল শেষ, তাই মায়ের সাথে এসে থাকা। মায়ের বয়স হয়েছে, কেমন একটা শিশুসুলভ ব্যাবহার সে মায়ের মাঝে লক্ষ্য করে। খুব মায়া হয় মায়ের জন্য, মনে হয় নিকিতারই ছোট্ট একটি মেয়ে জরিনা বেগম।
মায়ের হিমশীতল হাত ধরে কেমন সন্দেহ হল। নিকিতা তার ভাইয়ের বউ নীলাকে ডাক দিল।
“ভাবী আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছে, আম্মার শরীর এতো ঠাণ্ডা কেন? আর ঘুম থেকেও জাগছে না”
“আরে না ভয়ের কি আছে, আম্মা প্রায়ই এমন সারাদিন ঘুমিয়ে থাকেন। দেখি সরে বসতো, আমি দেখছি। আম্মা, এই আম্মা চোখ খুলেন, আম্মা...”
“হুম...” জরিনা বেগম টের পেলেন কে যেন তাকে ডাকছে, কোথায় যেন নিয়ে যেতে চায়। যেন জিজ্ঞাসা করলো, “যাবেন না আমার সাথে...?” তিনি সারা দিলেন। হঠাৎ মনে হল কোথায় যেন যাওয়ার জন্য বহুদিন তিনি অপেক্ষায় আছেন, কেউ একজন আসবে তাকে নিয়ে যেতে। অবশেষে সে এসেছে।
নিকিতা তার বড় ভাইকে ফোন করল, কিন্তু ফোন সুইচ অফ আসছে। আজ শুক্রবার, এখন দুপুর বেলা, জুম্মা নামাজের সময়, ভাই মসজিদে, তাই বোধহয় তার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে।
নাহিন আর তুর্য এলো ঘরে। নিকিতার ছেলে আর মেয়ে। সাথে মাইশা, নিকিতার ভাইয়ের মেয়ে। তিন শিশু জরিনা বেগমের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। নিকিতার ভাইয়ের মেয়ে মাইশা খুব পাকা পাকা কথা বলে, বয়স মাত্র আট। সে হঠাৎ বলে উঠলো,
“ও দাদু, তুমি কি মরে গেলে নাকি”
“মা...ই...শা...!” নিকিতার ভাইয়ের বউ মেয়ের দিকে। নিকিতার অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। সে মায়ের বাসা হতে বের হয়ে রাস্তায় এলো, রাস্তা ফাঁকা। মোড়ের সবকয়টা দোকান বন্ধ। যথারীতি ফার্মেসীটাও। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না নিকিতা। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি ক্যাব দেখে থামালো হাত ইশারা করে।
ট্যাক্সিওয়ালাকে হাসপাতালের কথা বলে রিকোয়েস্ট করল, ড্রাইভার রাজী হল। বাসায় এসে দেখে মা আগের মতই কেমন নিথর হয়ে শুয়ে আছে। বুকের ভেতর কেমন ছ্যাত করে উঠলো তার। তারা দুই মহিলা এবং ড্রাইভার অনেক কষ্টে জরিনা বেগমকে গাড়ীতে তুলল, দিনের মধ্য প্রহরে হলুদরঙা ট্যাক্সি ছুটে চলল ধানমণ্ডি আট নাম্বারের দিকে।
নিকিতা বারবার মায়ের হাতের পালস ধরে পরীক্ষা করছে, এক অজানা ভয় তার মেরুদণ্ড দিয়ে চোরাস্রোতের ন্যায় প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। তার ফর্সা গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু জরিনা বেগমের মুখে পড়ল। ভাইয়ের বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে রক্ত লাল চোখে চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে।
জরিনা বেগম কেমন প্রশান্তি অনুভব করছেন, অনেকদিন ধরে তার কোথায় যেন যাওয়ার কথা। লোকটা এতদিন পর তাকে নিতে এসেছে, কতদিনের অপেক্ষা। লোকটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছেন না, ঠিকমত। খুব লজ্জা লাগছে, চোখ খুলে চাইতেও পারছেন না। কিন্তু বুঝতে পারছেন লোকটি তাকে নিতে এসেছে, খুব দূর দেশে, মনে হয় বরফের দেশে। এত শীত! আর কেমন ভেজা ভেজা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি। মনে হচ্ছে বরফগলা কোন নদীতে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন, হাত ধরে আছে সেই খুব চেনা মানুষটি। আহ কি অদ্ভুত প্রশান্তি।